৫৮ বর্ষ ২০শ সংখ্যা / ১ জানুয়ারি ২০২১ / ১৬ পৌষ ১৪২৭
এস এফ আই’র ৫০ বছর পূর্তি
মিছিলে শপথে স্লোগানে এগিয়ে চলার শপথ
হাওড়ায় এসএফআই’র ৫০ বছর পূর্তির সভায় বক্তা বিমান বসু। মঞ্চে নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যজুড়ে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উদ্যাপন কর্মসূচির সূচনা হলো ২৭ ডিসেম্বর। ২৭ থেকে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রাজ্যের প্রতিটি জেলায় এসএফআই’র কর্মসূচিগুলিতে মিছিল-মিটিংয়ের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে গেল সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার আর জীবন-জীবিকার লড়াইয়ের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রজন্মব্যাপী উত্তাপ।
যাদবপুরের অরুণাচল সঙ্ঘের মাঠে এসএফআই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সভায় সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, কেন্দ্রের নীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে কৃষক-শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষের লড়াই আন্দোলন জোটবদ্ধ হচ্ছে। দেশের স্বার্থে এই গণআন্দোলনে এসএফআই কর্মী, সমর্থকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার স্বার্থে ক্যাম্পাসের লড়াই যেমন জারি আছে, তেমনি সমাজের বিভিন্ন গণআন্দোলনে এসএফআই-কে এগিয়ে আসতে হবে।
রাজ্যে স্কুল ছুটের সংখ্যা বাড়ার প্রসঙ্গে বিমান বসু রাজ্য সরকারের সমালোচনা করে বলেন, বামফ্রন্টের সময়ে পরিকল্পনা করে স্কুল ছুটের সংখ্যা কমানো হয়েছিল। ক্যাম্প করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের এনএস স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হতো। সেই কাজ বর্তমান রাজ্য সরকার করে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সভায় সংগঠনের প্রাক্তন সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গর্ভ থেকে এসএফআই’র পথ চলা শুরু। কৃষকের অধিকার, শ্রমিকের ন্যায্য দাবির আন্দোলনের সঙ্গে এসএফআই’র লড়াই জোটবদ্ধ হয়ে গণআন্দোলন বিকশিত হয়েছে। তা আজ এগিয়ে চলেছে বর্তমান প্রজন্মের হাত ধরে।
সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি ভিপি শানু বলেছেন, এসএফআই’র লড়াই আন্দোলন শুধুমাত্র ক্যাম্পাসে আটকে থাকে না। সমাজের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের লড়াই আন্দোলন সহ শিক্ষাবিরোধী নয়া-জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি এসএফআই’র লড়াইয়ের অন্যতম অংশ।
সংগঠনের রাজ্য সভাপতি প্রতীক-উর রহমান বলেছেন ক্যাম্পাসের লড়াইয়ের পাশাপাশি গণ-আন্দোলনের লড়াইয়ের ঐতিহ্য নিয়ে আগামীর জয়যাত্রা এগিয়ে যাওয়ার পথে এসএফআই’র সংগ্রাম জারি রয়েছে।
২৮ ডিসেম্বর এসএফআই’র ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কোচবিহারে পোস্ট অফিসের মাঠে এক জনসভা সংগঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন বিমান বসু সহ প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র নেতৃবৃন্দ। সভায় বিমান বসু বলেন, মানুষের ঐক্য গড়েই তৃণমূল বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতির মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ভুল তথ্য দিচ্ছেন। সারাদেশে একমাত্র বামপন্থী সরকারগুলি সবসময় কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে।
সভায় সুজন চক্রবর্তী বলেন, রাজ্যে তৃণমূল বা বিজেপি নয়, বাম ও তার সহযোগীদের সরকার গড়ার দায়িত্ব দেবেন মানুষ। ফের প্রতি বছর নিয়মিত এসএসসি থেকে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা হবে। সাড়ে পাঁচ লক্ষ শূন্য পদে নিয়োগ করবে আগামী সরকার।
সভায় এসএফআই’র রাজ্য সম্পাদক সুজন ভট্টাচার্য বলেন, শুধু ছাত্রদের দাবি নিয়ে লড়াই নয় শ্রমিক-কৃষকের প্রতিটি অধিকার রক্ষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে থাকবে এসএফআই। সভায় এছাড়াও বক্তব্য রাখেন জেলার প্রাক্তন ছাত্র নেতৃবৃন্দ।
৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মিছিল যাদবপুরে।
এসএফআই’র ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ২৯ ডিসেম্বর স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হয়। দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি শহরের হিলকার্ট রোডের দখল নেয় এসএফআই। বাঘাযতীন পার্ক থেকে শুরু হয়ে সাদা পতাকায় সুসজ্জিত মিছিল শেষ হয় মহানন্দা নদীর তীরে গান্ধী চকে। মিছিলে এসএফআই কর্মীদের সাথে হাঁটেন জেএনইউ’র এসএফআই নেত্রী ঐশী ঘোষ। মিছিলে পা মেলায় নেপালি ভাষী ছাত্রছাত্রীরাও। তাঁদের সঙ্গে পথ হেঁটেছেন অতীতের ছাত্র কর্মীরাও। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, চিকিৎসক, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা, ব্যবহারজীবী-কে ছিলেন না ‘এসএফআই ৫০-পেরিয়ে আসা দিনগুলোর’ ফেস্টুনের পিছনের মুখগুলোতে। তিন দফা কৃষি আইন বাতিলের দাবির পাশাপাশি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে ওই মিছিলে।
