E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ১ এপ্রিল, ২০২২ / ১৭ চৈত্র, ১৪২৮

দেশজুড়ে পালিত ঐতিহাসিক ধর্মঘট

নীতি বদলের দাবি জানিয়ে হুঁশিয়ারি কেন্দ্রকে


ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল তিরুবনন্তপুরমে।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্পভিত্তিক ফেডারেশনগুলির যৌথ মঞ্চের ডাকে ১২ দফা দাবির ভিত্তিতে ২৮ এবং ২৯ মার্চের দু’দিনের দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট নয়া ইতিহাস লিখলো। শ্রম ও উৎপাদনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যাকে এই ধর্মঘটের পরিধি স্পর্শ করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতায় এই ধর্মঘট রুখতে শুধু কেন্দ্র নয়, কেরালার এলডিএফ সরকার ছাড়া নিপীড়ন এবং কালা কানুনের যাবতীয় সম্ভার নিয়ে পদক্ষেপ করতে মাঠে নেমেছিল প্রায় সব রাজ্যের সরকার। কিন্তু লাভ হয়নি। এসমা বিধি সহ যাবতীয় প্রশাসনিক ভ্রূকুটিকে ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে শ্রীনগরের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী থেকে তুতিকোরিন বন্দরের শ্রমিকরা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে শেষ কথা বলার হক বরাবরের মতো এখনও তাদেরই।

দেশব্যাপী দু’দিনের সফল ধর্মঘটের জন্য শ্রমিকশ্রেণিকে অভিনন্দন জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো। এক বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো বলেছে, সরকার শ্রমিকদের নিপীড়ন না করে দাবিগুলির প্রতি মনোযোগ দিক, শ্রমিকশ্রেণি বিরোধী নীতি অনুসরণ করা বন্ধ করুক। এই ধর্মঘট সেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

ভারত সরকারের শ্রমিক‍‌ বিরোধী, জনবিরোধী ও দেশবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা দু’দিনের সাধারণ ধর্মঘট‍‌কে পূর্ণ সমর্থন জানায় ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়নস (ডব্লিউএফটিইউ)।

শ্রীনগরে ধর্মঘটী অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বিক্ষোভ।

এই দু’দিন দেশের অন্তত ৮ রাজ্যে সাধারণ ধর্মঘট প্রায় বনধের চেহারা নিয়েছিল। কেরালা, তামিলনাডু, পুদুচেরি, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ওডিশা, আসাম, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ডে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। একই ছবি দেখা গেছে ত্রিপুরায়। জাতীয় সড়কগুলিতে অবরোধ কর্মসূচির জেরে দেশজুড়ে সড়ক পরিবহণ কার্যত থেমে যায়। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে সড়ক অবরোধ এবং রেল স্টেশনগুলিতে ট্রেন আটকে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কারখানার গেটে জমায়েত হয়ে শ্রমিকরা উৎপাদন রুখে দিয়ে তারপর ধর্মঘটী শ্রমিকদের নিয়ে রাস্তাজুড়ে মিছিল করেছেন। ধর্মঘট করা যাবে না - হাইকোর্টের এমন রায়ের পাশাপাশি মজুরি ছাঁটাইয়ের নির্দেশ, সঙ্গে কাজ হারানোর হুমকি থাকলেও শ্রমজীবী মানুষ পরোয়া করেননি এসবের। মহারাষ্ট্র তামিলনাডু পশ্চিমবঙ্গ দিল্লি তেলেঙ্গানা কর্ণাটক হরিয়ানার বিভিন্ন শিল্প এলাকাগুলিতে নজিরবিহীনভাবে সফল হয়েছে ধর্মঘট। ছত্তিশগড় বিহার রাজস্থানের শিল্পাঞ্চলেও ধর্মঘট পালিত হয়েছে। ধর্মঘট সফল হয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের এবং হিমাচলের শিল্পাঞ্চলেও। শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ততায় বন্ধ ছিল তুতিকোরিন এবং পারাদ্বীপ বন্দর। অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত ক্ষেত্র বাঁচানোর জন্য বনধের ডাকে সাড়া দিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা শহর। একই চিত্র ভেল এবং ত্রিচির কারখানাগুলোতেও।

