E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ১ এপ্রিল, ২০২২ / ১৭ চৈত্র, ১৪২৮

হুমকির কাছে মাথা নত নয়

ধর্মঘটে জানান দিল ত্রিপুরা

সৌরভ চক্রবর্তী


ধর্মঘটের দিন শুনশান কুমারঘাট রেল স্টেশন।

শাসক বিজেপি জনগণের প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নিতে ২৮-২৯ মার্চ ধর্মঘটেও পেশির আস্ফালন দেখিয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের কার্যত প্রশাসনিক হুমকি দেওয়া হয়েছে। রাজ্য থেকে প্রকাশিত মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমের বৃহৎ অংশ শাসকের হয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে।

পরিবহণ শ্রমিক, মালিকদের শাসানো হয়েছে বন্‌ধে দু’দিন চাক্কা না ঘুরলে কোনোদিন গাড়ি চালাতে দেওয়া হবে না। ছোটো ছোটো প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দেওয়া হয়েছে বন্‌ধে শামিল হলে লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। দোকানদারদের প্রতি হুমকি ছিল দোকান না খুললে পরিণতি খারাপ হবে। এই সর্বগ্রাসী আক্রমণের মধ্যেও ত্রিপুরা জেদি লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি জোট সরকারকে।

শাসকের ভয়-হুমকি উপেক্ষা করেই ব্যাপক প্রভাব পড়েছে মহকুমা সদর ও গ্রামীণ এলাকাগুলিতে। কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতি ও স্বৈরাচারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রতিফলন ছিল এবারের ধর্মঘট। আগরতলা শহরের মানুষও ধর্মঘটে সাড়া দেন।

২৮ মার্চ সকাল থেকে রাজ্যের সর্বত্র বন্‌ধের চেহারা নিতে দেখে শাসকদল তাদের পোষা দুর্বৃত্ত বাহিনীকে নামিয়ে দেয় রাস্তায়। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে হুমকি দিয়ে, হুলিয়া জারি করে জনজীবন স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। অনেকাংশেই সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন নানা পেশার জনগণ। হুলিয়া জারি করে, ভয় দেখিয়ে কর্মচারীদের অফিসে যেতে বাধ্য করে রাজ্য সরকার। এরপরও কিছু কর্মচারী কাজে যান নি। অফিসগুলিতে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল না। ব্যাংক শাখাগুলির দরজা খোলেনি বহু স্থানে। শাসকদলের চাপের মুখে পড়ে কিছু স্থানে শাখা খুললেও কার্যত গ্রাহক শূন্য ছিল। ব্যাপক সাড়া দিয়েছেন বিএসএনএল, এলআইসি-সহ বিভিন্ন পেশার কর্মীরা। আগরতলা শহরে প্রথম দিন থেকে ধর্মঘটের প্রভাব পড়ে। দোকানপাট ছিল বন্ধ। গাড়ি চলাচল ছিল না। নাগেরজলা স্ট্যান্ড, চন্দ্রপুর বাস টার্মিনাস, রাধানগর বাস স্ট্যান্ডে গাড়িগুলি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ছিল। যাত্রী ছিল না। এই অবস্থা দেখে শাসকদলের বাইক বাহিনী জোর করে গাড়ি নামায় রাস্তায়। দোকানপাট খোলায়। এরপরও যাত্রী তেমন সংখ্যায় ছিল না। ক্রেতার সংখ্যাও ছিল কম। সবমিলিয়ে আগরতলা শহরের অন্যান্য দিনের ব্যস্ততার চেনা ছবি চোখে পড়েনি।

প্রতিবেশী আসাম রাজ্য থেকে একমাত্র প্রবেশপথ ধর্মনগর মহকুমায় দোকানপাট ছিল বন্ধ। রাস্তায় ছিল না লোকজন। গাড়ি চলাচলও ছিল খুবই কম। হুমকি, ধমক দিয়ে শাসকদল দোকানপাট খোলানোর চেষ্টা করে, রাস্তায় গাড়ি নামানোর চেষ্টা করলেও অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়। কাঞ্চনপুর মোটরস্ট্যান্ডে বিএমএস’র তরফে হুমকি দিয়ে গাড়ি চালকদের আসতে চাপ দেয়। কিন্তু মোটরস্ট্যান্ড ছিল কার্যত শুনশান। যাত্রীর দেখা মেলেনি।

ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা কৈলাশহরেও। দোকানপাট খোলেননি ছোটো-বড়ো ব্যবসায়ীরা। কোনো ব্যাংক শাখার দরজাও খোলেনি। প্রথম দিন ছোটো বড়ো গাড়ি চলাচল করেনি রাস্তায়। ব্যাপক সাড়া পড়েছে রেলশহর কুমারঘাটেও। মহকুমার শহর ছাড়াও গ্রামীণ এলাকা কাঞ্চনবাড়ি, রাতাছড়া, বেতছড়া, ফটিকরায়, রাধানগর, সোনাইমুড়ি, সুকান্তনগর, পেচারথল, মাছমারা ইত্যাদি এলাকায়ও সবকিছুই ছিল বন্ধ। সাড়া পড়েছে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা ডেমডুম, রাজকান্দি, নবীনছড়ায়ও।

ধর্মনগরে বন্ধ দোকান, রাস্তায় নেই যানবাহন।

লংতরাইভ্যালি মহকুমাতেও ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে। ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে ধলাই জেলা সদরে। ২৮ মার্চ সকাল থেকে আমবাসা, কুলাইসহ মহকুমার বিভিন্ন বাজারে দোকানপাট ছিল বন্ধ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে দোকান খুলতে একাংশ ব্যবসায়ীকে বাধ্য করেছে শাসকদল। ক্রেতা ছিল না। যান চলাচলও তেমন ছিল না। কমলপুর মহকুমার প্রায় প্রতিটি বাজারই বন্‌ধের চেহারা নেয়। দূরবর্তী গণ্ডাছড়ায়ও ধর্মঘটের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। রাস্তাঘাট ছিল শুনশান। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো গাড়ি রাস্তায় নামেনি।

অমরপুর মহকুমাতেও পড়েছে ধর্মঘটের প্রভাব। সাব্রুম মহকুমায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা সদর বিলোনীয়াতেও ধর্মঘটের প্রতিফলন দেখা যায়। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত ছিল। ২৮ মার্চ সকাল থেকে সোনামুড়া মহকুমার ছোটো-বড়ো হাট বাজারের দোকানপাটের দরজা ছিল বন্ধ। রাস্তায় নামেনি কোনো যানবাহন। ধর্মঘটের সর্বাত্মক চেহারা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে সকালের পর সর্বত্র রাস্তায় নামে শাসকদলের বাইক বাহিনী। প্রতিটি বাজারে জড়ো হয়ে দোকানিদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে দোকান খুলতে চাপ সৃষ্টি করে। বাধ্য করে দোকান খুলতে।

খোয়াইয়ের রাস্তায় যান চলাচল কম ছিল। দেশ বাঁচানো, মানুষ বাঁচানোর স্লোগানে দেশব্যাপী ধর্মঘট রাজ্যের গ্রাম পাহাড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। শহর এলাকায়ও ধর্মঘটের প্রভাব ছিল। রাজ্যের মানুষ সার্বিকভাবে ধর্মঘটে নৈতিক সমর্থন জানানোয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর তরফে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে দাবি করেছেন সিআইটিইউ’র রাজ্য সভাপতি মানিক দে।

রাজ্যের ৫টি বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের তরফে ধর্মঘটে মানুষের নৈতিক সমর্থনের জন্য অভিনন্দন জানানো হয়েছে। সিআইটিইউ রাজ্য সভাপতি মানিক দে বলেন, ধর্মঘটের একটা ব্যাপক প্রচার সারা দেশে হয়েছে। শ্রমিক-কৃষক বিরোধী একটা সরকার দিল্লিতে আছে। যেটা জনবিরোধী সরকার, কর্পোরেট বান্ধব। দেশবিরোধী একটা ধবংসাত্মক নীতি নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলো। দেশবাসীর জীবন জীবিকা বিপন্ন। ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি। সাম্প্রদায়িক শক্তি, স্বৈরাচারী শক্তি এবং দেশি-বিদেশি পুঁজির স্বার্থবাহী শক্তি বিজেপি’র নেতৃত্বে এক জোট হয়েছে। এই ত্রিমুখী জোটই এখন দেশের শাসন ক্ষমতায়। তারা অর্থনীতি, মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। এর বিরুদ্ধে ধর্মঘট। এটা আর চলতে দেওয়া যায় না। একটা বিহিত দরকার। দেশবাসী আজকের ধর্মঘটের মাধ্যমে এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা জেহাদ ঘোষণা করেছেন।