মিছিল শেষে পথসভায় ঐশী ঘোষ অবিলম্বে স্কুল-কলেজ খুলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ও সচল করার দাবি জানান। তিনি বলেন, এসএফআই’র ৫০ বছরের ঐতিহ্যের ইতিহাসটা জানা খুবই জরুরি। মোদী সরকারের সার্বিক ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে, সংহতি জানান দিল্লিতে সংগ্রামী কৃষকদের প্রতি। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইতে রাস্তায় নেমেছেন মানুষ। আমাদের সর্বস্তরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এদিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নানা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রায়গঞ্জেও মিছিল হয় এসএফআই’র ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের অর্ধশতকের সংগ্রামের ইতিহাস উদ্যাপন হয় জলপাইগুড়ি জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র ফেডারেশন কর্মীদের মেলবন্ধন হয়ে সমাজপাড়া থেকে বর্ণাঢ্য মিছিল শহর পরিক্রমা করে সমাজপাড়ায় মিলিত হলে, সেখানেই সমাবেশ হয়। এই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বর্তমান জেলা সম্পাদক প্রভাকর সরকার, প্রাক্তন জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য, অরিন্দম চক্রবর্তী, ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি মধুজা সেন রায় এবং জেএনইউ সভাপতি ঐশী ঘোষ প্রমুখ। সমাবেশের শেষে দিল্লির কৃষক আন্দোলনের পাশে থাকবার বার্তা নিয়ে প্রাক্তন ছাত্র নেতৃত্বদের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ৩৫ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয়।
২৮ ডিসেম্বর এসএফআই’র ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সংগঠনের কলকাতা জেলা কমিটির ডাকে সভা হয় শ্যামবাজার মোড়ে। সভাশেষে সেখান থেকেই মিছিল হয় কলেজস্ট্রিট পর্যন্ত। এই সমাবেশে এবং মিছিলে অংশ নেন প্রাক্তন এবং বর্তমান ছাত্র নেতৃত্ব ও কর্মীরা। ভিড়ে ঠাসা সমাবেশে সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি ভিপি শানু বলেন,বিজেপি সরকারের নয়া শিক্ষা নীতির মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাক-প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর সবটাই কর্পোরেটদের দখলে চলে যাবে। এসএফআই তা হতে দেবে না। তিনি দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের সংহতিতে এসএফআই’র ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।
এদিনের সমাবেশে সংগঠনের কলকাতা জেলা সভাপতি অর্জুন রায় এবং সম্পাদক সমন্বয় রাহা সহ প্রাক্তন ছাত্র নেতা কল্লোল মজুমদার, কনীনিকা ঘোষ (বসু) প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
বক্তারা অতীতের অভিজ্ঞতাকে নিয়েই আগামী লড়াইয়ের পথে অগ্রসর হবার কথা সমাবেশকে মনে করিয়ে দেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ছাত্র স্বার্থবিরোধী নয়া শিক্ষা বিধি ২০২০, শ্রমিক স্বার্থবিরোধী সংশোধিত শ্রম আইন, কৃষক স্বার্থবিরোধী কৃষি আইন সহ যে সমস্ত জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে তার বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি খোলার দাবিতে পথে নামার বিষয়টিতে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন তাঁরা। রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি এই দুই শক্তিকে পরাস্ত করতে ছাত্রছাত্রীদের দৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান।
৩০ ডিসেম্বর হাওড়ার বঙ্কিম পার্কে এসএফআই’র ৫০ বছর পূর্তি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিমান বসু। তিনি আবেগের, সংগ্রামের, ভালবাসার পাঁচ দশকে শহিদদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামী অতীতকে স্মরণে রেখে আগামী দিনের দুর্বার লড়াইয়ের শপথ নিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিজেপি দেশের মানুষের পয়লা নম্বর শত্রু। দেশের মানুষকে জাতপাতের ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করতে চাইছে তারা। বিজেপি’র এই কাজে সাহায্য করছে তৃণমূল কংগ্রেস। দেশের ও রাজ্যোর মানুষের শত্রু বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়েই লাগাতার আন্দোলন করেই দেশের ও রাজ্যের মানুষকে এই দুই দলের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে বামপন্থীদের । বিমান বসু বলেন, ১৯৭০ সালে ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে আমাদের রাজ্যু। দেড় লক্ষাধিক সদস্য নিয়ে সর্বভারতীয় সম্মেলনের মধ্যব দিয়ে গড়ে ওঠে এসএফআই। ৬০ এর দশকে সাম্রাজ্যতবাদ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে ছাত্র সমাজ। বিমান বসু বলেন, দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত আছে এসএফআই। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বর্তমান ছাত্র আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। তিনি ছাত্রদের বলেন বর্তমান সময়ে সাহস নিয়ে অগ্রসর হলে সাফল্যই আসবেই।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন শেখ সফিজুল আলি। সমাবেশে বক্তব্য। রাখেন এসএফআই রাজ্যয় সভাপতি প্রতীকউর রহমান সহ প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র নেতৃবৃন্দ। সমাবেশে এসএফআই’র জন্মলগ্ন থেকে সংগঠনের জেলা সভাপতি ও সম্পাদকদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়।