৫৯ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ১ এপ্রিল, ২০২২ / ১৭ চৈত্র, ১৪২৮
সিপিআই(এম) জম্মু কাশ্মীর রাজ্য ১২তম সম্মেলন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ শান্তি, মানুষের ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সাংবিধানিক অধিকার পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়ে ২৩ মার্চ সিপিআই(এম) জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য ১২তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো শ্রীনগরের লালচকে। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিতে গুলাম নবি মালিক রাজ্য সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।
সম্মেলনে সীতারাম ইয়েচুরি তাঁর ভাষণে কর্পোরেট স্বার্থবাহী বিজেপি-আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণকে রুখতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইউসুফ তারিগামি। খসড়া রিপোর্ট পেশ করেন সম্পাদক গুলাম নবি মালিক। খসড়া রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিত এবং আন্দোলন সংগ্রামের দিশার কথা। প্রতিনিধিদের আলোচনায়ও উঠে এসেছে জীবন-জীবিকা, বেরোজগারি, মেরুকরণ সহ কেন্দ্রের অগণতান্ত্রিক বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা। এই সম্মেলন থেকে রাজ্যের পরিস্থিতির সাপেক্ষে বলা হয়েছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার জম্মু-কাশ্মীরে যেভাবে সাংবিধানিক স্বশাসন সংক্রান্ত ৩৭০ ধারা রদ করেছে তার কথা। এই এলাকাকে দুটি পৃথক কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল হিসেবে ভাগ করে দেওয়ার পর থেকেই জম্মু এবং কাশ্মীরের পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি ঘটেছে। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট এই এলাকাকে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ এই দুই ভাগে ভাগ করতে ন্যক্কারজনক আক্রমণ নামিয়ে এনে জম্মু এবং কাশ্মীরের সংবিধানকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্র এবং রাজ্যের মানুষের যে সম্পর্ক তাকে খর্ব করেছে এবং তাদের এই স্বৈরাচারী পদক্ষেপের জেরে রাজ্যের মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে।
এই রাজ্যের ১৪টি আইন সংশোধন করা হয়েছে - যার মধ্যে রয়েছে চারটি বিশেষ আইন জম্মু-কাশ্মীর ডেভেলপমেন্ট আইন ১৯৭০, জম্মু-কাশ্মীর ল্যান্ড রেভিনিউ আইন ১৯৯৬, অ্যগ্রারিয়ান রিফর্মস আইন ১৯৭৬ এবং জম্মু-কাশ্মীর ল্যান্ড গ্র্যান্ট আইন ১৯৬০। এই আইনগুলি সংশোধন করার মধ্যে দিয়ে গোটা উপত্যকা ও রাজ্যজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তার অভাববোধ ছেয়ে গেছে। এর পাশাপাশি নতুন যে জমি আইন চালু করা হয়েছে তার জেরে জম্মু এবং কাশ্মীরের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বে অধোগামী প্রভাব পড়েছে।
গৃহীত রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, চরম স্বেচ্ছাচারিতার নজির গড়ে শাসকদল তাদের সুবিধামত ডিলিমিটেশন করে রাজ্যের সংসদীয় এলাকা পুনর্বিন্যাস করেছে। এমনকি বুনিয়াদি মানদণ্ড যেমন জনসংখ্যা-জনঘনত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়নি পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে লোকসভা কেন্দ্রগুলির নতুন সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। প্রতিবাদে এর বিরুদ্ধে অন্যান্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সিপিআই(এম) এই নয়া ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া পুনর্বিন্যাস আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায় এবং মামলায় যোগ দেয়। ৫ আগস্ট ২০১৯ পরবর্তী সময়ে লাগাতার লকডাউন এবং শাট ডাউনের জেরে গোটা এলাকার অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, হস্তশিল্প, হর্টিকালচার ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গেলেও যথাযথ ত্রাণ পৌঁছায়নি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে। উন্নয়নের যে সমস্ত দাবি বারংবার প্রশাসন করেছে কার্যত তাদের ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে তা। সমস্ত স্তরে ব্যাপক দুর্নীতি ছেয়ে গেছে। বেরোজগারির গ্রাফ এই এলাকায় তখন থেকেই নিম্নগামী হয়েছে।
পরিসংখ্যান এবং কর্মসূচি সংক্রান্ত মন্ত্রক তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানিয়েছে জম্মু এবং কাশ্মীরের বর্তমান বেকারত্বের হার ৪৬.৩ শতাংশ যা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কাজের জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকার অনন্ত অপেক্ষা শিক্ষিত বেকার যুবকদের মধ্যে ভয়ঙ্কর ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীদের বরখাস্ত করার স্বেচ্ছাচারিতা প্রশাসনের একনায়কত্বের মনোভাবকেই স্পষ্ট করেছে।
আপেল শিল্প যা এই এলাকার অর্থনীতির মেরুদণ্ড স্বরূপ তা বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন। তার কারণ দীর্ঘ লকডাউন এবং আমদানি করা শুল্ক মুক্ত আপেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না এই শিল্প। তার জেরে শুধু আপেল ব্যবসায়ীরাই নন, আপেল উৎপাদকরা প্রবল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এর পাশাপাশি চলছে জমি থেকে কৃষকদের উৎখাত পর্ব। কাচারি, বানজার, শামিলাত - কাশ্মীরের বিভিন্ন ধরনের জমি যা গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের হকেরজমি তা রোশনি প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের থেকে নিয়ে নেওয়ার জেরে প্রবল অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে গ্রামীণ মানুষের মনে।
উদ্বেগের সঙ্গে আলোচনা ও রিপোর্টে উঠে এসেছে ইউএপিএ, পিএসপি প্রভৃতি দানবীয় আইনের মাধ্যমে যথেচ্ছ ধরপাকড় চলছে এবং যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের উপত্যকার বাইরে বন্দি করে রেখে দেওয়ায় যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে মানুষের মধ্যে। যুবকরাই মূলত এই ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ট্রেড ইউনিয়নের কর্মসূচি গ্রহণের ওপরেও বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রাখা হয়েছে।
গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরাও হিংসা এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন এই সময়ে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে লুণ্ঠিত এবং পদদলিত করা হচ্ছে।
রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে পঞ্চায়েত সদস্য থেকে নিরীহ অসামরিক ব্যক্তিদের এবং পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীদের হত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে নয়া কাশ্মীরের যে ছবি তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে সেখানে স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে উঠে আসছে এই ধরনের ঘটনাসমূহ।
সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাভের জন্য বিজেপি সরকার কাশ্মীর ফাইলস নামক সিনেমাটিকে প্রচার করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে মানুষের মধ্যে আরও তীব্র মেরুকরণ করার জন্য।
সম্মেলন থেকে মানুষের ঐক্যের জন্য লড়াই এবং আইনসম্মতভাবে সাংবিধানিক অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গরিব সাধারণ জনগণের কল্যাণের জন্য ঐক্যবদ্ধ লড়াই জোরদার করার অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে।
রিপোর্ট ও আলোচনায় রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের জন্য শান্তি, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতরা যাতে তাঁদের বাড়িতে ফিরে আসতে পারেন তার জন্য কাজ করে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে গৃহীত রিপোর্টে।