E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ / ১৪ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে

ফ্রেডারিক এঙ্গেলস


কিছু কিছু সমাজতন্ত্রী, যাকে তাঁরা বলেন কর্তৃত্বের নীতি, তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি রীতিমতো জেহাদ শুরু করে দিয়েছেন। কোনো একটা কাজ কর্তৃত্বমূলক এটুকু বললেই তাঁরা সে কাজের নিন্দা করবেন। চটপট রায়-দানের এই পদ্ধতির এতদূর অপপ্রয়োগ হয় যে ব্যাপারটা সম্পর্কে একটু খুঁটিয়ে অনুসন্ধান করা দরকার হয়ে পড়েছে। যে অর্থে কর্তৃত্ব কথাটি এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে তার মানে দাঁড়ায়ঃ আমাদের ইচ্ছার উপর আরেকজনের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া; অন্যদিকে, কর্তৃত্ব বলতে বশ্যতাও ধরে নেওয়া হয়। শব্দ দুটি অবশ্য শুনতে খারাপ; আর বশীভূত পক্ষের কাছে সম্পর্কটাও অপ্রীতিকর, তাই প্রশ্ন হলো যে, এর হাত থেকে নিষ্কৃতির কোনো উপায় নির্ধারণ করা যায় কীনা, বর্তমান সমাজব্যবস্থার পরিবেশে এমন আরেকটা সমাজ-ব্যবস্থা গড়া যায় কীনা যেখানে এই কর্তৃত্বের আর কোনো দরকার থাকবে না, সুতরাং কর্তৃত্বের অবসান হবে। আজকের দিনের বুর্জোয়া সমাজ যে সব অর্থনৈতিক, শিল্পগত ও কৃষিগত অবস্থার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সেগুলি পরীক্ষা করলে আমরা দেখি যে, তাদের ঝোঁকই হলো বিচ্ছিন্ন কাজের বদলে ক্রমশ আরও বেশি করে নানা লোকের মিলিত কাজের প্রবর্তন। স্বতন্ত্র উৎপাদকদের ছোটো ছোটো কর্মশালার বদলে এসেছে আধুনিক শ্রমশিল্প তার বড়ো বড়ো ফ্যাক্টরি ও মিল নিয়ে, সেখানে শত শত শ্রমিক বাষ্পচালিত জটিল যন্ত্রপাতির তত্ত্বাবধান করছে। রাজপথের গাড়ি ও শকটের জায়গায় এসেছে রেলওয়ে ট্রেন, ঠিক যেমন দাঁড়ওয়ালা অথবা পালতোলা জাহাজের স্থান নিয়েছে বাষ্পচালিত জাহাজ। এমন কী কৃষির উপরও যন্ত্র ও বাষ্পের আধিপত্য ক্রমশ বাড়ছে, ধীরে ধীরে অথচ অনিবার্যভাবে ছোটো মালিকদের জায়গায় তা এনে দিয়েছে বড়ো বড়ো পুঁজিপতি; ভাড়াটে মজুরদের সাহায্যে তারা বিপুল আয়তনে জমি চাষ করছে। সর্বত্র ব্যক্তির স্বতন্ত্র কার্যকলাপের বদলে আসছে যুক্ত প্রচেষ্টা, পরস্পরের উপর নির্ভরশীল নানা প্রক্রিয়ার জটিলতা। কিন্তু যুক্ত কাজের কথা তুললেই সংগঠনের কথা বলতে হয়; কিন্তু কর্তৃত্ব ছাড়া কি সংগঠন সম্ভব?

ধরা যাক, যে পুঁজিপতিরা আজ সম্পদের উৎপাদন ও সঞ্চালনের উপর কর্তৃত্ব করছে, তারা এক সমাজ-বিপ্লবের ফলে গদিচ্যুত হলো। কর্তৃত্ব বিরোধীদের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করার উদ্দেশে ধরে নেওয়া যাক যে, জমি ও শ্রমের হাতিয়ারপত্র ব্যবহারকারী শ্রমিকদেরই যৌথ সম্পত্তি হয়ে গেল। তাহলেই কি কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে, না, শুধু তার রূপেরই কেবল পরিবর্তন ঘটবে? কথাটা আলোচনা করে দেখা যাক।

