৫৯ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ১ এপ্রিল, ২০২২ / ১৭ চৈত্র, ১৪২৮
পেট্রোল ও ডিজেলের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে
ঈশিতা মুখার্জি
গত দশ দিনে নয় বার পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দিল দেশের সরকার। শহর পিছু এই দাম পরিবর্তন হয়, কিন্তু তার আগে বোঝা দরকার তেলের এই মূল্য বৃদ্ধি কী দেশের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে সহনীয়? কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিজের মতো যুক্তি সাজিয়ে বলছে, এই দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী বিশ্ববাজারে তেলের দামের ওঠাপড়া। সে তো আগেও ছিল। বিশ্বের অন্য দেশগুলিও তাহলে এর আওতায় পড়বে। তাহলে এই গত দশ দিনে এইভাবে ক্রমাগত তেলের দাম বাড়ছে কেন? সরকার এত নির্লিপ্ত কেন? আমাদের রাজ্যের এ বিষয়ে কী কিছু করণীয় আছে? কলকাতা শহরে গত ২২ মার্চ তেলের দাম ছিল ১০৫ টাকা ৫১ পয়সা। ২৯ মার্চ তা হয়ে দাঁড়াল ১০৯ টাকা ৬৮ পয়সা। এই মার্চ মাসে বৃদ্ধির হার ৫.২৯ শতাংশ । পেট্রোল ও ডিজেলের দামের মধ্যে দুটি অংশ থাকে - বাজারে তেলের দাম এবং দেশের অভ্যন্তরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নির্ধারিত কর। সব কিছু পণ্য পরিষেবা করের আওতায় পড়লেও পেট্রোল, ডিজেলকে সরকার এর বাইরে রেখেছে কোনরকম ব্যাখ্যা ছাড়াই। তাই তেলের দামের এইরকম তিনটি ভাগ। এর ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম পড়ে গেলেও এরকম ঘটেছে যে, দেশে পেট্রোপণ্যের দাম বেড়েছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর এই দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, পেট্রোলের দামের মধ্যে ৬০ শতাংশ হলো কেন্দ্র এবং রাজ্যের পরোক্ষ করের ভাগ। ডিজেলের দামের মধ্যে ৫৪ শতাংশ হলো এই করের ভাগ। এই দাম দেশের ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচক নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এর ফলে সমস্ত পণ্যের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই করের বোঝা কমানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে মূল্যবৃদ্ধি হতে চলেছে। এই কথা তিনি মাত্র কয়েক দিন আগেই জানিয়েছেন।
বিভিন্ন শহরে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির রেখচিত্র -
আমাদের দেশে বিশ্ব বাজারে তেলের দামের ওঠাপড়ার কেন এত প্রভাব ফেলে তার কারণ ভারত তার প্রয়োজনীয় তেলের ৮৫ শতাংশ আমদানি করে থাকে। বিশ্ববাজারে দামের ওঠানামার সাথে আমাদের দেশে দাম বাড়ানো কমানো সবসময়ে হয় না। এখানে আর্থিক নীতির স্বচ্ছতার প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে। প্রতিদিন দাম ওঠানামা পাঁচ রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনের সময়ে বন্ধ ছিল। ওই নির্বাচনের সময়ে দৈনিক পেট্রোল ও ডিজেলের মূল্য পরিবর্তিত হয় নি। রাজনৈতিক কারণে এই মূল্য বৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখার ফলে একধাক্কায় অনেকটা দাম বাড়াল সরকার। এইভাবে শতকরা দাম বৃদ্ধির প্রভাব বাজারে অনেক বেশি পড়ে এবং জিনিসপত্রের দাম এরফলে এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যায়। সরকারের করের অংশ ছাড়া এই দামের মধ্যে রয়েছে বাজারে তেলের দাম। তা নিয়ন্ত্রণ করে তেল কোম্পানির মালিকেরা। আর্থিক নীতির স্বচ্ছতার কথা বলতে গেলে এই কথাটিও অতীতে চলে এসেছে যে, যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যায়, তখন কিন্তু সবসময়ে দেশের অভ্যন্তরে তেল কোম্পানিরা দাম কমান না। সুতরাং এই দাম বাড়ার জন্য তেল কোম্পানি, কেন্দ্রের সরকার, রাজ্যের সরকার সকলেই দায়ী।
পেট্রোল-ডিজেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করে মূলত দেশের অভ্যন্তরের শক্তিগুলি। সরকারের হাতে রয়েছে পরোক্ষ কর, যা এই মুহূর্তে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নামিয়ে আনার কথা বলছে। যদি বর্তমান সরকারের মেয়াদকালের শুরু ২০১৪ সাল থেকে দেখি, তাহলে বলা যায়, ওই সময় থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোল ও ডিজেলের উপর কর চাপিয়েছে আগের সরকারের চেয়ে অনেক বেশি। ২০১৪ সালে যখন পেট্রোলের দামে প্রতি কেন্দ্রের করের ভাগ ছিল ১০.৪ শতাংশ, তখন ২০২১ সালে এই করের অংশ বেড়ে হয়েছে ৩২.