৬১ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ / ১৪ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
কেন্দ্র-রাজ্যের দুই সরকারকে কলকাতার শ্রমিক-কৃষক জমায়েত জানিয়ে দিল
মানুষমারা নীতি না বদলালে বদলে যাবে সরকার
রানি রাসমণি রোডে শ্রমিক-কৃষকদের সমাবেশ ও রাজভবন অভিযানে বক্তব্য রাখছেন সিআইটিইউ সাধারণ সম্পাদক তপন সেন।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ‘হয় নীতি বদলাও না হলে আমরা সরকার বদলে দেব’। গোটা দেশের ২৫টি রাজ্যের ধরনারত শ্রমজীবীদের দাবি আদায়ের লড়াইয়ের সুরে সুর মিলিয়ে দিল্লির মোদি সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে কলকাতার ধর্মতলায় কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনসমুহের যুক্ত মঞ্চ এবং সংযুক্ত কৃষান মোর্চার আহ্বানে আয়োজিত তিনদিনের শ্রমিক-কৃষক জমায়েত জানিয়ে দিল, সরকারের করপোরেট সাম্প্রদায়িক আঁতাতের বিরুদ্ধে ‘লড়াই আরও তীব্র হবে’। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের নাছোড় লড়াইয়ের প্রেরণা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সভায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বলেন, শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী আন্দোলনকে জোরদার করে পথে নেমে আরও ছড়িয়ে দিতে হবে, শামিল করতে হবে আরও বেশি মানুষকে। দিল্লি শুধু নয়, এরাজ্যের তৃণমূল সরকারকে বাধ্য করতে হবে দাবি দাওয়া মেনে নিতে।
শ্রমিক-কৃষক স্বার্থ বিরোধী চারটি শ্রম কোড বাতিল, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ও প্রিপেড মিটার বাতিল, রেগার বকেয়া মজুরি শোধ ও মজুরি বৃদ্ধি, মূল্যবৃদ্ধি রোধ সহ অন্যান্য দাবিতে ধর্মতলার রানি রাসমণি রোড সংলগ্ন চত্বরে ২৬, ২৭এবং ২৮ নভেম্বর লাগাতার দেশের অন্যান্য অংশের মতো সুবিশাল সমাবেশ আয়োজিত হয়। যুক্ত মঞ্চ এবং সংযুক্ত কৃষান মোর্চার এই সমাবেশ থেকে রাজভবন অভিযানের ডাক দেওয়া হয়। তিনদিন এই সমাবেশে বিভিন্ন বক্তা বক্তব্য রাখেন। শিলিগুড়িতেও যুক্ত মঞ্চ এবং সংযুক্ত কৃষান মোর্চার ডাকে সভা অনুষ্ঠিত হয়।
২৮ নভেম্বর এই সভায় সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এবং সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য তপন সেন বলেন, এই সরকারের নীতিতে আক্রান্ত শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুব মহিলা সহ সমাজের গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। শ্রমিক কৃষকদের এই নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রতিরোধের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শ্রমিক কৃষকরা এক মঞ্চে এসেছেন, তাঁদের শত্রুকে চিহ্নিত করেছেন এটা বড়ো কথা। অনেক বাধার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছর ধরে আমাদের যে অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করা গিয়েছিল এই মোদি সরকার সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে তা ধ্বংস করছে, তুলে দিচ্ছে করপোরেটের হাতে। তারই প্রতিফলন ঘটছে জনজীবনে। ৩৭ শতাংশ মানুষের রোজগার ৬০০০ টাকা যাতে তাদের সংসার চলছে না। স্মার্ট মিটার বসানো থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার দখল নিতে গেলে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। তাড়া করতে হবে। সরকারের প্রতিনিধিদের প্রতিবাদকে এই স্তরে নিয়ে যেতে হবে। এই কাজ শুরু হয়েছে। আমরা এইভাবে বেসরকারিকরণ বেশ কিছু জায়গায় রুখে দিয়েছি। প্রতিরোধের লড়াইয়ে শামিল হতে হবে শ্রমজীবী মানুষকে।
রানি রাসমণি রোডের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে কার্যত ধর্মতলাকে অবরুদ্ধ করে দেয় এই সমাবেশ। গণনাট্য সংঘ সহ সংস্কৃতি কর্মীদের গান আবৃত্তির কোলাজে তিন দিন ধরেই জমজমাট থেকেছে ধর্মতলা চত্বর।
