E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২০শ সংখ্যা / ১ জানুয়ারি ২০২১ / ১৬ পৌষ ১৪২৭

বিজ্ঞান আলোচনা

কালজয়ী লুই পাস্তুর

তপন মিশ্র


সারা বিশ্ব এখন যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, ১৮৮৫ সালে লুই পাস্তুর (Louis Pasteur) ঠিক তেমনই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন জলাতঙ্ক রোগের টিকা মানুষের শরীরে কার্যকারিতা পরীক্ষা করা বাকি ছিল। টিকা গবেষণার অনেক কিছু অজানা থাকলেও একদম ঠিক পথে এগিয়ে ছিলেন পাস্তুর। এই কর্মকাণ্ডে পাস্তুরের সঙ্গী ছিলেন পল রাউক্স (Pierre Paul Emile Roux)। সেই ১৮৮৫ সালে প্যারিসের কাছে জোসেফ মেইস্তার নামে এক অসহায় শিশুর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। শিশুটি পাগলা কুকুরের কামড়ের শিকার হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

নিশ্চিত জলাতঙ্ক রোগাক্রান্ত ছেলেকে তার মা এবং কুকুরের মালিক পাস্তুরের গবেষণাগারে নিয়ে আসেন। ছেলেটিকে জলাতঙ্ক রোগ থেকে সারিয়ে তোলার আবেদন নিয়ে পাস্তুরের দ্বারস্থ হন তাঁরা। পাস্তুর বুঝলেন ছেলেটি আর বেশিদিন বাঁচবে না। অবশেষে পাস্তুর তাকে টিকা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে ছেলেটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে পাস্তুরের এই অবিস্মরণীয় চিকিৎসার কথা। টিকার নাম হয় রাবিজ টিকা। পরবর্তীকালে ভাইরাসটি লিসাভাইরাস (rabies virus বা lyssavirus) হিসাবে পরিচিত হয় যার পোশাকি নাম দেওয়া হয় Rabies lyssavirus।

কুকুরের মালিক, মেইস্তারের মা এবং শিশুটি একসঙ্গে যখন পাস্তুরের কাছে চিকিৎসার আবেদন নিয়ে আসে তখন পাস্তুর এবং তাঁর সঙ্গী পল রাউক্স নতুন এই টিকা মানবদেহে প্রয়োগের আগে যে দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন তা তাদের কথাতেই ব্যক্ত করা যেতে পারে। পাস্তুরের কথা ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়ঃ “As the death of this child appeared inevitable, I decided, not without deep and severe unease, as one can well imagine, to try on Joseph Meister the procedure which had consistently worked in dogs.” ওষুধ প্রয়োগের আগে ওঁরা প্রায় দশটি রোগাক্রান্ত কুকুরের উপর এই ওষুধ প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছিলেন। প্রথম ইনজেকশনটি পাস্তুর নিজে দেন। পরের ১২টি দেন পাস্তুরের সহকর্মীরা। এভাবেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে আরও অনেক জীবনদায়ী বিজ্ঞানের গবেষণায় যিনি বিশ্বকে আলোকিত করেন সেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নাম হয়ে যায় লুই পাস্তুর।

নাৎসিবিরোধী জোসেফ মেইস্তারের কথা

বড়ো হয়ে মেইস্তার লুই পাস্তুরের তৈরি পাস্তুর ইনস্টিটিউটের রক্ষীর কাজ নেয়। মেইস্তার হয়ে ওঠেন পাস্তুরের অত্যন্ত অনুগত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানি ফ্রান্স দখল করে নেওয়ার পর নাৎসিবাহিনী লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরি দখল নিতে আসে। জোসেফ মেইস্তার গেটের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে ল্যাবরেটরি রক্ষা করার চেষ্টা করে। জার্মান সেনাবাহিনীর গুলিতে তাঁর মৃত্যু হওয়ার আগে পর্যন্ত সে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। তখন অবশ্য পাস্তুর জীবিত ছিলেন না।

মেইস্তারকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। রয়েছেন লুই পাস্তুর।

সেই সময়

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানির বারবার যুদ্ধ হয়েছে। দেশপ্রেমিক পাস্তুর ছিলেন মনেপ্রাণে যুদ্ধবিরোধী। ১৮৭০-৭১ সালে যে জার্মান- ফ্রান্স যুদ্ধ হয় সেই সময়ে বিজ্ঞান গবেষণায় নিযুক্ত পাস্তুর লিখলেনঃ “আমি নিশ্চিত যে বিজ্ঞান এবং শান্তি একসময়ে অজ্ঞতা এবং যুদ্ধকে জয় করে নেবে। বিশ্বের সব জাতি শান্তির পথে একত্রিত হবে এবং যারা মানবতার জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে ভবিষ্যৎ।” (“I am utterly convinced that Science and Peace will triumph over Ignorance and War, that nations will eventually unite not to destroy but to edify, and that the future will belong to those who have done the most for the sake of suffering humanity.”)

