৫৮ বর্ষ ২০শ সংখ্যা / ১ জানুয়ারি ২০২১ / ১৬ পৌষ ১৪২৭
কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সংহতি মিছিল জাঠা জেলায় জেলায়
ভাতারে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে জাঠা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ তীব্র শীতকে অগ্রাহ্য করে দিল্লির প্রান্তে কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে চলা লাগাতার কৃষি আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে দেশের অন্যান্য অংশের মতো প্রতিবাদী মিছিল-জাঠায় অবাধ্যতার ঢেউ উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। এই স্বতঃস্ফূর্ত কর্মসূচিগুলিতে কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুব মহিলাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে চলছে প্রতিবাদের বহুমাত্রিক ধারাবাহিকতা। বিগত দু’সপ্তাহে স্লোগানে, শপথে, কুশপুতুল পোড়ানোর সামগ্রিকতায় হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে রাজ্যের সরকারের কৃষক বিলের বিরোধিতায়ও। উঠছে বিকল্প বিল তৈরির দাবি। কৃষি বিল সহ নয়া বিদ্যুৎ বিল - সবগুলি জনবিরোধী আইন প্রত্যাহারের জন্য বিরোধিতায় সোচ্চার সহমর্মী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে সর্বত্র।
রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণের জেলাগুলিতে চলছে লাগাতার প্রতিবাদী কর্মসূচি। জাঠা থেকে কুশপুতুল দাহ সব ধরনের কর্মসূচি ঘিরে মানুষের আগ্রহ এবং সমর্থন বাড়ছে।
২৪ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে পথ অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। বারুইপুরের পদ্মপুকুরের অবরোধ শেষে নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয় সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে।
দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের সমর্থনে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের শ্রমিক কৃষক মারা নীতি এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে কৃষি আইনের বিকল্পের দাবিতে ২৪ ডিসেম্বর মিছিল হয় চাঁপদানিতে।
কৃষকদের প্রতি সংহতি জানিয়ে কলকাতায় সিপিআই(এম) রাসবিহারী-১ এরিয়া কমিটির উদ্যোগে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি হয়েছে।
২৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষক ও কৃষি বিরোধী তিন কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল বাতিলের দাবিতে ৩০ দিন ধরে চলা দিল্লির কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন সদর ব্লকের বেলাকোবা অঞ্চলে কৃষক জাঠা-মিছিল করে সারা ভারত কৃষক সভার সদস্যরা।
কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ময়নাগুড়িতে মিছিল।
এদিন সকালে কেন্দ্রের সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিল, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, সার ,বীজের দাম কমানোর দাবিতে বেলাকোবার বড়ুয়াপাড়া থেকে জাঠা শুরু হয়ে পনেরো কিলোমিটার পথ পরিক্রমা করে ছয়টি বুথ এলাকা ঘুরে বিকালে বড়ুয়াপাড়ায় শেষ হয়। গ্রামীণ পথ ধরে কখনো চা বাগানের মধ্যে দিয়ে আবার কখনো কৃষি জমির উপর দিয়ে এই দৃপ্ত মিছিল দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। কর্মসূচি শুরুর আগে দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনের শহিদ কৃষকদের স্মরণ করা হয়।
