৬১ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ / ১৪ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
আমার প্রতিরোধের আগুন, দ্বিগুণ জ্বলে যেন, দ্বিগুণ দারুণ প্রতিশোধে...
রাহুল ঘোষ
মহিলা আন্দোলনের কর্মীদের ত্রাণ দিতে বাধা পুলিশের।
জয়নগরের বামনগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের এক অখ্যাত গ্রাম দলুয়াখাকির নাম ক’দিন আগে পর্যন্ত কেউই প্রায় জানত না। সেই দলুয়াখাকি এখন সংবাদ শিরোনামে। তৃণমূল দুষ্কৃতীদের পাশবিক তাণ্ডব, মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে পুকুরের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাঁদের জান্তব উল্লাস, গরিব মানুষের জ্বলন্ত বাড়ি থেকে ওঠা ধোঁয়ার কুণ্ডলী, অসহায় নারী-শিশুর আর্তনাদ আর চোখের জল, সর্বস্বান্ত নিঃস্ব মানুষের হাহাকার - সব দেখে শিউরে উঠেছে রাজ্যের মানুষ। অর্থ আর ক্ষমতালোলুপ তৃণমূল নামক রাজনৈতিক দানবের জিঘাংসা বগটুইয়ে শেষ হয়ে যায়নি, সারা রাজ্যই যে একই বিপদের সম্মুখীন - দলুয়াখাকির ঘটনা তাই প্রমাণ করল।
সাইফুদ্দিন শেখ। তৃণমূল কংগ্রেসের বামনগাছি অঞ্চলের সভাপতি। ২০১১সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেও ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামনগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের মানুষ আগের মতোই বামপন্থীদের প্রতি তাঁদের দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছিলেন। ওই পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠন করেছিল সিপিআই(এম)। তৃণমূল কংগ্রেস তা সহ্য করবে কেন? একটা গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতা মানে কোটি কোটি টাকা, সর্বত্র দখলদারি, সীমাহীন লুঠের লাইসেন্স। যে করে হোক পঞ্চায়েত দখলের ষড়যন্ত্রে শামিল হলো তৃণমূল কংগ্রেস আর পুলিশ-প্রশাসন। সরকারি আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে চতুর্দিকের সমাজ বিরোধী দুষ্কৃতীদের জড়ো করে এই গুরুদায়িত্ব পালনের তাগিদেই যাত্রা শুরু সাইফুদ্দিনের। নির্বাচিত সদস্যদের একাংশ বাধ্য হলেন অস্ত্র আর পুলিশের চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করে তৃণমূলের ঝান্ডা ধরতে। পঞ্চায়েতে তৈরি হলো অচলাবস্থা। এভাবেই চলে বেশ কিছুদিন। চলে আসে ২০১৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচন। এবারে আর কোনো ঝুঁকি নেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে সাইফুদ্দিনের নেতৃত্বে সমাজবিরোধী আর পুলিশের জোট দখল করে বামনগাছি পঞ্চায়েত। এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সাইফুদ্দিনের একচ্ছত্র ক্ষমতা। দলীয় নেতাদের একাংশ আর পুলিশের সাহায্যে তা সম্প্রসারিত হয় জয়নগর-কুলতলি জুড়ে। তিন-তিনটি থানার ডাকমাস্টার, চোলাই মদ আর সাট্টার ঠেক, মাটির ব্যবসা, ইটখোলা... সর্বত্র তোলা আদায়। বেআইনি রোজগারের সমস্ত পথেই তাঁর অনায়াস বিচরণ। মাত্র ৫-৬ বছরেই লুঠের টাকায় রকেটের গতিতে সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বখরার লড়াইয়ে