E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২০শ সংখ্যা / ১ জানুয়ারি ২০২১ / ১৬ পৌষ ১৪২৭

বিজ্ঞাপন, চটক আর চমকে প্রকৃত সত্য আড়াল করা যাবে না

সুপ্রতীপ রায়


নির্বাচনের আগে মমতা ব্যানার্জি কল্পতরু। তিনি এখন কৃষক দরদি আবার শিল্প দরদি। প্রতিশ্রুতির বন্যা বইছে। বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে প্রতিশ্রুতির প্রতিযোগিতা চলছে। উভয় দলেরই কমন শত্রু সিপিআই(এম)। যদিও সিপিআই(এম) পরিচালিত ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই কৃষির প্রকৃত উন্নয়ন হয়েছিল। যার প্রভাব পশ্চিমবাংলার অর্থনীতিতে পড়েছিল। বাম আমলে রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ - ভূমিসংস্কার ও ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকারে আসার পর গ্রামীণ বাংলার অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিজ্ঞাপন বা দলদাস মিডিয়ার প্রচারে এ সত্য চাপা দেওয়া যাবে না।

’৭৭-র আগে জমির মালিক ছিল জোতদাররা

কংগ্রেস আমলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন তৈরি হলেও তা কার্যকর হয়নি। জোতদার জমিদাররা স্বনামে বেনামে প্রচুর জমি দখল করে রেখেছিল। দেবতার নামে বা জমিদারদের বাড়ির পোষা পশুপাখির নামেও জমি রাখা হতো। ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল প্রচুর। স্বল্পস্থায়ী দু’টি যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে বড়ো জমির মালিকদের কাছ থেকে প্রায় ৩লক্ষ একর জমি যা কৃষকরা দখল করেছিল তা রক্ষা করা যায়নি। ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালের দু’টি যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে কৃষকদের জমি দখলের আন্দোলনের সময় সরকারি সমর্থন ছিল। ১৯৭৭ সালের আগে কৃষিক্ষেত্রে সব জমি ধনী চাষি ও সম্পদশালীদের দখলে ছিল। ফলে গরিব মানুষদের অবস্থান একেবারে নিচের দিকে ছিল।

বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে জমির মালিকানা গেল গরিব চাষিদের হাতে

বামফ্রন্ট সরকার ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে জমির মালিকানার বৈষম্যের অবসান ঘটায়। বামফ্রন্ট সরকারের গ্রামবাংলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল - ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। এর ফলে কৃষি উৎপাদনে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গের ৭৮ শতাংশই ছিল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। তাঁরা ছিলেন ৯৫ শতাংশ জমির মালিক।

তৃণমূলের আমলে গরিব চাষিরা জমি থেকে উৎখাত হচ্ছেন

তৃণমূল সরকারে আসার পর থেকেই রাজ্যজুড়ে লাগাতার বর্গাদার ও প্রান্তিক কৃষকদের উপর আক্রমণ চলছে। কৃষকদের জমি অনেক জায়গায় পূর্বতন জমির মালিকরা পুনর্দখল করেছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসীন হওয়ার এক বছরের মধ্যেই ৫২৭ জন কৃষকের প্রায় ১,০০০ রায়ত জমি কেড়ে নেওয়া হয়, ৪,৭০০ জন পাট্টাপ্রাপককে ২,৭০০ একর জমি থেকে উৎখাত করা হয়, ৩,৭১০ জন বর্গাদারকে ১,৫৮৭ একর জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, ১৪,০২৫ জন কৃষককে আইনত প্রাপ্ত জমি থেকে উৎখাত করা হয়। তৃণমূলের আমলে বেশ কয়েক জায়গায় কৃষকরা তাঁদের নিজেদের জমি থেকে উৎখাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে পুলিশ গুলি পর্যন্ত চালিয়েছে - যেমন হাড়োয়া। ভূস্বামী ও ধনী কৃষকরা গ্রামবাংলায় কৃষকদের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনে ভূমিসংস্কারের সাফল্যকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।

বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের ফলাফল

বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের ফলে কৃষি উৎপাদন থেকে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

