E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২০শ সংখ্যা / ১ জানুয়ারি ২০২১ / ১৬ পৌষ ১৪২৭

প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিহীন অভিযোগের জবাব দিলেন কৃষকেরা


গাজিপুরে কৃষক বিক্ষোভে মহিলারা।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ২৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মন কি বাত’-এর নামে মিথ্যার বেশাতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে কৃষকেরা থালা-ড্রাম বাজিয়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত করলেন। বিজেপি জমানায় বিভিন্ন সময়ে জনজীবনে যে সঙ্কট নেমে এসেছে, সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেতার-দূরদর্শনে মগ্ন থেকেছেন দেশবাসীকে ‘মন কি বাত’ শোনাতে। এরমধ্য দিয়ে তিনি প্রকৃত বাস্তব থেকে সরে গিয়ে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিয়ে ক্রমাগত সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। বর্তমানে কেন্দ্রের সর্বনাশা তিন কৃষি আইনের বাতিলের দাবিতে দিল্লির সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর, শাহজাহানপুর প্রভৃতি সীমান্তে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি বিভিন্ন রাজ্যের কয়েক লক্ষ কৃষক একমাসের বেশি সময় ধরে যে অবস্থান-বিক্ষোভ আন্দোলন চালাচ্ছেন এবং এই দাবিতে দে‍শের বিভিন্ন প্রান্তে যে কৃষক আন্দোলন চলছে - সেই আন্দোলনকে কলুষিত করতে মোদী সহ বিজেপি বাহিনী নানা অপপ্রচার ও কুৎসা করে যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে এই অভিনব আঙ্গিকে দিল্লি সীমান্ত সহ দেশজুড়ে কৃষকেরা প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছেন।

এদিন দেশজুড়ে কয়েক হাজার জায়গায় গ্রাম-শহর ও মফস্‌সলে এভাবে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন কৃষকেরা। অনেক জায়গায় কৃষকদের এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শামিল হয়েছেন সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষও। দিল্লির সীমান্তগুলিতে থালা-ড্রাম বাজানোর সাথে সাথে চলেছে মিছিলও। সারা ভারত কৃষক সভার ডাকে এদিন ছত্তিশগড়ের সুরজপুর, কোরবা, মরবাহি, রায়পুর, ধমতরি, সরগুজা, রাজনন্দগাঁও, গরিয়াবন্দ, বেলৌদাবাজার সহ সমস্ত জেলায় গ্রামে গ্রামে থালার সঙ্গে ঢোল নাকাড়া বাজিয়ে প্রতিবাদ জানান। পাঞ্জাবের অমৃতসর, ফিরোজপুর, সাংরুর, তালওয়ান্দি সাবো, ভাতিন্ডা, তরণতারণ, গুরুদাসপুর এবং হরিয়ানার জিন্দ, রোহটক প্রভৃতি স্থানে প্রতিবাদে সরব হন কৃষকেরা। তাঁরা স্লোগান তোলেন, ‘মন কি নহি’, ‘কিষানো কি বাত করো।’ আওয়াজ ওঠে ‘মন কি বাত ছোড়ো, কাম কি বাত করো।’

কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনকে কলুষিত ও নস্যাৎ করার প্রধানমন্ত্রীসহ বিজেপি শিবিরের যে ধারাবাহিক অপচেষ্টা তার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বয়কট করার আহ্বান আগেই জানিয়েছিলেন বিক্ষোভকারী কৃষকরা। প্রসঙ্গত, গত মার্চ মাসে দেশে করোনা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবের প্রথম পর্যায়ে সরকারের উদ্যোগে বিজ্ঞানসম্মত উপযুক্ত প্রতিবিধানের উদ্যোগ না নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জনতা কারফিউর দিন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের উপযুক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা না করে তাদের ‘উৎসাহিত করতে’ থালা, বাসন, শঙ্খ ইত্যাদি বাজানোর মতো অবৈজ্ঞানিক ও হাস্যকর নিদান দিয়েছিলেন। সেই একই কায়দায় এবারে থালা বা‍‌জিয়ে মোদীর ‘মন কি বাত’-এর নামে গালভরা বুলি ও মিথ্যাচারের বিরোধিতা করার আহ্বান জানিয়েছিল সারা ভারত কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি। সেই ডাকে সারা দিয়ে এভাবে ২৭ ডিসেম্বর দিল্লির সীমান্ত অঞ্চলগুলি সহ বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদে সোচ্চার হন কৃষকেরা। কৃষকেরা আওয়াজ তোলেন, তিন কৃষি আইনের পাশাপাশি মোদী সরকারের স্বৈরাচারী পদক্ষেপ, জমি ও কৃষি ব্যবস্থাকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবার বিরুদ্ধে, আম্বানি-আদানিদের তৈরি পণ্য বয়কটের এবং কৃষক-জমি বাঁচানোর আইন প্রণয়নের দাবিতে।

