৬১ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ / ১৪ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে বন্দি বিপন্ন শ্রমিকদের জীবনের আলোয় ফেরালেন শ্রমিকরাই
টানেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কোচবিহারের মানিক তালুকদার।
বিশেষ সংবাদদাতাঃ অন্ধকারের আগল ভেঙে অবশেষে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে আটকে পড়া বিপন্ন শ্রমিকদের জীবনের আলো দেখালেন ‘র্যাট হোল’ বিশেষজ্ঞ শ্রমিকরাই। ২৮ নভেম্বর রাত ৮টা থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সিলকিয়ারার সুড়ঙ্গে আটকে থাকা শ্রমিকদের উদ্ধার করে আনলেন ১২জন সুদক্ষ র্যাট মাইনার। তাঁদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতায় ৪১ জন বিপন্ন শ্রমিকের জীবনের অনিশ্চয়তার যেমন অবসান হয়েছে, তেমনি ১৭ দিন ৪২০ ঘণ্টা ধরে এই বিপন্ন শ্রমিকদের আত্মজন ও পরিবারবর্গের পাথরচাপা উৎকণ্ঠা ও সীমাহীন আশঙ্কা কেটে গিয়ে স্বস্তির আস্বাদ মিলেছে। একইসঙ্গে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছেন বিপুল অংশের দেশবাসী। সুড়ঙ্গে আটকদের মধ্যে তিনজন ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের - হুগলির হরিণখোলার সৌভিক পাখিরা, পুড়শুড়ার জয়দেব প্রামাণিক এবং তুফানগঞ্জের মানিক তালুকদার। ভয়ংকর বিপদের কবল থেকে ৪১জন শ্রমিকের জীবনে মুক্তির আলো দেখানোর জন্য প্রবল শীতে দিনরাত এক করে অসংখ্য উদ্ধারকারীর অক্লান্ত পরিশ্রমে যে অসামান্য যুদ্ধ জয় সম্ভব হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম দিশারি সেই ১২ জন সুদক্ষ বিশেষজ্ঞ খনি শ্রমিক। নিঃসন্দেহে এ জয় শ্রমিকের জয়।
এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী মোদির তথাকথিত ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ চারধাম যাত্রার পথকে সুগম করতে সুড়ঙ্গ তৈরি করতে গিয়ে এই ভয়াবহ বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটেছে। ১২ নভেম্বর দীপাবলির দিন সুড়ঙ্গের ভেতর আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক। তারপর থেকে সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারের প্রচেষ্টা শুরু হয়। এলএইচআইডিসিএল, আরভিএনএল, এসজেভিএনএল, টিএইচডিসি, ওএনজিসি’র মতো কেন্দ্রের বিভিন্ন সংস্থাকে সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারের কাজে লাগানো হয়। এই উদ্ধারের কাজে দেশীয় প্রযুক্তির পাশাপাশি আমেরিকা থেকে অত্যাধুনিক ড্রিলিং মেশিনও নিয়ে আসা হয়। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসেন আন্তর্জাতিক সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিস্ক। কিন্তু এই সমস্ত মেশিনও বারে বারে বিকল হওয়ায় উদ্ধারের কাজ পিছিয়ে গেছে।
