৫৯ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১ জুলাই, ২০২২ / ১৬ আষাঢ়, ১৪২৯
সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ
তিস্তা শীতলবাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মুম্বাইতে বিক্ষোভ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদের মুক্তির দাবিতে, গণতন্ত্র রক্ষায় সোচ্চার মানুষ পথে নেমেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, কলকাতা, জয়পুর, পাটনা, আজমেঢ়, ভোপাল, রাঁচি, লক্ষ্মৌ, এলাহাবাদ, চণ্ডীগড়, রায়পুর, এমনকী আহমেদাবাদেও অগণিত মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। এইসব বিক্ষোভ-কর্মসূচিতে তিস্তা শীতলবাদ সহ গুজরাট পুলিশের প্রাক্তন ডিজিপি আর বি শ্রীকুমার এবং বরখাস্ত আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাটের মুক্তির দাবি সহ মোদি-শাহের ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে জোরালো স্লোগান উঠছে।
অবিলম্বে তিস্তা শীতলবাদের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বামপন্থী দল এবং ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনের কর্মীরা পথে নেমেছেন। শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও এই আন্দোলনের বার্তা পৌঁছেছে। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে রাষ্ট্রসংঘ। রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রধান মেরি ললো বলেছেন, মানবাধিকার রক্ষায় আন্দোলন কোনো অপরাধ নয়। তিস্তা শীতলবাদ ঘৃণা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর।
প্রসঙ্গত, গুজরাটের গুলবাগ সোসাইটি হত্যাকাণ্ডে নিহত কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি এবং সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদ একযোগে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে গুজরাট গণহত্যা মামলায় নরেন্দ্র মোদিকে ক্লিনচিট দেবার বিরোধিতা করেছিল। ২৪ জুন এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়ে যায়। তিন সদস্যের ডিভিসন বেঞ্চের এই রায়ে এই আবেদনকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে নাকচ করে দেবার পাশাপাশি তিস্তা শীতলবাদের ভূমিকার সমালোচনা করে বলা হয়, জাকিয়া পরিস্থিতির শিকার। তাঁর আবেগকে কাজে লাগিয়েছেন তিস্তা। শুধু তিস্তাই নন, আদালতের রায়ে কড়া সমালোচনা করা হয় প্রাক্তন দুই পুলিশ আধিকারিক আর বি কুমার এবং সঞ্জীব ভাট-এর। তাঁরা নিজেদের ‘ক্ষোভ’ থেকে লাগাতার গুজরাট সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিরুদ্ধ প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন বলে আদালত মন্তব্য করে। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করে আদালত।
আদালতের এই রায়ের পর সংবাদমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি নানা কথার ফাঁকে মন্তব্য করেন, গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে ‘মিথ্যা প্রচারের’ এক ‘ত্রিকুট’ তৈরি হয়েছিল - বিজেপি-র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। নিজেদের আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতিতে আসা লোকজন এবং কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তিনি গর্ব করে বলেন, এই ত্রিকুট শেষ পর্যন্ত জনতাকে ধোকা দিতে পারেনি। জনতার রায় শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে থেকেছে।
আদালতের রায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে গুজরাট পুলিশ ২৫ জুন মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করে তিস্তা শীতলবাদকে। তার আগে তিস্তা সহ দুই প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকের নামে এফআইআর করে গুজরাট পুলিশ। তিস্তাকে গ্রেপ্তারের পর নিয়ে যাওয়া হয় আহমেদাবাদে। এছাড়া সেদিনই গুজরাট পুলিশ আহমেদাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করে প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক আর বি কুমারকে। এফআইআর-এ আরেক অভিযুক্ত বরখাস্ত হওয়া আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাট, যিনি পুলিশ হেপাজতে এক বন্দির মৃত্যুর ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত, তাঁকেও হেপাজতে নিতে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করে গুজরাট পুলিশ।
এই ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার বৃহত্তর চক্রান্তে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং গুজরাট প্রশাসন যুক্ত ছিল না, সুপ্রিম কোর্টের এমন রায়ের পর গুজরাট পুলিশের অ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াড (এটিএস) ২৫ জুন তিস্তা শীতলবাদকে গ্রেপ্তার করেছে - তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তীব্র হয়েছে বামপন্থী সহ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সহ গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল নাগরিক সমাজে।
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো ২৬ জুন এক বিবৃতিতে তিস্তা শীতলবাদের গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা করে বলেছে, গুজরাট এটিএস-এর এই পদক্ষেপ দেশের গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন সমস্ত নাগরিকের কাছে এক অশনি সংকেত। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ই তিস্তাকে গ্রেপ্তারের রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে গুজরাট প্রশাসনের সামনে।