(ক) কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি - ভূমিসংস্কারের ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৮০-৮১ সালে রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে কৃষির অবদান ছিল ২,৪৮৯ কোটি টাকার। ১৯৯০-৯১ সালে কৃষিপণ্যের উৎপাদনের অবদান বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮,৯৩৭ কোটি টাকায়। ২০০৩-০৪ সালে কৃষি পণ্য উৎপাদনের অবদান ২০,৮১০ কোটি টাকা। শস্য উৎপাদনের অগ্রগতিও ঘটতে থাকে। ১৯৮০-৮১ সালে চাল উৎপাদন হয় ১৩৩লক্ষ মেট্রিকটন। তারপরেও উৎপাদনে অগ্রগতি অব্যাহত থাকে। ফসল উৎপাদনে বৈচিত্র্য আসে।

(খ) গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অগ্রগতি - বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের ফলে গ্রামে কৃষি উৎপাদনে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছিল। অন্যের জমিতে নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে কাজ করার বদলে বাংলার কৃষক নিজের জমিতে কৃষি উৎপাদনের কাজে নামেন। ১৯৭৭-৭৮ সালে গ্রামে স্বনিযুক্তির পরিমাণ ছিল ১৪.৩৩ শতাংশ। ১৯৯৩ সালে তা বেড়ে হয় ১৯.৭৯ শতাংশ। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময় পর্যন্ত এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকে।

(গ) খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি - ভূমিসংস্কারের ফলস্বরূপ খেতমজুরদের মজুরিও বৃদ্ধি পেতে থাকে। গ্রামীণক্ষেত্রে কাজের সুযোগ সম্প্রসারিত ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে খেতমজুরদের চাহিদা বাড়ে। ১৯৯৩-৯৪ সালে দৈনিক গড় মজুরির হার ছিল ২৮.৩৬ টাকা, ২০০৩-০৪ সালে তা বেড়ে হয় ৫৯.৪৮ টাকা।

(ঘ) সার ব্যবহার ও সেচের সম্প্রসারণ - চাষের এলাকা, কৃষি বৈচিত্র্য, কৃষকের চাষ করার ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণও ঘটতে থাকে। ১৯৭৭-৭৮ সালে রাজ্যে সার ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ১.৭২ লক্ষ টন। ২০০০ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৭৮ লক্ষ টন।

১৯৭৭ সালে রাজ্যে ৩০ শতাংশ কৃষিজমিতে সেচের ব্যবস্থা ছিল। ২০০০ সালে তা দাঁড়ায় ৬২ শতাংশ। বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নেওয়ার আগে রাজ্যের প্রায় সমস্ত কৃষি জমি সেচের আওতায় আসে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে বড়ো, মাঝারি ও ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থার বিপুল বিস্তার ঘটে। দামোদর, ময়ূরাক্ষী ও কংসাবতী এই তিনটি সেচ প্রকল্পেই ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় বামফ্রন্ট সরকারের সময়। বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের অধীন গাজোলডোবাতে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত হয় তিস্তা ব্যারেজ। তিস্তা-মহানন্দা সংযোগকারী খালের মাধ্যমে তিস্তার জল আনা হয় মহানন্দায়। মহানন্দার উপর ফুলবাড়িতে নির্মিত হয় মহানন্দা ব্যারেজ। বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই ১,১৪,২০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন সুবর্ণরেখা বাঁধ প্রকল্প রূপায়ণের প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়। ক্ষুদ্র সেচে বড়ো সাফল্য আসে।

কৃষি ঋণ - বাম আমল আর তৃণমূল জমানা

বামফ্রন্ট সরকারের সময় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি ঋণের সহায়তা দান করা হয়। গ্রামীণ ও সমবায় ব্যাঙ্কের মাধ্যমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কৃষি ঋণের ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। ১৯৭৫-৭৬ সালে কৃষি ঋণ দেওয়া হতো ২০০ কোটি টাকা। ১৯৯৫-৯৬ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৫১০.৮৯ কোটি টাকায়। ২০০৪-০৫ সালে কৃষি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯৬২.৫৩ কোটি টাকায়, ২০০৫-০৬ সালে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ২৯৬৯.৮২ কোটি টাকা। রাজ্যে কৃষির উন্নতির স্বার্থে ১৯৯৮-৯৯ সালে কিষান ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে রাজ্যের কৃষকদের ঋণদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাজ্য সরকারের সমবায় দপ্তরের প্রাইমারি কোঅপারেটিভ এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক ও স্টেট কোঅপারেটিভ এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের শাখা থেকে কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া হতো। ২০০০-০১ মরশুম থেকে রাজ্য সরকার চালু করেছিল রাষ্ট্রীয় কৃষি বিমা যোজনা।