উদাহরণ হিসাবে একটা সুতো-কাটার মিলের কথা ধরা যাক। সুতোয় পরিণত হওয়ার আগে তুলোকে অন্ততপক্ষে ছটি ক্রমিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে আর প্রত্যেকটি প্রক্রিয়াই প্রধানত হচ্ছে আলাদা আলাদা ঘরে। তাছাড়া যন্ত্রপাতি চালু রাখার জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন যে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের দেখাশোনা করবে, কয়েকজন মিস্ত্রি প্রয়োজন যারা করবে চলতি মেরামতের কাজ, আরও অনেক শ্রমিক প্রয়োজন যাদের কাজ হবে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে উৎপন্ন দ্রব্য নিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি। এইসব শ্রমিকের, পুরুষ নারী ও শিশু নির্বিশেষে, কাজ শুরু ও শেষ করতে হবে বাষ্পের কর্তৃত্ব অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে; সে কর্তৃত্ব কোনো ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না। সুতরাং শ্রমিকদের প্রথমেই কাজের ঘণ্টা সম্পর্কে একটা সমঝোতায় আসতে হবে; আর একবার ঘণ্টা নির্ধারিত হয়ে গেলে পর প্রত্যেককেই তা মেনে চলতে হবে বিনা ব্যতিক্রমে। তারপর প্রতি ঘরে প্রতি মূহূর্তেই উৎপাদন-পদ্ধতি, মালমশলার বণ্টন প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ প্রশ্ন ওঠে; সে সব প্রশ্নের সমাধান অবিলম্বে করতে হয় নইলে সমস্ত উৎপাদন তখনই বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমের প্রতিটি শাখার শীর্ষে অধিষ্ঠিত একজন প্রতিনিধির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সে সমাধান হোক, বা সম্ভব হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট অনুসারেই সমাধান হোক, ব্যক্তিবিশেষের মতকে সর্বদাই মাথা নত করতে হয়। তার মানেই হলো প্রশ্নগুলির সমাধান হচ্ছে কর্তৃত্বের জোরে। শ্রমিক-নিয়োগকারী ছোটো পুঁজিপতিরা যতটা স্বেচ্ছাচারী হতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি স্বেচ্ছাচারী হলো বড়ো কারখানার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি। অন্ততপক্ষে কাজের ঘণ্টা সম্পর্কে' এইসব কারখানার প্রবেশপথে লিখে রাখা যায়ঃ Lasciate ogni autonomia voi che entrate! (যারা এখানে প্রবেশ করছ তারা পিছনে ফেলে এসো সব স্বাতন্ত্র্য।) মানুষ যদি নিজের জ্ঞান ও উদ্ভাবনী প্রতিভার সাহায্যে প্রকৃতির শক্তিকে জয় করে থাকে, তাহলে সে শক্তি মানুষের উপর এইভাবে প্রতিশোধ নেয় যে মানুষ যেখানে তাকে নিয়োগ করে সেখানে সে মানুষকে এমনই এক খাঁটি স্বেচ্ছাচারের অধীন করে ফেলে যা সকল সামাজিক সংগঠনের ঊর্ধ্বে। বৃহদায়তন শিল্পে কর্তৃত্ব লোপ করতে চাওয়ার মানে হলো শিল্পকেই বিলুপ্ত করার ইচ্ছা, সুতোকাটার চরকায় ফিরে যাওয়ার জন্য বাষ্পচালিত তাঁতযন্ত্র ভেঙে ফেলার ইচ্ছা।

আরেকটা উদাহরণ নেওয়া যাক - রেলপথ। এখানেও অসংখ্য ব্যক্তির সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন, আর যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে তার জন্য এই সহযোগিতা চালাতে হয় কাঁটায় কাঁটায় নির্ধারিত সময়ে। এখানেও কাজের প্রথম শর্ত হলো, এমন এক অধিপতি ইচ্ছা যা সব অধস্তন প্রশ্নের সমাধান করে দেয় - তা সে ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব একজনমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিই করুক বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত কাজে পরিণত করার ভারপ্রাপ্ত একটি কমিটিই করুক। উভয় ক্ষেত্রেই কর্তৃত্বের অস্তিত্বটা খুবই স্পষ্ট। উপরন্তু মহামান্য যাত্রীদের ওপর রেলকর্মীদের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হলে প্রথম যে ট্রেন ছাড়া হবে তার অবস্থা কী দাঁড়াবে?

কিন্তু কর্তৃত্বের প্রয়োজনীয়তা, এমনকী উদ্ধত কর্তৃত্বের প্রায়ায়নীয়তা, উত্তাল সমুদ্রে জাহাজের উপরে যতটা স্পষ্ট ততটা আর কোথাও নয়। যেখানে বিপদের মুহূর্তে সকলের জীবন নির্ভর করে একজনের ইচ্ছা অবিলম্বে ও পুরোপুরিভাবে প্রত্যেকে মেনে নেওয়ার উপর।

যখনই উগ্রতম কর্তৃত্ববিরোধীদের সামনে আমি এই ধরনের যুক্তি পেশ করি, তখন তারা একমাত্র নিম্নোক্ত উত্তরই দিতে পারেঃ 'হ্যাঁ, এ সব সত্যি, কিন্তু আমাদের প্রতিনিধিদের উপর এখানে আমরা যা অর্পণ করছি তা কর্তৃত্ব নয়, সে হলো অর্পিত কাজের ভার মাত্র।' এই সব ভদ্রমহোদয়রা মনে করেন যে নাম বদলেই তাঁরা আসল জিনিসটাও বদলে ফেলেছেন। এ ধরনের মহা-মনীষীরা সমগ্র পৃথিবীকে এইভাবেই ব্যঙ্গ করে থাকেন।

সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে একদিকে কিছুটা কর্তৃত্ব, তা সে যেভাবেই অর্পিত হোক না কেন, আর অন্যদিকে কিছুটা বশ্যতা হলো এমন জিনিস যা সকল সামাজিক সংগঠন নির্বিশেষে আমাদের উপর চাপানো থাকে যে বাস্তব অবস্থায় আমরা উৎপাদন আর উৎপন্ন দ্রব্যের সঞ্চালন করি তার সঙ্গে সঙ্গেই।

আমরা এটাও দেখেছি যে বৃহদায়তন শিল্প ও বিপুলাকার কৃষির সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উৎপাদন ও সঞ্চালনের বৈষয়িক অবস্থারও বিকাশ ঘটে, এবং তার ঝোঁক ক্রমশ এই কর্তৃত্বের পরিসর বাড়িয়ে দেবার দিকে। সুতরাং কর্তৃত্বের নীতিকে পুরোপুরিভাবে খারাপ আর স্বাতন্ত্র্যের নীতিকে পুরোপুরিভাবে ভালো বলাটা অর্থহীন। কর্তৃত্ব ও স্বাতন্ত্র্য হলো আপেক্ষিক বস্তু সমাজের বিকাশের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে এদের আওতার পার্থক্য ঘটে। স্বাতন্ত্র্যবাদীরা যদি শুধু এইটুকুই বলে সন্তুষ্ট থাকত যে উৎপাদনের শর্তাবলির ফলে যতটা অনিবার্য’ হয়ে ওঠে শুধু সেই সীমার মধ্যেই কর্তৃত্বকে সীমিত করে রাখবে ভবিষ্যতের সামাজিক সংগঠন, তাহলে আমরা পরস্পরকে বুঝতে পারতাম। কিন্তু যে সব ঘটনার দরুন কর্তৃত্ব জিনিসটা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে সে সম্পর্কে' তারা সম্পূর্ণ অন্ধ, অথচ শব্দটার বিরুদ্ধে তারা তীব্র আবেগের সঙ্গে লড়ে চলে।

কর্তৃত্ববিরোধীরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোয় সীমাবদ্ধ থাকে না কেন? সব সমাজতন্ত্রী এ বিষয়ে একমত যে আগামী সমাজবিপ্লবের ফলে রাজনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, আর তার সঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে; অর্থাৎ সরকারি কার্যকলাপের রাজনৈতিক চরিত্র বিলুপ্ত হবে আর তা পরিণত হবে সমাজের প্রকৃত স্বার্থ দেখাশোনা করার সরল ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু কর্তৃত্ববিরোধীরা দাবি করে যে, যে-সামাজিক পরিস্থিতির ফলে কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছিল তার বিলোপ সাধনের আগেই এক আঘাতেই সেই রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করতে হবে। তারা দাবি করে যে সমাজবিপ্লবের প্রথম কাজই হবে কর্তৃত্বের বিলোপ সাধন। এই ভদ্রমহোদয়রা কি কখনও কোনো বিপ্লব দেখেছেন? কর্তৃত্বমূলক যত ব্যাপার আছে তার মধ্যে নিশ্চয়ই সবচেয়ে কর্তৃত্বপ্রধান হলো বিপ্লব। বিপ্লব হলো এমন এক কর্ম যাতে জনসংখ্যার এক অংশ কর্তৃত্বাশ্রয়ী উপায় আদৌ যা আছে সেই বন্দুক, বেয়নেট ও কামানের মাধ্যমে জনসংখ্যার অপর অংশের উপর নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়। আর বিজয়ী দল যদি নিজেদের সংগ্রাম ব্যর্থ হতে দিতে না চায় তাহলে তাদের নিজেদের শাসন বজায় রাখতে হবে অস্ত্রের সাহায্যে প্রতিক্রিয়াশীলদের মনে ভীতি সঞ্চার করেই। বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সশস্ত্র জনগণের এমন কর্তৃত্ব কাজে না লাগালে কি প্যারিস কমিউন একদিনও টিকতে পারত? বরং সে কর্তৃত্ব যথেষ্ট অসংকোচে প্রয়োগ না করার জন্যই কি তাকে আমাদের তিরস্কার করা উচিত নয়?

সুতরাং দুটোর একটাঃ হয় কর্তৃত্ববিরোধীরা জানে না তারা কী বলছে, সে ক্ষেত্রে তারা সৃষ্টি করছে শুধু বিভ্রান্তি; নয়তো তারা কী বলছে জানে, আর সে ক্ষেত্রে তারা প্রলেতারিয়েতের আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। উভয় ক্ষেত্রেই অবশ্য তারা সাহায্য করছে প্রতিক্রিয়াকেই।


[১৮৭২ সালের অক্টোবর মাসে এঙ্গেলসের লেখা। ১৮৭৪ সালের 'Almanacco Repubblicano' সঙ্কলনে প্রকাশিত। সঙ্কলনের পাঠ অনুযায়ী মুদ্রিত। ইতালীয় থেকে অনুবাদের ভাষান্তর।]