দেশজুড়ে কয়লা ক্ষেত্রগুলির অন্তত ৬০ শতাংশ খনিতে ধর্মঘটের জেরে কোনো কাজ হয়নি। সিঙ্গারেনি থেকে ঝাড়খণ্ড - সর্বত্রই খনি শ্রমিকরা লাল ঝান্ডা নিয়ে পথে ছিলেন। কয়লা পাঠানোর কাজ বন্ধ ছিল। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রেও ধর্মঘটের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কেরালা তামিলনাড়ু কর্ণাটক পুদুচেরিকে নিয়ে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে কয়লা ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ৮০-১০০ শতাংশ সফল ধর্মঘট হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে আসাম-নাগাল্যান্ড ত্রিপুরা পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎক্ষেত্রেও ধর্মঘট ১০০ শতাংশ সফল।

ধর্মঘটের সমর্থনে হায়দরাবাদে বামপন্থী দলগুলির ডাকে প্রতিবাদ।

নয়া উদারনীতির মৃগয়া ক্ষেত্র হিসেবে দেশের ব্যাংক বিমা ক্ষেত্রকে যেভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে ধর্মঘটে তার জবাব দিয়েছেন এই রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের কর্মীরা। প্রতিটি রাজ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মঘটের প্রভাব প্রায় সর্বাত্মক। ডাক আয়কর সহ ব্যাংক-বিমা এবং অন্যান্য বড়ো কেন্দ্রীয় দপ্তরগুলোতে প্রায় দু’দিন কাজ হয়নি। তামিলনাড়ুতে ৩০০ জায়গায় কেন্দ্রীয় দপ্তরের সামনে বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক। কলকাতাসহ অন্যত্র টেলিকম ক্ষেত্রের কর্মীরা ধর্মঘটে যোগ দেন আগের দিন সন্ধ্যে থেকেই।

বেসরকারি উৎপাদন ক্ষেত্রে ধর্মঘটের জোরালো প্রভাব পড়েছে। এই ধর্মঘটে বিশেষ লক্ষণীয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণ। দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোটি কোটি শ্রমিক, যাদের মধ্যে নির্মাণকর্মী বিড়ি শ্রমিক মুটিয়া মজদুর বেসরকারি পরিবহণ ক্ষেত্রের শ্রমিক রয়েছেন তারা কাজ খোয়ানোর ঝুঁকি নিয়েও থেকেছেন ধর্মঘটের সামনের সারিতে।

এর পাশাপাশি দেশের প্রায় ৮০ লক্ষ প্রকল্প শ্রমিক ধর্মঘটে শামিল হন। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিডডেমিল প্রকল্পগুলির সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার মহিলা কর্মী শ্রীনগর থেকে তামিলনাডু, রাজস্থান থেকে মহারাষ্ট্র, ত্রিপুরা সর্বত্র রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান।

সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে তুতিকোরিনে জাহাজ চলাচল রুখে দিলেন ধর্মঘটী শ্রমিকরা।

আবার বন্দর শ্রমিকদের ধর্মঘট নজর কেড়েছে গোটা দেশের। তামিলনাড়ুর তুতিকোরিন বন্দর থেকে একটি জাহাজকেও নড়তে দেননি শ্রমিকরা। দ্বিতীয় দিনে মালবাহী একটি জাহাজ চালানোর চেষ্টা হলে তার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েন ৫ জন শ্রমিক। তারপরই জাহাজ ছাড়া থেকে বিরত থাকে কর্তৃপক্ষ।