শাহজাহানপুরে এআইকেএস’র পতাকা হাতে কৃষকরা।

মোদীর মিথ্যাচারের প্রতিবাদ

কেরালার কৃষিক্ষেত্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর মিথ্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়েছে সারা ভারত কৃষকসভা। সংগঠনের সভাপতি অশোক ধাওয়ালে ও সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা ২৬ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হয় কেরালার কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু জানেন না, নতুবা সচেতনভাবেই দেশবাসীকে ভুল বোঝাতে চাইছেন। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, তাতে তিনি আক্রমণের মূল লক্ষ্য করেছেন বামপন্থীদের। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, তিরিশ বছরের শাসনে বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে নাকি কিছুই করেনি। আর কেরালা সম্পর্কে বলেছেন, তারা কৃষকদের জন্য কী করেছে? কেরালা থেকে দিল্লি এসে ছবি তুলছেন। কিন্তু কেরালায় মান্ডি ব্যবস্থাই নেই।’

এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে কৃষকসভা বলেছে, কেরালার ফসল বৈচিত্র্য অন্য রাজ্যের চেয়ে আলাদা হওয়ায় কোনো দিনই সে রাজ্যের বিধানসভায় (জম্মু-কাশ্মীর ও মণিপুরের মতো) এপিএমসি আইন পাশ করানো হয়নি। কেরালায় ৮২ শতাংশ কৃষি জমিতেই মশলা এবং বাগিচা ফসলের চাষ হয়। ডাব, কাজুবাদাম, রবার, চা, কফি, নানান মশলা যেমন গোল মরিচ, জায়ফল, এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি ইত্যাদি চাষই বেশি হয়। এসব পণ্য বিক্রির জন্য নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থা রয়েছে। এসব পণ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা উপার্জন করে দেশ। তা সত্ত্বেও গত তিন দশক ধরে কেন্দ্রীয় সরকারগুলি পরিকল্পিতভাবে এসব বোর্ডকে দুর্বল করে চলেছে।

কৃষকসভা বলেছে, কেরালায় ধান, সবজি বা ফলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য নয় বলেই এপিএমসি মান্ডির মতো নিয়ন্ত্রিত পাইকারি বাজারের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই এসব ফসলের অসংখ্য পাইকারি ও খুচরো বাজার পরিচালিত হয়।

কৃষকসভা বলেছে, অবিশ্রান্ত মিথ্যা এবং প্রতারণায় মদত না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী আরও কেরালার মতো কৃষকস্বার্থবাহী ব্যবস্থা চালু করে দেখান। মোদী আগে জবাব দিন কেন কেরালার ফসল বোর্ডগুলি ক্রমাগত দুর্বল করে চলেছেন তারা? কেন রাজ্য সরকারগুলির মতামত না নিয়ে বিদেশের সঙ্গে অসম বাণিজ্যচুক্তি ও সই দিয়ে এদেশের কৃষকদের দুর্দশা বাড়াচ্ছেন? মোদী আগে জবাব দিন, বিহারে ২০০৬ সালে এপিএম‌সি তুলে দেওয়ার পরে কেন সে রাজ্যের কৃষকেরা কুইন্টাল প্রতি ধান ১০০০/১২০০ টাকায় অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন? শুধু মিথ্যা আর প্রবঞ্চনা দিয়ে কৃষকদের ভুল বোঝানো যাবে না। কেন্দ্রের কৃ‍‌ষি আইনের বিরুদ্ধে কেরালাতে লড়াই চলছে, চলবে। ওই তিন আইন খারিজ না হওয়া পর্যন্ত সারা দেশের কৃষকদের পাশে কেরালার কৃষকরাও আছেন এবং শেষ পর্যন্ত থাকবেন।

ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলায় মোদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিরোধী দলের

কৃষিআইন বাতিলের দাবিতে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে ক্রমাগত ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর তীব্র সমালোচনা করেছে ১১টি বিরোধী রাজনৈতিক দল। সম্প্রতি (২৪ ডিসেম্বর) বিরোধীরা এক বিবৃতিতে একযোগে অভিযোগ করেছে, মিথ্যা অভিযোগ না জানিয়ে এখনই তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করুন প্রধানমন্ত্রী। এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, জম্মু-কাশ্মীর গুপকার জোটের পক্ষে ফারুক আবদুল্লা, সিপিআই(এম)’র সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই’র ডি রাজা, এনসিপি’র শারদ পাওয়ার, ফরওয়ার্ড ব্লকের দেবব্রত বিশ্বাস, আরএসপি’র মনোজ ভট্টাচার্য, সিপিআই(এমএল)’র দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, আরজেডি’র তেজস্বী যাদব, ডিএমকে’র টি আর বালু, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব। এই বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিহীন অভিযোগের তীব্র নিন্দা করে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বলছেন, নতুন কৃষি আইন নিয়ে বিরোধী দলগুলি নাকি কৃষকদের ‘লাগাতার মিথ্যা’ বোঝাচ্ছে। বিরোধীরা নাকি ‘নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে কৃষকদের ব্যবহার’ করছে! বি‍‌রোধীরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই অভিযোগ আসলে সত্যের সম্পূর্ণ অপলাপ।

তাঁরা বলেছেন, কৃষকদের প্রতিবাদ ও তাদের আন্দোলনে আমরা সংহতি জানিয়েছি। দেশের ৫০০টিরও বেশি কৃষক সংগঠনের আহ্বানে এই ঐতিহাসিক সংগ্রাম চলছে। সংযুক্ত কিষান মোর্চার পতাকাতলে এই লড়াই চলছে। সংসদে যখন কোনও আলোচনা বা যথাযথ বিবেচনা ছাড়াই কৃষি আইনগুলি পাশ করানো হচ্ছিল, সে সময় আমাদের অনেকেই তার বিরোধিতা করেছিল। যেসব সাংসদ কৃষি বিলের ওপর ভোটাভুটির দাবি করেছিলেন তাঁদের সংসদ থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল।

ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিয়েও নাকি বিরোধীরা ‘বিরাট মিথ্যা’ ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এমএসপি’র ব্যাপারে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করছে বলেও দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্যের অসারতার প্রমাণ দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কমিশনের সুপারিশ ছিল ‘সি ২+৫০ শতাংশ’ সূত্র মেনে এমএসপি নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু মোদী সরকার এমএসপি দিচ্ছে ‘এ২+৫০ শতাংশ’ সূত্র অনুযায়ী। এমনকি সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সরকার জানিয়ে এসেছে যে, ‘সি২+৫০ শতাংশ’ সূত্র মেনে এমএসপি দিতে তারা অক্ষম। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে অসত্য ছড়াচ্ছেন কে?

বিবৃতিতে বিরোধীরা বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে বর্তমান তিন কৃষি আইনের সঙ্গে বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২০ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি আমরা। এরপরে কৃষি ক্ষেত্রের সংস্কার নিয়ে কৃষক এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে মতবিনিময় করুক কেন্দ্রীয় সরকার। এই আলোচনার ভিত্তিতে সংসদে নতুন আইন তৈরির প্রস্তাব বিবেচনা করা এবং দরকারে সংসদের বিশেষ অধিবেশন অথবা যৌথ অধিবেশন ডাকার বিষয়ও উল্লেখ করেছেন বিরোধীরা।