৫৮ বর্ষ ২০শ সংখ্যা / ১ জানুয়ারি ২০২১ / ১৬ পৌষ ১৪২৭
কৃষক নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে আংশিক দাবি মানল সরকার
পরবর্তী বৈঠক ৪ জানুয়ারি
গাজিপুরে কৃষক বিক্ষোভ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কৃষক আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের ষষ্ঠ দফার বৈঠক কিছুটা ইতিবাচক হলেও মূল দুই দাবির ফয়সালা হয়নি। তিন কৃষি আইন বাতিল এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার আইনি স্বীকৃতি নিয়ে পরবর্তী বৈঠক হবে ৪ জানুয়ারি। ৩০ ডিসেম্বরের বৈঠকে আন্দোলনকারীদের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দাবি মেনে নিয়েছে সরকার। এই দুই দাবি হলো, দিল্লি এবং সংলগ্ন অঞ্চলে খড় পোড়ানোর জন্য কৃষকদের শাস্তি দেওয়া যাবে না এবং স্থগিত থাকবে বিদ্যুৎ বিল-২০০০।
এদিন আলোচনা শেষে সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক হান্নান মোল্লা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগের পাঁচ বারের তুলনায় এদিনের আলোচনা ইতিবাচক হয়েছে। আংশিক সাফল্য মিলেছে। তবে প্রধান দুই দাবি, তিন কৃষি আইন বাতিল এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার আইনি স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত জারি থাকবে আন্দোলন।
তিনি জানিয়েছেন, দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে ট্রাক্টর মিছিলের কর্মসূচি আপাতত স্থগিত থাকলেও ১ জানুয়ারি কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে দেশের লক্ষাধিক জায়গায় শপথ পাঠ হবে। হান্নান মোল্লা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ৪ জানুয়ারির বৈঠকে সরকার ফয়সালায় রাজি না হলে দিল্লিতেই হবে ট্রাক্টর মিছিল।
এদিনের বৈঠকে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর, রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল এবং বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী সোমপ্রকাশ উপস্থিত ছিলেন। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, কৃষকদের দাবির অর্ধেক অংশের নিরসন হয়েছে। পঁয়ত্রিশদিন ধরে দিল্লির সীমান্তে প্রবল ঠান্ডায় অবস্থান বিক্ষোভ আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ থেকেছে, তা মেনে নিয়েছেন তিনি। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, তিন কৃষি আইন এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে আলোচনা জারি রয়েছে। সরকার খোলা মনে কৃষকদের বক্তব্য শুনতে তৈরি বলে তিনি দাবি করেন।
এর আগে যে পাঁচ দফার বৈঠক হয়েছে তাতে সরকারের ভূমিকায় তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করেছিল কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ সংযুক্ত কিষান মোর্চা। সরকার কৃষকদের মূল দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে নিজেদের বক্তব্য চাপিয়ে দিতে তৎপর ছিল। আলোচনা জারি থাকলেও বাইরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি বাহিনী ও মন্ত্রীরা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।ভুল তথ্য দিয়ে এবং মিথ্যা প্রচার চলছে। এই অবস্থায় প্রতিদিন আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে। প্রথমে সরকার এই আন্দোলনকে কেবলমাত্র পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা কেন্দ্রীক বলে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু দেখা গিয়েছে উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এমনকি মহারাষ্ট্র থেকেও দল বেঁধে এসেছেন কৃষকেরা। সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর, শাহজাহানপুর প্রভৃতি দিল্লি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কৃষকরা প্রবল ঠান্ডার মধ্যে খোলা আকাশের নিচে, ট্রাক্টর, লরি প্রভৃতি যানবাহনে খড় বিছিয়ে রয়েছেন। সেখানেই চলছে লঙ্গরখানা। কয়েকলক্ষ কৃষকের এই হার না মানা লড়াকু মনোভাব সরকারকে ভাবতে বাধ্য করেছে।
কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা ৩০ ডিসেম্বর জানান, কৃষিমন্ত্রী তোমর এদিন কৃষকদের বক্তব্য জানাতে বলেন। কৃষকরা বলেন, চারটি দাবি নির্দিষ্ট করে জানানো হয়েছে আগেই। এদিন সেই চারটি দাবিতেই বৈঠক নির্দিষ্ট করা হয়। এরপর মন্ত্রীরা সরকারের বক্তব্য তুলে ধরেন। কৃষিমন্ত্রী বলেন, সরকারের সমস্যা আপনারা বুঝুন। আলোচনা হোক। কৃষক প্রতিনিধিরা বলেন, আমরা তো খোলা মনে কথা শুনতে রাজি। কিন্তু কৃষি বিল বাতিলের দাবি থেকে সরে আসার প্রশ্ন নেই। মন্ত্রীরা তখন জানান, তিন আইন বাতিল করতে এখনই প্রস্তুত নয় সরকার। আপনারা সংশোধনী দিন। এর বাইরে বিকল্প প্রস্তাব থাকলে জানান। কৃষক নেতৃবৃন্দ জানিয়ে দেন, আলোচনায় রাজি। কিন্তু কৃষি বিল বাতিল করতে হবে।
বৈঠকে সহায়ক মূল্য প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী বলেন, সহায়ক মূল্য এখন যেভাবে চালু রয়েছে সেভাবেই থাক। সহায়ক মূল্যে সরকারি ফসল সংগ্রহ ব্যবস্থা চালু থাকার লিখিত আশ্বাস দেবে সরকার। কৃষক নেতৃবৃন্দ মন্ত্রীদের বলেন, কেন বারবার লিখিত আশ্বাসের কথা বলা হচ্ছে। চালু ব্যবস্থাতেই অনেকে সহায়ক মূল্যের কমে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। নতুন তিন কৃষি আইনে এই ব্যবস্থা কার্যত লোপাট করা রয়েছে। সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছিল এম এস স্বামীনাথন কমিশনই। সরকারের তাতে আপত্তি কেন? কৃষক নেতৃবৃন্দ জানতে চান, আইনে অধিকারের নীতিগত সম্মতি থাকার ঘোষণা করতে পারে কি সরকার? কৃষিমন্ত্রী বলেন, কৃষকদের কাছে নিশ্চিত সহায়ক মূল্য কতটা জরুরি আমরা বুঝি। কিন্তু এমন নীতিগত সম্মতির ঘোষণা করা এখন সম্ভব নয়।
আলোচনার মধ্যে কৃষিমন্ত্রী কৃষক নেতাদের বলেন, অবস্থানে বয়স্ক, শিশু, মহিলাদের দেখা যাচ্ছে। তাদের বাড়ি পাঠানোর অনুরোধ জানান তিনি। কৃষক নেতৃবৃন্দ সেই অনুরোধ সরাসরি খারিজ করে দেন। হান্নান মোল্লা বলেন, আমরা মন্ত্রীদের জানিয়েছি ফেরা তো দূরের কথা। নতুন নতুন এলাকা থেকে পরিবারের বয়স্ক, মহিলারা দল বেঁধে আসছেন। নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে আন্দোলন। দাবি না মানলে গোটা দেশে দিল্লির মতো অবস্থা হবে।
কেন্দ্র তিন কৃষি আইন পাশ করিয়েছে। এই আইনে নিয়ন্ত্রিত বাজারের বাইরে ফসল কেনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্পোরেটদের সঙ্গে চুক্তিচাষ অবাধ করেছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন করে ডাল, ভোজ্যতেল, দানাশস্য, আলু, পেঁয়াজের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছে। এই আইন এনে সরকারের বক্তব্য ছিল, কৃষকদের স্বাধীনতার জন্য এই আইন। এর প্রতিবাদে কৃষক নেতারা বলেন, এই আইন কর্পোরেটদের সস্তায় ফসল কেনার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত বাজার তুলে দিয়ে সরকারি দামে ফসল বিক্রির যেটুকু ব্যবস্থা আছে তাও তুলে দেবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই আইনে কৃষকভিত্তিক কৃষির পরিবর্তে কর্পোরেটভিত্তিক কৃষিতে পরিবর্তন করার ব্যবস্থা হয়েছে। সরকারের এই নতুন কৃষি আইনে কৃষি ও কৃষকদের চূড়ান্ত সর্বনাশ করা প্রতিরোধ করতেই দেশব্যাপী শুরু হয়েছে কৃষক আন্দোলন। যতদিন যাচ্ছে এই আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ছে।