তবে আশার দিক ছিল এটাই যে, সুড়ঙ্গের গভীরে আটকে থাকা শ্রমিকেরা প্রবল মানসিক চাপে, উৎকণ্ঠায় এবং সুড়ঙ্গের মধ্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন অস্বাস্থ্যকর দমবন্ধ করা ভয়ার্ত পরিবেশে প্রাথমিকভাবে কিছুটা শারীরিক অসুস্থ হয়ে পড়লেও, তা মারাত্মক আকার নেয়নি। উদ্ধারের পর শ্রমিকরাই জানিয়েছেন, প্রাথমিক বিপর্যয়ের ধাক্কা কাটিয়ে তাঁরা তাঁদের মনোবল অটুট রাখতে পেরেছিলেন। এই বিপন্নতার মধ্যেও তাঁরা নিজেদের নিবিড় সখ্যের বন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। যা নিঃসন্দেহে তাঁদের বাড়তি প্রেরণা জুগিয়েছে। এছাড়া বাইরে থেকে পাইপের সাহায্যে শুকনো ও গরম খাবার, ফলমূল, ওষুধপত্র এবং অক্সিজেনের বন্দোবস্ত ছিল। সুড়ঙ্গে ধস নামার আটদিন পরে পাইপের মাধ্যমে এন্ডোস্কোপিক ফ্লেক্সি ক্যামেরা পাঠিয়ে কয়েকজন আটক শ্রমিকের ছবি পরিবারের লোকজনকে দেখানো সম্ভব হয়েছিল।
উদ্ধারের কাজে বারেবারেই বাধা আসছিল। উদ্ধারপর্বের শেষের দিকে অগার মেশিন ভেঙে যাওয়ায় শ্রমিকদের উদ্ধার করা ২৯ নভেম্বরের আগে সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করা হয়। অগার মেশিনের বদলে টানেল খুঁড়তে কাজে লাগানো হয় ‘র্যাট হোল’ বিশেষজ্ঞ শ্রমিকদের। ৪৫ মিটার উঁচু ও প্রায় ৬০ মিটার দীর্ঘ ধস কেটে এগোনোর সময় শেষ দু’মিটারে এসে ফের আটকে গিয়েছিলেন উদ্ধারকারীরা। অবশেষে সেই কাজে সফলতা আসে। ধসের স্তূপের মধ্যে দিয়ে ওপ্রান্তে থাকা শ্রমিকদের কাছে একটি পাইপ লাইন পৌঁছানো সম্ভব হয়। সেই পাইপের মধ্য দিয়েই চাকা-যুক্ত স্ট্রেচারে শুইয়ে দড়ি দিয়ে টেনে একে একে শ্রমিকদের বার করে আনে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। তাঁদের মালা পরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী ধামি এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি কে সিং। উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তাঁদের অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয় চিন্যালিসৌরের হাসপাতালে। তারপর তাঁদের পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয় হৃষীকেশের এমস-এ। এ যেন অনেকটা মেশিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে শ্রমিকের দক্ষতায় জীবন জয়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে দীর্ঘ সময় ধরে পাহাড়ের টানেলে আটকে পড়া ৪১জন শ্রমিক চরম বিপদের মধ্যে ভয়াবহ শঙ্কায় প্রহর গুনছিলেন, তখন বাইরে উত্তরাখণ্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি ক্রমাগত মোদি বন্দনায় মগ্ন ছিলেন। তিনি নিয়ম করে ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত সংবাদমাধ্যমকে শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বার্তা। প্রধানমন্ত্রী সুড়ঙ্গে আটকে শ্রমিকদের জন্য কতটা চিন্তিত তা বোঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। অথচ দেশবাসী লক্ষ করেছেন তখন প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত ছিলেন ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে ভোট প্রচারে। তার মাঝে তিনি আহমেদাবাদ উড়ে এসে নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে বসে সঙ্গী অমিত শাহকে নিয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ উপভোগ করেছেন। অথচ মানবিকতার টানে সিলকিয়ারার টানেল বিধ্বস্ত বিপন্ন শ্রমিকদের উদ্ধার কাজ খতিয়ে দেখার সময় হয়নি তাঁর!