লুই পাস্তুর যে যুগের (ডিসেম্বর ২৭, ১৮২২ থেকে সেপ্টেম্বর ২৮, ১৮৯৫) মানুষ ছিলেন সে যুগের মানুষের একটা ভুল ধারণা ছিল যে, অসুখ-বিসুখ এমনিতেই সৃষ্টি হয় বা ভগবানের অভিশাপের ফল। পাস্তুরের এই আবিষ্কার প্রমাণ করে দেয় যে, বেশিরভাগ রোগের পেছনেই জীবাণুরা দায়ী। এভাবেই মানুষের কুসংস্কারের ভাবনাকে তিনি বিজ্ঞানের মাধ্যমে ভুল প্রমাণ করে দেন।

মানুষের রোগ যন্ত্রণার বিরুদ্ধে লড়াই করার শপথ নিয়ে পাস্তুর গবেষণায় মগ্ন ছিলেন। তিনি বলতেনঃ “আমি রহস্যের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আর পর্দাটি ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে।’’ (“I am on the edge of mysteries and the veil is getting thinner and thinner.”)। তিনি আরও বলেনঃ “যে কষ্ট পায়, সে তাঁর মতো অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে না যে তোমার দেশ ও ধর্ম কী। সে বলে, তুমি আমার মতোই কষ্ট পাচ্ছ, আর এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট।’’ (“One does not ask of one who suffers: What is your country and what is your religion? One merely says: You suffer, that is enough for me”)। আমরা যারা জাতি, দেশ, ভাষার ভেদভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করি এবং বিজ্ঞানের সর্বজনীনতার পক্ষে সওয়াল করি তাদের প্রথম পাঠ শুরু হয় পাস্তুরের আদর্শ থেকে।

পাস্তুরের কাজ

পাস্তুরের মৃত্যুর অনেক পরে বোঝা যায় যে, লিসাভাইরাসটি আরএনএ ভাইরাস। মনে করিয়ে দিই যে, বর্তমানের করোনা ভাইরাসটিও আরএনএ ভাইরাস। পাস্তুরের সময়ে কিন্তু আরএনএ কিংবা ডিএনএ সম্পর্কে কোনো ধারণা তৈরি হয়নি। এডওয়ার্ড জেনার এবং পাস্তুর এই বিশ্ববিখ্যাত দুই মানুষ ভাইরাস আবিষ্কারের আগেই টিকা আবিষ্কার করেন। তাঁরা জানতেনই না যে, ভাইরাস বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব আছে। ১৮৯২ সালে প্রথম ইভানোভিস্কি (Dmitri Ivanovsky) তামাক গাছের রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (Tobacco Mosaic Virus)-কে একটি ফিলটারের মাধ্যমে আলাদা করতে সমর্থ হন।

একটি বিতর্ক প্রায়শই শোনা যায়। সেটি হলো, আগে বিজ্ঞান না আগে প্রযুক্তি। জেনার এবং পাস্তুর ভাইরাসের বিজ্ঞান না জেনেও দুই মারণরোগের মোকাবিলার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেন।

পাস্তুরের গবেষণার ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত। কর্মজীবনে প্রথমের দিকে পদার্থবিদ্যা গবেষণায় তিনি যুক্ত হন। রসায়ন গবেষণাগারে কিছুদিন বিজ্ঞানাগার সহায়কের কাজ করেন তিনি। পরেরদিকে পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নবিদ্যায় অধ্যাপনার কাজ করেন। জার্ম তত্ত্ব (Germ Theory) এবং ফারমেনটেশন প্রক্রিয়ার অনেক গবেষণার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ফারমেনটেশন প্রক্রিয়া যে স্বতঃস্ফূর্ত নয় তা তিনি প্রমাণ করে দেখান। দুধের সংরক্ষণের জন্য ব্যাকটেরিয়া মুক্ত করার যে পদ্ধতি (Pasteurisation) আবিষ্কার করেন তা এখনও ডেয়ারি শিল্পে ব্যবহৃত হয়। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে The Physiological Theory of Fermentation, The Germ Theory and its Applications to Medicine and Surgery, On the Extension of the Germ Theory to the Etiology of Certain Common Diseases ইত্যদি বিশ্বখ্যাত। মুরগির কলেরা রোগের টিকা এবং আনথ্রাক্স রোগের টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