৯ শতাংশ। ক্রমাগতই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পরোক্ষ করের মাত্রা বাড়িয়ে গেছে। পেট্রোল ও ডিজেল বাবদ সরকারের কর থেকে আয় সরকারের মোট কর বাবদ রাজস্ব সংগ্রহের ১২শতাংশ। সরকারের মূল রাজস্ব আয় আসে এই পেট্রোল ও ডিজেলের উপর করের বোঝা চাপিয়ে। তাই সরকার কী কেন্দ্র, কী রাজ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনমতেই এই করের বোঝা কমাবে না। সরকারের ধীরে ধীরে রাজস্ব আয়ের অন্য পথ প্রায় তারা নিজেরাই বন্ধ করে ফেলছে। আমরা বাজেট দেখেই সে কথা বুঝতে পারি। সরকার তার রাজস্ব আয়ের জন্য কর কমাবে না, তেল কোম্পানি তার ভাগ ছাড়বে না। যাদের সব ছাড়তে হবে তারা হলেন দেশের সাধারণ মানুষ। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়লে, তার প্রভাবে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়ে চূড়ান্তভাবে। দেশের সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।
দেশের অর্থমন্ত্রী সংসদে অবশ্য বলেছেন যে, যুদ্ধের জন্য এই তেলের দাম বৃদ্ধি। কিন্তু এটি সত্য নয়। কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগে জানালেন যে, ২০২১-২২ সালে দেশে যে তেল আমদানি হয়েছে, তার মধ্যে ১ শতাংশেরও কম আমদানি হয়েছে রাশিয়া থেকে। সুতরাং তেলের জোগান নিয়ে বিশেষ চিন্তার কোনো কারণ নেই। চিন্তার কারণ বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দামের ভীষণভাবে ওঠাপড়া। এই যুদ্ধের ফলে এই ওঠাপড়া আরও বেড়ে গেছে। রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল বিক্রেতা। আর ভারত তৃতীয় বৃহত্তম তেলের ক্রেতা। ভারতের অর্থনীতি এমনিতেই মন্দায় ডুবে রয়েছে। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। এই অবস্থায় বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দামের ওঠাপড়া এবং দেশের অভ্যন্তরে তেল কোম্পানিগুলি এবং সরকার এই সব ওঠাপড়ার আর্থিক দায় দেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ফলে তেলের দাম বাড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। দেশের মধ্যে বেকারি বৃদ্ধি এবং কম মজুরির হারের জন্য। এই খরচের দায় কোথাও কেউ না নিতে নিতে সর্বশেষ যাদের ওপর পড়ছে তারা হলেন দেশের মানুষ। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আরও জানাচ্ছে যে, ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়ছে, তাই আমদানি ব্যয় দেশীয় মুদ্রায় বাড়ছে। এই সব দিক দিয়েই তেলের দামের উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে, দেশের মানুষের ক্ষতি। এর সাথে সাথে দেশের অন্য পণ্যের উৎপাদনও বাধা পাবে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সবসময়েই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে, চাহিদা বাড়িয়ে কোনো আর্থিক বৃদ্ধির কথা ভাবে না। আগ্রাসী করপোরেট পুঁজিবাদ মানুষের ব্যয়ের কথা ভাবে না, ভাবে শুধুই মুনাফার কথা। তেলের অর্থনীতিও এর থেকে আলাদা নয়।
এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ তেলের দাম যে রাজ্যে তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম।
কোনো সরকারই তেল বাবদ রাজস্ব সংগ্রহ কমাতে চাইছে না, কারণ সরকারের রাজস্ব আয় বর্তমানে মূলত দাঁড়িয়ে আছে এর উপর। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দামের ওঠানামার কথা আলোচনায় আসছে। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকেই যে হারে পেট্রোল ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে তা মারাত্মক। চিত্র ১ আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে, পেট্রোলের দামের এই বিপজ্জনক অগ্রগতি। তেল কোম্পানিগুলি মুনাফা কমুক তা চাইছে না এবং অন্যদিকে পরোক্ষ করের অংশ কেন্দ্রের সরকার বৃদ্ধি করেছে ১৩৮ শতাংশ। এরফলে সমস্ত দায় ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
এই ব্যবস্থা স্থায়ী ব্যবস্থা হওয়া যে কোনো দেশের পক্ষেই অসম্ভব খারাপ পরিণতি ডেকে আনবে। বর্তমানে এক মারাত্মক পরিণতির দিকে দেশ এগোচ্ছে এই ব্যবস্থাকে জিইয়ে রেখে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সাবধানবাণী ঘোষণা করে দিয়েছে। তারা জানিয়েছে যে, এই মারাত্মক পরিস্থিতি দেশ কোনো অবস্থাতেই সামাল দিতে পারবে না। এক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতা এক ধরনের দেশদ্রোহিতা, দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।