৫৮ বর্ষ ২০শ সংখ্যা / ১ জানুয়ারি ২০২১ / ১৬ পৌষ ১৪২৭
কৃষি আইন বাতিল করোঃ সীতারাম ইয়েচুরি
সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি পুনরায় নতুন কৃষি আইন বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং কৃষক সংগঠনগুলির ৩০ ডিসেম্বরের বৈঠক আবার মূল বিষয়গুলির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই বিষয়গুলির সমাধানের দাবি নিয়ে অভূতপূর্ব কিষান প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহার করতে কেন্দ্রীয় সরকার অস্বীকার করেছে। কিন্তু আপাতভাবে বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল পুনর্বিবেচনা করতে এবং দূষণ আইন কৃষকদের ওপর প্রয়োগ না করতে সম্মত হয়েছে। ২০২১-এর ৪ জানুয়ারি আরও একবার বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই তিনটি কৃষি আইন বাতিল করার ক্ষেত্রে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় সরকার যে একগুঁয়েমি দেখিয়ে চলেছে, তারফলে এই চলতি ব্যাপক শান্তিপূর্ণ কৃষক প্রতিবাদের কোনো সমাধান হচ্ছে না বলে ইয়েচুরি অভিযোগ করেছেন।
তিনি বলেছেন, দিল্লি সীমান্তে সমস্ত জাতীয় সড়কগুলি কৃষকদের সমাবেশে পূর্ণ হয়ে আছে এবং সেই সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দাবি আদায়ে কৃষকরা আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হচ্ছেন। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরাখণ্ড ইত্যাদি দূরবর্তী রাজ্যগুলিসহ দিল্লি রাজ্যের আশেপাশের কৃষকেরাও এই সমাবেশে যুক্ত হচ্ছেন। দেশের প্রত্যেক রাজ্যেই কৃষকেরা তাদের প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করছেন। পাটনা থেকে রায়পুর, আবার গুলবর্গা থেকে তাঞ্জাভুর কৃষক প্রতিবাদে মুখর।
শ্রমিকশ্রেণি এবং তাদের ট্রেড ইউনিয়নসমূহ কৃষকদের এই সংগ্রামের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। মহিলা, ছাত্র-যুব সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ দেশের অন্নদাতা এই কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন।
ইয়েচুরি বলেছেন, কৃষকদের এই দাবি সমূহ অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তববাদী। যে কোনো সরকারেরই এগুলো স্বীকার করে নেওয়া উচিত। বদলে মোদী সরকার তাদের দায়িত্ব এড়াতে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন বাতিল করে দিয়েছে। সরকারের উচিত ছিল এই আইনের সাথে সম্পর্কিত কৃষক এবং কৃষি ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত অন্যান্যদের সাথে এবং কর্পোরেটদের সাথে আলোচনা করেই সংসদে এই নতুন আইন নিয়ে আসা। তাহলে এনিয়ে সংসদে আলোচনা ও বিতর্কের অবকাশ থাকত। কিন্তু মোদী সরকার তা করেনি।
ইয়েচুরি অভিযোগ করেছেন, এই প্রবল শীতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ এই ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ কৃষক প্রতিবাদকে বদনাম করতে প্রধানমন্ত্রী মোদী জঘন্য মিথ্যা তত্ত্ব প্রচার করছেন। প্রতিবাদকারীদের খালিস্তানি, পাকিস্তানি, চিনা এজেন্ট, শহুরে নকশাল, টুকরে টুকরে গ্যাং ইত্যাদি বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী প্রচার করছেন বিরোধী দলগুলি কৃষকদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হলো, সারা দেশের ৫০০-র বেশি কৃষক সংগঠনকে নিয়ে গঠিত সংযুক্ত কিষান মোর্চা এই সংগ্রাম পরিচালিত করছে। এর সাথে কোনো রাজনৈতিক দল যুক্ত নয়।
সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, আমাদের দল সিপিআই(এম) সর্বদাই অন্যান্য দলের মতো কৃষি সংস্কার চেয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা কী ধরনের সংস্কার চেয়েছি? সিপিআই(এম) চেয়েছে, ভারতের খাদ্য সুরক্ষা যাতে আরও সুরক্ষিত হয়, আমাদের দেশের জনগণ যাতে সঠিক পুষ্টি পায় তারজন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য উৎপাদন, কৃষকেরা যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় এবং দেশের গণবণ্টন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে দেশের মানুষ যাতে ন্যায্য মূল্যে খাদ্যশস্য কিনতে পারে। কিন্তু নতুন আইনে যা করা হচ্ছে তাতে করে ভারতীয় কৃষি, তার বাজার এবং উৎপন্ন ফসল সব কিছুই বহুজাতিক বৃহৎ কৃষি বাণিজ্য সংস্থা, বিদেশি এবং দেশীয় কর্পোরেট সংস্থার কুক্ষিগত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রীর ব্যাপক মজুরদারিতে অনুমতি দেওয়া হবে। ফলে কৃত্রিম খাদ্যাভাব তৈরি হবে। এর সার্বিক পরিণতিতে মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া হবে, গণবণ্টন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবে এবং খাদ্যশস্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে না।
ইয়েচুরি অভিযোগ করেছেন, এই তিন কৃষি আইন ভারতীয় কৃষিকে ধ্বংস করে জনগণের দুর্দশাকে আরও চরম করে তুলবে। সেই কারণেই অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দল এই আইনগুলির তীব্র বিরোধিতা করছে। কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করছে। সরকারের কাছে তারা আহ্বান জানাচ্ছে এই দাবিগুলি মেনে নেওয়া হোক এবং কৃষি আইনের এমন সংস্কার করা হোক যাতে ভারতীয় জনগণের সমৃদ্ধি এবং কল্যাণ হয় এবং যাতে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলি অতিমুনাফা না করতে পারে।
তিনি আরও অভিযোগ করেছেন, কৃষকদের এই ব্যাপক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-আন্দোলন থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্র করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ সরকার লাভজিহাদ আইন জারি করেছে এবং জনগণের একাংশকে নাজেহাল করতে, ভয় দেখাতে এবং সাম্প্রদায়িক আবেগ তৈরি করতে গো-রক্ষা আইনকে ব্যবহার করছে।
সীতারাম ইয়েচুরি দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, বিজেপি সরকারের নীতি সমূহের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান গণসংগ্রাম আরও তীব্র হয়ে উঠবে। বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামগুলি চলছে, মহিলা-ছাত্র-যুব-দলিত-আদিবাসী ইত্যাদি সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ, তাদের স্বাধীন দাবি-দাওয়া নিয়ে সংগ্রাম গড়ে তুলছে। আগামী দিনে তা নিশ্চিতভাবেই সুতীব্র হয়ে উঠবে। ভারতীয় জনগণের বিরুদ্ধে বিজেপি তাদের শ্রেণি আক্রমণ তীব্র করার চেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের শোষিত শ্রেণিসমূহ এবং জনগণের অন্যান্য অংশ পালটা প্রতিস্পর্ধী শ্রেণি আন্দোলনকে তীব্র করে বিজেপি’র আক্রমণকে অবশ্যই প্রতিরোধ করবে।