২৮ নভেম্বর পেনশনার্স সমিতির পক্ষ থেকেও স্মারকলিপি দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রীকে এদিনের সমাবেশ থেকে খোলা চিঠি দেয় মিড ডে মিল ওয়ার্কার্সদের সংগঠন। তা পড়ে শোনানো হয় সমাবেশে। হাওড়া শিয়ালদা সহ বিভিন্ন শহরের প্রান্ত থেকে এদিন সুবিশাল মিছিল সমাবেশ স্থলে পৌঁছায়।
সমাবেশে কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা বলেন, সরকার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার একটাও পূরণ করেনি। এই সমস্ত প্রতিশ্রুতি আদায় করার জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হবে। রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে সেই লড়াই। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এই তিন দিনের আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন, গোটা দেশে প্রতিরোধে একসঙ্গে হাত মিলিয়েছে শ্রমিক কৃষকরা। শ্রমজীবী মানুষের উপর কেন্দ্রের এবং রাজ্যের স্বৈরাচারী সরকারের আক্রমণ রূপ পাল্টেছে, তাই সার্বিক প্রতিরোধ দরকার। কৃষক এবং খেতমজুরদের আত্মহত্যা সম্পর্কে তিনি বলেন মিথ্যে মামলা দেওয়া থেকে শোষণ বঞ্চনা ঋণজালে জড়িয়ে ফেলার মতো নানা ঘটনায় গণতন্ত্র পদদলিত হচ্ছে। দীর্ঘ হচ্ছে কৃষক খেতমজুরদের আত্মহত্যার তালিকা। বাড়ছে শ্রমিক ছাঁটাই। এর বিরুদ্ধে পথে নেমে আরও তীব্র আন্দোলন করে সরকারকে বাধ্য করতে হবে কথা শুনতে।
সভায় কৃষক নেতা অমল হালদার বলেন, রেগার বকেয়া টাকা নিয়ে রাজ্যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। কাজ না হওয়ায় মজুরি ও পাচ্ছেন না কৃষক খেতমজুররা। অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। কৃষক শ্রমিক ও খেত মজুরদের এই জোটকে আরো শক্তিশালী করতে হবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলতে হবে আমাদের কর্মসূচি ও লক্ষ্যের কথা। তুলে ধরতে হবে আমাদের দাবির কথা। এই রাজ্যের সরকার, এই দেশের সরকারকে তবেই আমরা আমাদের কথা শোনাতে বাধ্য করতে পারব।
খেতমজুর ইউনিয়নের নেতা তুষার ঘোষ সমাবেশে বলেন, একটা বিকল্প চাইছেন মানুষ।এই বিকল্প সরকার যারা দেশে ফসলের ন্যায্য দাম দেবে, ১০০ দিনের কাজ ২০০ দিন করবে, মজুরি বৃদ্ধি করবে। শ্রমিক কৃষক খেতমজুরদের লড়াই করে আদায় করতে হবে এই সব দাবি।
সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সম্পাদক অনাদি সাহু বলেন, গোটা দেশে মানুষের হাতে কাজ নেই। বেকারদের এবং শ্রমিকদের সঙ্গে কথার খেলাপ করেছে রাজ্য ও কেন্দ্রের এই দুই সরকার। রাজ্যে শিক্ষকদের নিয়ে সীমাহীন দুর্নীতি করেছে নবান্ন’র সরকার। শ্রমিক বিরোধী মনোভাব নিয়ে চলছে এরা। লাগাতার দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন করে হটাতে হবে এদের।
সমাবেশ পরিচালনা করেন বিপ্লব মজুমদার, সুভাষ মুখার্জি, কার্তিক পাল, বাসুদেব গুপ্ত, অতনু চক্রবর্তী, বিসি পাল রায়, ইসমত আরা খাতুন, মৃণালকান্তি বসু, নমিতা গায়েন, গোপাল বিশ্বাস, অজিত মুখার্জি, ফরিদ মল্লিককে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।
সমাবেশে অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রত্না দত্ত, মধুমিতা ব্যানার্জি, লীনা চ্যাটার্জি, মৃণালকান্তি বসু, অশোক ঘোষ, বাসুদেব বসু, সুনীল সাহা, অশোক দাস, কিসমত আরা খাতুন, শংকর ঘোষ, সমীর পুততুণ্ডু, অভীক সাহা, জয়তু দেশমুখ, গোবিন্দ রায়, সুভাষ নস্কর, রঙ্গলাল কুমার, সজল অধিকারী, সুশান্ত ঝা, তপন গাঙ্গুলি, সুমিত ভট্টাচার্য প্রমুখ। সমাবেশ থেকে রাজভবনে গিয়ে শ্রমিক কৃষকদের এক প্রতিনিধি দল ডেপুটেশন দেন। এই প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন নিরাপদ সদ্দারম সর্দার আসাদুল্লাহ গায়েনম প্রবীর ব্যানার্জিম বাসুদেব বসুম দীপক দাস এবং অশোক গুহ।