বামফ্রন্ট সরকার কৃষি ঋণের সুদে ভরতুকি দিয়েছিল কৃষককে বাঁচাতে। তৃণমূলের আমলে এসব উধাও। মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রিত্বে এমন কোনো কৃষক পরিবার নেই, যে দেনার দায় থেকে মুক্ত। তৃণমূলের জমানায় খেতমজুর, ছোটো চাষি, বড়ো চাষি সবাই ঋণগ্রস্ত। ‘পরিবর্তনের বাংলা’য় গ্রামীণ মানুষের জীবনধারণের মান নিম্নগামী।

নির্বাচিত পঞ্চায়েত কৃষি ও কৃষকের স্বার্থরক্ষা করেছিল

বামফ্রন্ট সরকারের ঐতিহাসিক পদক্ষেপগুলির অন্যতম ছিল নির্বাচিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তন। কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষার্থে পঞ্চায়েত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ১৯৭৮ সালে নির্বাচিত পঞ্চায়েত গঠিত হওয়ার পর ভূমিহীনদের জমির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে সরকারি অফিসাররা সন্ধ্যাবেলায় প্রকাশ্যে শিবির ডেকে বর্গাদার নথিভুক্তিকরণের কাজ করতেন। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল নতুন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ভূমিকা। ভাগচাষিদের স্বার্থরক্ষায় পঞ্চায়েতের উদ্যোগ ছিল উল্লেখযোগ্য। পঞ্চায়েতগুলির উদ্যোগের ফলেই অপারেশন বর্গায় অত্যন্ত দ্রুতহারে বর্গাদার নথিভুক্তিকরণের কাজ হয়।

তৃণমূল আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পঙ্গু করার কুফল

গ্রামীণ মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে তৃণমূল কার্যত পঙ্গু করে দিয়েছে। আসলে তৃণমূল সরকার গ্রামীণ ধনী ও ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত প্রাণ। তৃণমূলের আমলে পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত। তৃণমূলের রাজত্বকালে পঞ্চায়েতের গণতান্ত্রিক জীবনীশক্তিকেও হরণ করা হয়েছে। রাজ্য সরকারে এসেই নতুন মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘পঞ্চায়েতকে আমলাতন্ত্রের অধীনস্ত হয়ে কাজ করতে হবে।’’ আসলে এ ঘোষণা ছিল গ্রামীণ উন্নয়নের কাজ আমলাতান্ত্রিক পথে বিডিও অফিস থেকে পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গি। মমতা ব্যানার্জির এ নীতি ‘‘পুনঃআমলাতন্ত্রীকরণ’’।

এই নীতির ফল কি হলো? পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিমুখ দুর্বল হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষিতে পঞ্চায়েতগুলি খেতমজুরদের স্বার্থ সুনিশ্চিত করত। বাম আমলে পঞ্চায়েতগুলি খেয়াল রাখত কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণে কোনোভাবেই যাতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন। তৃণমূলের সময়ে গ্রামে আধিপত্য কায়েম হয়েছে পূর্বতন প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার, জোতদার শ্রেণি, নব্যধনীদের। গ্রামের সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে পঞ্চায়েত কাজ করছে না।

বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কেন কৃষকের আত্মহত্যা ঘটেনি?