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শুরু থেকে মোদির এই চারধাম প্রকল্প নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চার হিন্দু তীর্থক্ষেত্র - গঙ্গোত্রী, যমুনেত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রীনাথকে একসঙ্গে সড়ক পথে জুড়ে দেবার লক্ষ্যেই এই চারধাম প্রকল্প। সেই লক্ষ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে এই প্রকল্প রূপায়ণের কাজ শুরু হয়। পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বারেবারেই বলেছেন, পাহাড় ও জঙ্গল কেটে যেভাবে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তাতে হিমালয়ের পার্বত্য এলাকা বারেবারেই ভয়ানক বিপদের মধ্যে পড়ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। কিন্তু তাতে কোনো ভাবনা নেই মোদি সরকারের। পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিবাদ ও অভিমতকে নির্বিচারে উপেক্ষা করেই শুধুমাত্র ক্ষমতার নেশায় হিন্দু ভাবাবেগের রাজনীতিকে উসকে দিতে এই প্রকল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে মারাত্মক বিপর্যয়কে ডেকে এনেছে মোদি সরকার।
সুড়ঙ্গে আটকে পড়া বিপন্ন শ্রমিকদের উদ্ধার করার রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মোদি সরকারের সংবিৎ ফিরবে কিনা জানা নেই। হয়ত কয়েকদিনের মধ্যে বিপন্ন শ্রমিকদের উদ্ধারের সাফল্য নিয়েও মোদির জয়গান মুখরিত হবে। এই ঘটনাতেও যদি তারা শিক্ষা না নেয় তবে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল যে ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে - সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে স্তরে ধ্বনিত হয়েছে, তা এখন আরও জোরালো হওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে।
মোদি সরকার ক্ষমতার নেশায় মত্ত হয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিভাজনের রাজনীতির ফায়দা লুটতে এই চারধাম প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এদের প্রায় প্রতিটি উদ্যোগের পিছনেই রয়েছে হিংসাত্মক বিভেদের রাজনীতি ও হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সেই লক্ষ্যেই এরা শ্রমিক, কৃষক সহ শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে চিরন্তন সম্পর্কের বন্ধনকে বিনষ্ট করে বিভাজনের বীজ প্রোথিত করতে উদ্যত। এই উদ্দেশ্যেই করপোরেট বান্ধব এই সাম্প্রদায়িক সরকার শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ওপর নানাভাবে আঘাত নামিয়ে আনছে। অথচ কী অদ্ভুত সমাপতন! পাহাড়ের গুহা-খাদে আটকে থাকা বিপন্ন শ্রমিকদের উদ্ধারে অসাধ্য সাধন করছেন সুদক্ষ খাদান শ্রমিকরা। উদ্ধার কার্যের পর তাঁরা শুনিয়েছেন গুহা-খাদে বন্দি শ্রমিকদের উদ্ধারে তাঁদের অদম্য মনোভাব ও দৃঢ় সংকল্পের কথা। আরও বিস্ময়ের, তাঁরা প্রত্যেকেই দাঙ্গা-বিধ্বস্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লির বাসিন্দা। তাঁদের ১২ জনের মধ্যে ৭ জনই সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের। যে সম্প্রদায়ের প্রতি বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের ঘৃণা ও বিদ্বেষের অন্ত নেই। তাঁদের অন্যতম মুন্না কুরেশি গভীর আত্মচেতনায় শ্রমিক সংহতিতে বলীয়ান হয়ে প্রথম সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে বিপন্ন শ্রমিকদের আলোয় ফেরার বার্তা দিয়ে তাঁদের শঙ্কা মুক্ত করেন এবং তারপরই গুহাবন্দিদের একে একে মুক্তি হয় উন্মুক্ত পরিবেশে জীবনের আলোর বৃত্তে। এক এক অনন্যসাধারণ সন্ধিক্ষণ - হার্দিক মিলনের অসামান্য মুহূর্ত। সেখানে ঘোষিত হয়েছে শ্রমিকদের কঠিন যুদ্ধ জয়ের বার্তা - যেখানে ছিল না কোনো বিদ্বেষ-কলুষ-হিংসার আবহ। শুধুই প্রতিবিম্বিত হয়েছে শ্রমিক সংহতি ও শ্রমিক চেতনার ছবি, প্রতিধ্বনিত হয়েছে শ্রমিকের জয়গান।