জলাতঙ্ক (Hydrophobia)-র টিকা তৈরির সময়ে তিনি প্রথমে বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে রাবিজ আক্রান্ত হিংস্র পাগলা কুকুরের মুখ থেকে লালা সংগ্রহ করেন। সেই লালা দিয়ে খরগোশ বা কুকুরকে সংক্রমিত করার চেষ্টা করে দেখেন যে, এই পদ্ধতিটা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। তাছাড়া, পদ্ধতিটি ছিল খুব সময়সাপেক্ষ। একটি পশুর দেহে রাবিজ রোগের উপসর্গ দেখা দিতে যদি মাসখানেক লেগে যায় তাহলে সেটা নিয়ে তো আর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করা যায় না। দ্রুত সংক্রমণের একটা পদ্ধতি বের করার চেষ্টা করেন তিনি।

পাস্তুর রোগের উপসর্গ দেখে অনুমান করেন যে, এটি একটি স্নায়ুরোগ এবং মস্তিষ্কের স্নায়ুকেন্দ্রের সাথে এর যোগাযোগ আছে। জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশুর লালা নিয়ে যদি স্পাইনাল কর্ডের অংশবিশেষ সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কী হয়? যেরকম চিন্তা সেরকম কাজ এবং লুই পাস্তুর আবিষ্কার করলেন তার ধারণা সত্যি। সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেকশন দিয়ে খুব নির্ভরযোগ্যভাবে এবং দ্রুত তিনি পশুকে রাবিজ রোগে সংক্রমিত করান। এরপর তিনি গবেষণার পরের ধাপে পা দেন।

তিনি লক্ষ করেন যে, এই অদৃশ্য পরজীবীটিকে কোনোভাবেই ল্যাবরেটরির টেস্টটিউবে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু ব্যাকটেরিয়াকে কোনো এক মাধ্যম (Medium) তৈরি করে গবেষণাগারে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। তিনি তাই এই পরজীবীকে জীবন্ত কোথাও বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এই পরীক্ষার জন্য তিনি খরগোশকে বেছে নেন। খরগোশের মস্তিষ্কে তিনি তার প্রবেশ ঘটান। পাস্তুরের ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো, খরগোশের মস্তিষ্কে এই অদৃশ্য জীবাণু শুধু বেঁচেই থাকল না, আরও ভয়ঙ্কর, আরও সর্বনাশী হয়ে উঠল। ছয়দিনের মধ্যেই খরগোশের দেহে এই রোগ সর্বগ্রাসী উপসর্গ নিয়ে দেখা দিল। এই রোগে আক্রান্ত, মৃত এবং গবেষণাগারে সংরক্ষিত এক খরগোশের স্পাইনাল কর্ড থেকে রস সংগ্রহ করে আক্রান্ত এবং জীবিত এক খরগোশের দেহে তিনি প্রবেশ করান। যে অদৃশ্য জীবাণু তিনি চোখে দেখতে পাননি কিন্তু যার অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিলনা সেটাকে দুর্বল করে প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করার সঠিক সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সম্পূর্ণ এই কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে সিদ্ধান্তে তিনি পৌঁছান তা হলো প্রথমত, জলাতঙ্ক আক্রান্ত কোনো পশুর স্পাইনাল কর্ডের নির্যাসের মাধ্যমে অপর কোনো প্রাণীকে জলাতঙ্কে আক্রান্ত করা সক্ষম। দ্বিতীয়ত, প্রাণীদেহে রোগ তৈরিতে অক্ষম এমন কিছু জলাতঙ্ক ভাইরাস সংরক্ষণ করে এবং তা পশুদেহে প্রয়োগ করার মধ্যদিয়ে রোগ প্রতিরোধে অভাবনীয় সাফল্য অর্জনও সম্ভব। করোনার টিকা তৈরির ক্ষেত্রে এখনও নিষ্ক্রিয় বা আংশিক নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ব্যবহার করা হচ্ছে।

পাস্তুর ইনস্টিটিউট, প্যারিস।

১৮৯২ সালের ২৭ ডিসেম্বর তাঁকে অভিনন্দন জানাতে প্যারিসে দেশবিদেশের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী সমবেত হন। বিশ্বজোড়া সম্মান, উপাধি, পুরস্কার, মানপত্র তাঁর চরিত্র বদলে দেয়নি। তিনি আগের মতোই নিরহঙ্কার, নিরলস, সাদামাটাভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে তাঁর পৌত্রের দেওয়া কিছু তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকটি গবেষণা সম্পর্কে কিছু বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ১৮২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের জুড়া শহরে জন্ম গ্রহণ করা এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয় ১৮৯৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। তাঁর কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায়, ‘‘বিজ্ঞানের কোনো দেশ ভেদাভেদ নেই, কারণ জ্ঞান হচ্ছে মানবতার সম্পদ, আর সেই আলোকবর্তিকা যা কি-না পুরো বিশ্বকে আলোকিত করবে।’’ (“Science knows no country, because knowledge belongs to humanity, and is the torch which illuminates the world.”)