জাঠার সূচনা করেন বর্ষীয়ান কৃষক নেতা জিতেন দাস। বর্ণাঢ্য এই জাঠা মিছিলের নেতৃত্ব দেন কৃষক নেতা আজম আলী আব্বাস, তপন গাঙ্গুলি, সুভাষ দেব, রণেন রায়, বনমালী রায়, বিশ্বজিৎ মোহন্ত, কবিতা রায়, সুজিত চৌধুরি, শ্রমিক নেতা সুদীপ চক্রবর্তী, বিশ্বজিৎ ঘোষ, শুভাশিস সরকার প্রমুখ।
এর আগে ২৩ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি জেলায় কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষক বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে এবং রাজ্য বিধানসভায় কেন্দ্রের নতুন কৃষি আইন প্রয়োগের বিরুদ্ধে, আইন তৈরির দাবিতে দক্ষিণ বেরুবাড়ি মানিকগঞ্জ বাজার থেকে বাগনান ৩০ কিলোমিটার বাইক রালি পরিক্রমা করে। জলপাইগুড়ি সদর সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক তথা বিডিও-কে স্মারকলিপি প্রদান করা হয় সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষ থেকে। রাজ্য সরকারের কাছে দাবি করা হয় অবিলম্বে বিধান সভার অধিবেশন ডেকে কেন্দ্রের নতুন কৃষি বিল এই রাজ্যে প্রয়োগ না করার পক্ষে আইন তৈরি করতে হবে রাজ্য সরকারকে। ২৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষক ও কৃষি বিরোধী তিনটি আইন ও বিদ্যুৎ বিল বাতিলের দাবিতে সারা ভারত কৃষক সভার পক্ষ থেকে কৃষক জাঠা মিছিল সংগঠিত করা হয়। রাজগঞ্জ ব্লকের পানিকৌরি অঞ্চল কমিটির পক্ষ থেকে জাঠা শুরু হয়ে জুগনিডাঙ্গ থেকে। ৬কিলোমিটার পথ ধরে কৃষি বলয়ের মধ্যে দিয়ে এই দৃপ্ত মিছিল ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। নিজেদের কৃষি পণ্যের সঠিক দামের দাবিতে, কৃষকের অধিকার রক্ষার দাবিতে এই মিছিল সার্বিকভাবে কৃষক সমাজের সমর্থন আদায় করে। এই জাঠা মিছিল থেকে রাজ্য সরকারের কৃষক বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠে। জাঠা শেষ হয় মগরাডাঙ্গিতে। কর্মসূচি শুরুর আগে দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনে শহিদদের স্মরণ করা হয়। বর্ণাঢ্য এই জাঠার সূচনা করেন কৃষক নেতা মহেন্দ্র রায়। এই জাঠা মিছিলের নেতৃত্ব দেন অশোক কুমার রায়, জ্যোতি রঞ্জন রায়, ফয়জুল হক, খরেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ।
২৭ ডিসেম্বর বসিরহাট এক নম্বর ব্লকের গ্রাম পঞ্চায়েতের তেতুলিয়ায় থালা বাজিয়ে রাস্তা অবরোধ করেন স্থানীয় কৃষক ও খেতমজুররা। বসিরহাট মালঞ্চ রোড অবরোধ করে দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে রাস্তা অবরোধ।
এদিন বারাসতে প্রতিবাদ মিছিল গ্রাম থেকে শহরে আসে। গোরুর গাড়ি, ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার এবং ধান বোঝাই ভ্যান নিয়ে অসংখ্য মানুষ লাল ও তেরঙ্গা ঝান্ডা নিয়ে মিছিলে পা মেলান। মিছিল এদিন খিলকাপুর পেট্রলপাম থেকে শুরু হয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে কলোনির মোড়ে শেষ হয়। সেখানে রাস্তা অবরোধ করে মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। মিছিলে ছিলেন আহমেদ আলি খান, দেবব্রত বসু প্রমূখ।