এই বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো বলেছে, ২০০২-এর গুজরাট গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে ন্যায়বিচার পান, তার জন্য তিস্তা শীতলবাদ নিরলস লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে দেশের গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন নাগরিকদের এক ভয়ঙ্কর হুমকি দেওয়া হলো - সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা যেখানেই ঘটুক না কেন, রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস দেখাবেন না। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি বিতৃষ্ণাই প্রকাশ করা হয়েছে। তবে গুজরাট প্রশাসনকে এই কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চের বিতর্কিত রায়। ওই রায়ে অভিযোগকারীকে অভিযুক্ত বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘যাঁরাই এই প্রক্রিয়ার এমন অপব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী আদালত যদি কোনো সিট স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করে, তাহলে তাকে বিচারবিভাগীয় আবেদনের এক্তিয়ারের বাইরে বলে বিবেচনা করতে হবে। যদি কেউ এর বিরুদ্ধে আবেদন জানান, এই মামলায় যেমন সিটের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন জানিয়েছিলেন জাকিয়া জাফরি এবং তিস্তা শীতলবাদ, তাহলে তাঁকে ‘প্রক্রিয়ার অপব্যবহার’-এর দায়ে অভিযুক্ত করা হবে। ন্যয়বিচারের আকাঙ্ক্ষায় ১৬ বছরের লড়াইকে ‘অসৎ উদ্দেশ্যে পাত্র গরম রাখা হচ্ছে’ বলে অভিহিত করে এই রায়ে অস্বাভাবিক অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে।
পলিট ব্যুরো আরও বলেছে, এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট হিংসার তদন্তের সিট গঠন করেছিল। সেই সিটের রিপোর্টের বিরুদ্ধে মামলার সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট যাঁকে আদালত-বান্ধব হিসাবে নিয়োগ করেছিল, তিনি সিটের রিপোর্টের অনেকাংশের সঙ্গে যেমন একমত হয়েছেন, তেমনি লিখিতভাবে এও জানিয়েছেন যে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ঘৃণা ছড়ালে ভারতীয় দণ্ডবিধির যেসব ধারায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেগুলির বিবেচনা করা উচিত। এর আগে ২০০৪ সালের এপ্রিলেই এই সুপ্রিম কোর্টই তৎকালীন সরকারের (গুজরাট হিংসার সময়ের) মাথাদের ‘আধুনিক যুগের নিরো’ বলে অভিহিত করেছিল। বর্তমান রায় এই সবের কোনো কিছুকেই নজর দেয়নি। রায়ে তিস্তা শীতলবাদের মতো ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যাঁরা বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন। এই রায় কিউরেটিভ পিটিশন (রায় সংশোধন চেয়ে আবেদন) দাখিল করার উপযুক্ত। বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়ে তিস্তা শীতলবাদ, গুজরাট পুলিশের প্রাক্তন ডিজি আর বি কুমার এবং বাকিদের অবিলম্বে মুক্তি দেবার দাবি জানিয়েছে।
এছাড়া সিপিআই, সিপিআই(এমএল) সহ সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, ডিওয়াইএফআই প্রভৃতি বিভিন্ন গণসংগঠন যেভাবে তিস্তা শীতলবাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁর নিন্দা করে অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবি জানিয়েছে। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও তিস্তা সহ অন্যান্যদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগপ্রকাশ করে অবিলম্বে তাঁদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ছুতোয় গুজরাট পুলিশ যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তার তীব্র নিন্দা করেছে সিপিআই(এম)। ২৫ জুন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এক ট্যুইট বার্তায় বলেছেন, নাগরিক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের পক্ষে নিরলস লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের ওপর নিপীড়ন এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো বন্ধ করুন। তিস্তা শীতলবাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহার করুন এবং তাঁকে মুক্তি দিন।
কলকাতায় মিছিল
সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদকে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশজোড়া আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে ২৬ জুন কলকাতায় নাগরিকদের বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয়। কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের ডাকে এদিন পার্কসার্কাস মোড় থেকে একটি মিছিল বের হয়ে মল্লিকবাযার, এজেসি বোস রোড হয়ে এন্টালিবাজারে এসে শেষ হয়। এদিন বৃষ্টির মধ্যেও অসংখ্য মানুষ এই মিছিলে অংশ নেন। মিছিলকারীরা স্লোগানে, পোস্টারে, ব্যানারে গুজরাট গণহত্যার প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি ও মিথ্যা মামলায় তিস্তা শীতলবাদের মতো সমাজকর্মী ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তারের নিন্দা করে অবিলম্বে তাঁদের মুক্তির দাবি জানান।
এদিনের এই মিছিলে অংশ নেন রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, সিপিআই নেতা প্রবীর দেব, বামফ্রন্টের কলকাতা জেলা আহ্বায়ক কল্লোল মজুমদার, অভিনেতা বাদশা মৈত্র সহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও বামফ্রন্ট কর্মীরা। মিছিল শেষে মহম্মদ সেলিম বলেন, বিচারের নামে প্রহসন করে গুজরাট গণহত্যার রক্তের দাগ মোছা যাবে না, মোদি-অমিত শাহরাও নিজেদের নিরাপরাধ প্রমাণ করতে পারবেন না।