হরিয়ানায় পরিবহণ ধর্মঘট রুখতে এসমা জারি করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভোরের আলো ফোটার আগে ডিপোর সামনে জমায়েত হয়ে পিকেটিংয়ে বসে যান শ্রমিকরা। সড়ক পরিবহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল ধর্মঘট হয়েছে হরিয়ানাতে এসমাকে উপেক্ষা করে এবং তামিলনাডুতে।

দেশের জনবিরোধী নীতি সমূহের চরম বিষময় ফল ভোগ করছেন যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকশ্রেণি তাঁরা ধর্মঘটে প্রমাণ করে দিয়েছেন, দেশের চালিকাশক্তির অন্যতম নিয়ন্ত্রক তাঁরাই। দেশজুড়ে সর্বত্রই বন্ধ থেকেছে নির্মাণের কাজ। ধর্মঘটের দু’দিন ১২ লক্ষেরও বেশি নির্মাণকর্মী ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ধর্মঘট সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। দেশের প্রায় ৪ হাজার নির্মাণক্ষেত্রে তারা বিক্ষোভ দেখিয়ে বন্ধ রেখেছেন কাজ।

সাধারণ ধর্মঘটে পাটনায় অবরোধ বামপন্থীদের।

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে বেসরকারি হাতে দেশের সম্পদ তুলে দেবার ভাবনাকে ব্যাপক ধাক্কা দিয়েছে এই ধর্মঘট। রাজধানী দিল্লি থেকে বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই কলকাতা চেন্নাই সহ দেশের বৃহৎ শহরগুলির ব্যাংক অচল করে দিয়ে কর্মীরা রাস্তায় নেমেছেন। গুজরাটেও বন্ধ থেকেছে ব্যাঙ্ক পরিষেবা সহ রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্র।

অন্যদিকে ধর্মঘট শুরু হবার আগের দিন কেরালা হাইকোর্ট ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের সমস্ত সরকারি কর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে আদালতের বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে কেরালার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী ধর্মঘটে অংশ নিয়ে নিজেদের অর্জিত অধিকার বজায় রেখেছেন দু’দিন ধরেই। দু’দিন ধরেই রাস্তায় নেমেছিলেন ধর্মঘটের শ্রমিক-কর্মচারী সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের কর্মী-সদস্যরা। তাঁদের অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্ত এবং সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়েছে কেরালায়।

রাষ্ট্রীয় ইস্পাত নিগম লিমিটেডের কমপক্ষে ৮ হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে কাজে যোগ দেননি। তাই কারখানার একটিমাত্র চুল্লি জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছেন কর্তৃপক্ষ। ইস্পাত ও কয়লা ক্ষেত্রের ধর্মঘটে দেশজুড়ে ব্যাপক সাড়া পড়েছে এবারেও। পশ্চিমবঙ্গ সহ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন সবকটি ইস্পাত কয়লা ক্ষেত্রেই ধর্মঘট ব্যাপক রূপ নিয়েছে।

গ্রাম ভারতেও কৃষকসহ গ্রামাঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ দু’দিনের ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন সংগঠিতভাবে। কর্পোরেট তোষণ নীতির প্রতিবাদ জানাতে তারা পুলিশের লাঠির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন ধর্মঘট ভাঙার প্রচেষ্টা রুখে দিতে। এই ধর্মঘটকে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করে সারা ভারত কৃষক সভা বলেছে, শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যেই এই ধর্মঘট ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে। দেশজুড়ে কোটি কোটি শ্রমিক-কর্মচারীর সঙ্গে কৃষকসহ সমস্ত শ্রমজীবী জনতা পথে নেমে এই দু’দিনের ধর্মঘটের ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জনের ভূমিকা পালন করেছে। তাকে অভিনন্দিত করেছে সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকেও। আলাদা বিবৃতিতে ধর্মঘটকারী দেশের শ্রমজীবী মানুষদের অভিনন্দন জানানো হয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি জানানো হয়েছে সংহতি।

সিআইটিইউ সহ শ্রমিক সংগঠনগুলো এই বিপুল আকারের ধর্মঘটের জন্য শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।