একই দিনে হাওড়া জেলার বাগনান কল্যাণপুর ও বাইনান উলুবেড়িয়ার কালিনগর ও হাটগাছা-১ আমতা, গাজীপুর, শ্যামপুর, আমরদহ, রাধাপুর প্রভৃতি অঞ্চলে জাঠা কর্মসূচি হয়। এছাড়াও হাওড়া জেলার প্রতিটি ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে সংহতিমূলক নানা কর্মসূচি পালিত হয়।
এদিন মোদীর ‘মন কি বাত’-এর সময় মেদিনীপুর জেলা জুড়ে থালা ভেঁপু বাজিয়ে রাস্তাজুড়ে প্রতিবাদে শামিল হন কৃষক সমাজ। সারা ভারত কৃষক সভা ও খেতমজুর সংগঠনের ডাকে এই কর্মসূচি হয়। প্রতিবাদের সাথে বিক্ষোভ সভা চলে। প্রতিটি স্থানে এই আন্দোলনে শামিল হওয়া শহিদদের স্মরণে শহিদ বেদিতে মাল্যদান সহ লাল ঝান্ডা উত্তোলন করেন কৃষক নেতৃবৃন্দ। মোহনপুরে থালা বাজিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করেন কৃষকরা। নারায়ণগড়, সুলতানপুর, ধর্মা, ঘাটাল দাসপুর ২ নম্বর ব্লকের রানিচক, চাইপাট, সোনাখালি, ডেবরা ব্লকে হিজলদহ, কেশিয়াড়ি সহ ব্লকের প্রতিটি এলাকায় মিছিল ও প্রতিবাদ সভা পালিত হয়।
বর্ধমানের পূর্বস্থলীতে জাঠা সংগঠিত হয় সারা ভারত কৃষক সভা পূর্বস্থলী আঞ্চলিক কমিটির উদ্যোগে। গ্রাম পরিক্রমা করে কালখাতলা বাজারে শেষ হয়। মিছিল শেষে পথসভা হয়।
নয়া-কৃষি আইন বাতিল ও দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের প্রতি সংহতি জানিয়ে চন্দননগরের ধাড়াপাড়া বিপ্লবী কালীচরণ ঘোষ পাঠাগার ভবনে আলোচনা সভা হয়। অন্যদিকে তারকেশ্বরের পিয়াসারা বাজারে সভা হয়। ব্যান্ডেল কোদালিয়া এরিয়া কমিটির এক এবং দু'নম্বর শাখার জাঠা মিছিল ও ঘাটের বালি বাজারে তিনটি কৃষি আইন এর বিরুদ্ধে ও বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহারের দাবিতে সভা এবং শ্রীরামপুর অঞ্চলে কৃষক সমিতির উদ্যোগে মিছিল ও সভা হয়।
২৬ ডিসেম্বর পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম, জলপাইগুড়ি ইত্যাদি জেলায় লাল ঝান্ডার ঢেউ তুলে কৃষকদের জাঠা প্রচার হয়েছে। এদিন বীরভূম জেলার ব্লকে ব্লকে কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ উদ্যোগে জাঠা চলেছে। রামপুরহাট-১, মোহাম্মদ বাজার ও নলহাটি ১ ব্লকের প্রায় ২৪ টি গ্রামে কৃষক জাঠা হয়। এদিন জয়রামপুর করুনকৌল, বেলা আটলা গ্রাম পরিক্রমা করে তারাপীঠ স্টেশনে গিয়ে জাঠা শেষ হয়।
পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের সন্তোষপুর ভৈরব গ্রাম সদরের দাসপুরে লাল পতাকার নিচে হিন্দু-মুসলমান আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ লড়াইয়ের ময়দানে এককাট্টা হয়ে নেমেছেন। এদিন ১০০ জন স্থায়ী পদযাত্রী নিয়ে ভাতারের কাটাটিকুড়ি গ্রাম থেকে জাঠা শুরু হয়। পাশেই কালিপাহাড়ি তপশিলি প্রধান গ্রামে মিছিল ঢুকতেই জনজোয়ার হতে দেখা যায়। গোটা পূর্ব বর্ধমান জুড়ে শুরু হয়ে গেছে কৃষক জাঠা। নাদন ঘাটে জাঠা হয়। পূর্বস্থলীর বিভিন্ন গ্রামে পরিক্রমা করে জাঠা। কৃষকরা দাবি করে কৃষকদের থেকে সরাসরি ধান কিনতে হবে সরকারকে। সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষের জীবন যন্ত্রণার কথা উঠে আসে বিভিন্ন জাঠায়।