৫৮ বর্ষ ২০শ সংখ্যা / ১ জানুয়ারি ২০২১ / ১৬ পৌষ ১৪২৭
প্রতারণার রাজনীতির পরিণতি
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গত ২৮ ডিসেম্বর সেল্ফ এসপ্লয়েড লেবর অর্গানাইজারদের (এসএলও) সভা এক নজিরবিহীন বিক্ষোভে ভেস্তে যায়। এসএলও’দের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের পরামর্শে এই সভা ডেকেছিল। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে যে এসএলও’রা সভায় অংশ নিয়েছিলেন তাঁরাই বিক্ষোভ দেখান।
গত নয়মাস ধরে এই এসএলও’দের কোনো রোজগার নেই। সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছিলঃ এসএলও’দের কাজের নিশ্চয়তা প্রদানের ঘোষণা করা হবে ওই সভায়ঃ তার জন্য কানায় কানায় ভরতে হবে স্টেডিয়াম। এসএলও’রা স্টেডিয়াম ভরেছিল;কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা একাধিক মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সভা চললেও সরকারের কাছ থেকে কোনো আশার বাণী শুনতে পাননি এসএলও’রা। এতেই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তাঁরা, প্রায় ধুন্ধুমার কাণ্ড বেধে যায় স্টেডিয়াম জুড়ে। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি লাগানো ফ্লেক্স নির্বিচারে ছেঁড়া হয়, চলে ভাঙচুরও। এমনকি রাজ্য সরকারের মন্ত্রী মলয় ঘটক, ফিরহাদ হাকিম, সাধন পান্ডেকে ঘিরে ধরে এসএলও’রা। পুলিশ এসে তাঁদের উদ্ধার করে।
এসএলও সরকারের কোনো স্থায়ীপদে নিয়োগ নয়। এটা কমিশন ভিত্তিতে কাজ। শ্রমদপ্তরের পরিচালনায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন শ্রমিক সুরক্ষা প্রকল্প আছে। যেগুলি সবই বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে চালু হয়েছিল। এই প্রকল্পগুলিতে সরকার ও নিযুক্তকারীর সাথে শ্রমিকদেরও অর্থ দিতে হয়। শ্রমিকদের এই প্রদেয় অর্থ সংগ্রহ করাই এসএলও’দের কাজ। শ্রমিকদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থের উপর সরকার নির্ধারিত হারে কমিশন পান এসএলও’রা। এটাই তাদের এই কাজে আয়ের একমাত্র উপায়। সারা রাজ্যে ছ’হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণী যুক্ত রয়েছেন এই পেশায়। মাধ্যমিক পাশ, কমপিউটার চালানোয় সাধারণ জ্ঞান এবং ফেরতযোগ্য ৩ হাজার টাকা জমা রাখা এই কাজ পাওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সুরক্ষা প্রকল্পে শ্রমিকেরা দেন ২৫ টাকা, আর সরকার দেয় ৩০ টাকা। প্রতি শ্রমিক পিছু এসএলও’রা পান মাত্র ২ টাকা। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এসএলও’দের আয় কত সামান্য। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্য সরকার বাজেটে ঘোষণা করে, শ্রমিকদের ২৫ টাকাও সরকার দিয়ে দেবে। ফলে সেই সময় থেকেই এসএলও’দের এই সামান্য রোজগারও একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। আনলক পর্বে বারবার সরকারের পক্ষ থেকে এসএলও’দের আশ্বাস দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এদিনও বলা হয়েছিল, যদি স্টেডিয়াম ভরতি হয় তাহলে মন্ত্রীরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এসএলও’দের কাজের নিশ্চয়তা প্রদানের ব্যাপারে কথা বলবেন। সেই জন্য এসএলও’রা নিজের পয়সা খরচ করে রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে নিজেরা এমনকি অসংগঠিত শ্রমিকদেরও গাড়িতে করে সভায় নিয়ে আসে। কিন্তু সেসব না হওয়াতেই এসএলও’দের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। তাঁরা মঞ্চে উঠে শ্রমমন্ত্রীকে ঘিরে ধরেন।
আসলে তৃণমূলের ১০ বছরের শাসনে পশ্চিমবঙ্গে নতুন কোনো কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি। লক্ষ লক্ষ সরকারি শূন্য পদে কোনো নিয়োগ হয়নি। সামান্য যে কয়েকটা স্থায়ী পদে নিয়োগ হয়েছে তাতেও আকণ্ঠ দুর্নীতি। আর যা সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ হয়েছে সবই অস্থায়ী নিয়োগ এবং তৃণমূলের তাঁবেদারি করার শর্তেই সেইসব কাজ মিলেছে। তাঁরাও এখন নিয়মিত বেতন পান না। অনেকেরই আবার বেতনও বন্ধ। তাই এসএলও’দের এই বিক্ষোভ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমনিতেই রাজ্যে কাজ নেই, তার উপর অতিমারী কাজের বাজারের সঙ্কটকে আরও গভীর করেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই কর্মহীন মানুষদের ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার সামান্য কিছু বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে ওইদিনের নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সভায়।
তবে জনগণের এই ক্ষোভ যতদিন যাবে তত বৃদ্ধি পাবে। সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ভোটের স্বার্থে একে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। এবং তারা রাজ্য সরকারের বিরোধিতা করার সাথেই এইসব জীবনজীবিকার বিষয়েও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটাবে।
এই পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। এই আয়হীন-কর্মহীন মানুষরা বিক্ষোভে শুধু ফেটেই পড়ছেন না, তারা সমস্ত ভয়-হুমকিকে উপেক্ষা করে সরাসরি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হচ্ছেন। এটা নিশ্চিতভাবেই ছোটো করে দেখার বিষয় নয়। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে এঁদের সংগঠিত করে ন্যায্য দাবি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই সরকারকে বাধ্য করা যাবে দাবি মানতে। এবং এইসব ছোটো ছোটো লড়াই-ই সরকার পরিবর্তনের মূল লড়াইকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। নাহলে এর সুযোগ নেবে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি।এতে এসএলও’দের কিংবা কর্মহীন মানুষদের দুর্দশার কোনো সুরাহা হবে না; তাঁদের হতাশা আরও বাড়বে। বাড়বে বিশৃঙ্খলাও।