দ্রুত বাড়ছিল দলের মধ্যে শত্রুর সংখ্যাও। এরই পরিণতিতে ১৩ নভেম্বর ভোরে প্রাণ হারাতে হলো দোর্দন্ডপ্রতাপ সাইফুদ্দিন শেখ-কে। কারা মারল? এ আর এখন লাখ টাকার প্রশ্ন নয়। সারা রাজ্যে যা ঘটছে এখানেও তারই পুনরাবৃত্তি। সাইফুদ্দিন খুনের ঘটনাস্থলেই পিটিয়ে মারা হলো সাহাবুদ্দিন শেখ-কে। টেলিভিশনের পর্দায় নিহত সাহাবুদ্দিন শেখের স্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বললেন যে, “আমার স্বামী তৃণমূল কর্মী ছিলেন”। খুনীদের সঙ্গী আহত সাহরুল শেখ সংবাদমাধ্যমে আসল মাথা হিসাবে যাদের নাম বলল তাঁদেরকেও এখনো অজ্ঞাত কারণে গ্রেফতার হয়নি। মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়না যে কারা সাইফুদ্দিনের আসল খুনী।
দলুয়াখাকি গ্রামে তৃণমূলীদের নারকীয় তাণ্ডবের চিত্র। (১)
দলুয়াখাকি গ্রামে তৃণমূলীদের নারকীয় তাণ্ডবের চিত্র। (২)
এর পরই নিজেদের অপরাধ আড়াল করে সিপিআই(এম)’র ওপর ঘটনার দায় চাপাতে সংগঠিতভাবে বেছে বেছে আক্রমণ করা হলো পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের অস্ত্র আর টাকার কাছে আত্মসমর্পণ না করা দলুয়াখাকি গ্রামের সিপিআই(এম) কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি। ভয়াবহ অগ্নিসংযোগে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত ২২টি বাড়ি, নির্বিচারে লুঠতরাজ আর ভাঙচুরের শিকার আরও ৯টি বাড়ি। সব ঘটনাই ঘটেছে পুলিশের সামনে। পরে চাপে পড়ে মাত্র তিনজনকে গ্রেফতার করেই দায় সেরেছে পুলিশ। অথচ বেশিরভাগ দুষ্কৃতী ও আসল মাথারা এখনো সবার চোখের সামনে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। নিরাশ্রয় সর্বস্বান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কেউ যাতে ওই মানুষগুলির কাছে ত্রাণ না পৌঁছে দিতে পারে তৃণমূলের নির্দেশে তার ব্যবস্থাই করেছিল পুলিশ ও প্রশাসন। সবাই জানেন যে, ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য হাইকোর্টে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করে তবেই অনুমতি আদায় করতে হয়েছে। এতটাই অমানবিক এবং দলদাস মমতা ব্যানার্জির প্রশাসন। অথচ এই পুলিশ-প্রশাসনই বিজেপি নেতাদের খাতির-যত্ন করে আদালতের নির্দেশ ছাড়াই প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে।
তৃণমূল সংগঠিত দুষ্কৃতীদের লাগানো সর্বগ্রাসী আগুন দলুয়াখাকির মানুষের বাড়ি-ঘর সব কিছু ভস্মীভূত করে এখন নিভে গেছে। এত করেও মাথা নোয়ানো যায়নি দলুয়াখাকির মানুষের। ফিরিয়ে দিয়েছেন আত্মসমর্পণের বিনিময়ে তৃণমূলের সাহায্যের প্রস্তাব। ধ্বংসস্তূপের ওপর মানুষের সম্মিলিত শক্তি আর সাহায্যে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরিয়ে আনতে শুরু হয়েছে নতুন সংগ্রাম। নতুন আগুন জ্বলছে দলুয়াখাকির খেটে খাওয়া মানুষের চেতনায়। শাসকের চোখে চোখ রেখে দলুয়াখাকির মা-বোনেরা ঘোষণা করেছেন যত আক্রমণই আসুক না কেন মানুষ হিসাবে তাঁরা মাথা উঁচু করেই বাঁচাবেন। শপথ নিয়েছেন লালঝান্ডা হাতে সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে এই দুষ্কৃতীরাজের অবসান ঘটানোর।