নয়া-উদারবাদী জমানায় নব্বই দশকের গোড়া থেকেই ভারতের রাজ্যে রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে থাকে। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু কেন? বামফ্রন্ট সরকারের আমলে উন্নত কৃষি বিপণন ব্যবস্থা এবং পঞ্চায়েতের সদর্থক ভূমিকার ফলে কৃষকদের অভাবী বিক্রয়ে বাধ্য হতে হয়নি।

কৃষির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার সরকারি কৃষি বিপণন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছিল। কৃষি বিপণনের কাজ শুরু হয় ফসল কাটার পরে এবং কাজ শেষ হয় উৎপাদিত পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর পর। বাজার বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ ও প্রচার, পরিবহণ, বিপণন ব্যবস্থা, মূল্য নির্ধারণ - এসব কাজ কৃষি বিপণনের আওতায় পড়ে। বামফ্রন্ট সরকারের ধারাবাহিক উদ্যোগের ফলে বিপণনের কাজ সম্পর্কে কৃষকদের সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গ কৃষি পণ্য বিপণন ও প্রনিয়ম আইন (১৯৭২) অনুসারে গঠিত নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতিগুলিতে কৃষি পণ্য বিপণনের জন্য পরিকাঠামোগত সুযোগসুবিধা বামফ্রন্ট সরকার বৃদ্ধি করেছিল। চাষের জমি থেকে নিয়ন্ত্রিত বাজারে কৃষি পণ্য নিয়ে আসার জন্য পরিবহণের ব্যয় মেটাতে কৃষি বিপণন দপ্তর থেকে কৃষকদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া হতো।

বাজারিকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভূমিকা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই লেনদেনে কৃষকরা যাতে লোকসানে না পড়েন তার অনেকটাই পঞ্চায়েত দেখভাল করত। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কৃষি উৎপাদন ও বিপণনের একটা শৃঙ্খল তৈরি হয়েছিল, যাতে পঞ্চায়েতের নজরদারি ছিল। ফলে অভাবী বিক্রি চাষিকে করতে হতো না। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ধান সংগ্রহের একটি ভাল ব্যবস্থাপনা ছিল। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে সরকারের কাছে জমা করত। যার ফলস্বরূপ ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সবটাই কৃষকের হাতে পৌঁছাত।

তৃণমূলের আমলে কৃষকের আত্মহত্যার মিছিল লম্বা হচ্ছে

তৃণমূল সরকারে আসার পর কৃষকের আত্মহত্যার মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। কিন্তু কেন? সরকারে আসার পর কৃষি বিপণন ব্যবস্থাকেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। ধান সংগ্রহের কাঠামোটাই ভেঙে দেওয়া হয়। মমতা ব্যানার্জি সরকারে এসে ঘোষণা করলেন - সরকার নিজেই শিবির খুলে ধান সংগ্রহ করবে। কিন্তু শিবির খোলা হলো যৎসামান্য। কৃষককে পরিবহণ খরচ দিয়ে শিবিরে ধান নিয়ে আসার পর নগদের বদলে দেওয়া হলো চেক। আবার সেই চেক বাউন্স করে।

সরকারের কাছ থেকে দাম পাওয়ার অনিশ্চয়তার কারণে কৃষক অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ফড়েদের দাপট বেড়েছে, লাভবান হয়েছে চালকলের মালিকরা। চাষিদের অভাবী বিক্রি বাড়লেও ফড়েরা এবং চালকল মালিকরা সংগ্রহ মূল্যে বিক্রি করছে সরকারকে। তৃণমূল সরকারের সৌজন্যে গ্রামাঞ্চলে ফড়েরাজ কায়েম হয়েছে। মা-মাটি-মানুষের আমলে বেনফেড এবং কনফেড প্রায় কোনো কৃষি পণ্য ক্রয় করেনি।

গ্রামীণ উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়নের পরিসংখ্যান নেই

তৃণমূল সরকার পরিকল্পিতভাবেই কোনো পরিসংখ্যান জনগণকে দেয় না। মুখ্যমন্ত্রী যখন যেমন বলবেন সেটাই তথ্য বা পরিসংখ্যান। ফলে কৃষি উৎপাদন, গ্রামীণ উন্নয়ন বা কৃষক আত্মহত্যার কোনো সরকারি তথ্য পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক সমীক্ষার ‘পরিসংখ্যান পরিশিষ্ট’ প্রকাশ বর্তমান রাজ্য সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে সরকারি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান কার্যত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

তৃণমূল সরকারের আমলে গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতি যে খারাপ অবস্থায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিজ্ঞাপন, চটক আর চমকে প্রকৃত তথ্য গোপন করা যাবে না।