৫৯ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১ জুলাই, ২০২২ / ১৬ আষাঢ়, ১৪২৯
গণতন্ত্র নিধনের পুরনো কৌশলেই মহারাষ্ট্রে সরকার ভেঙে ক্ষমতা দখল করল বিজেপি
সন্দীপ দে
বিজেপি’র চক্রান্তে শেষ পর্যন্ত ইস্তফা দিতে হলো মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব থ্যাকারেকে। এর মধ্য দিয়ে ৩১ মাসের শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোটের মহা বিকাশ আগাড়ি সরকারের পতন হলো। বিপুল অর্থ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে আবারও পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের কদর্য নজির রাখলো বিজেপি।
বিজেপি’র নেপথ্য ষড়যন্ত্রে মহারাষ্ট্রে সরকার ভাঙার উদ্দেশ্যে বিগত কয়েকদিন ধরে ডামাডোল চলছিল। তাতে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল, উদ্ধব থ্যাকারের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী। শিবসেনার অভ্যন্তরে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে একনাথ শিণ্ডেকে ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করে বিজেপি। তার মাধ্যমে শিবসেনার একদল বিক্ষুব্ধ বিধায়ককে সামনে রেখে পিছন থেকে নানা চক্রান্ত করে উদ্ধব সরকারকে ফেলে দিতে সমর্থ হয় বিজেপি। দেখা গেছে, এই গোটা পরিকল্পনা হয়েছে দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের তত্ত্বাবধানে। তিনি বরোদায় বিদ্রোহী শিণ্ডের সঙ্গে যেমন বৈঠক করেছেন, তেমনি ২৮ জুন মহারাষ্ট্রের বিরোধী দলনেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিশের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করে সরকার ভাঙার ছক চূড়ান্ত করেন। এরপর ফড়নবিশ মুম্বাই ফিরেই রাতে রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল বিএস কেশোয়ারের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারপরই রাজ্যপাল উদ্ধব থ্যাকারেকে আস্থা ভোটের আহ্বান জানান।
রাজ্যপালের বিধানসভায় শক্তি পরীক্ষার নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল শিবসেনা। তাদের যুক্তি ছিল, যেহেতু ১৬জন বিধায়কের বিধায়কপদ খারিজের বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন, তাই ওই সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত রাজ্যপাল আস্থাভোট ডাকতে পারেননা। এরপর দীর্ঘ তিনঘণ্টার শুনানি শেষে শিবসেনার আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের অবসরকালীন বেঞ্চ এবং আস্থাভোটের পক্ষেই সবুজ সংকেত দেয়। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, বিধায়কদের পদ থাকবে কিনা, সেই শুনানি আগের ঘোষণা মতো ১১ জুলাই হবে। এর সঙ্গে আস্থাভোট না করানোর কোনো সম্পর্ক নেই। এই ঘোষণার পরই মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন শিবসেনা প্রধান উদ্ধব থ্যাকারে। তিনি নিজের বিধান পরিষদের সদস্যপদ থেকেও ইস্তফার কথা জানান।
প্রসঙ্গত, ২৮৮ আসনের মহারাষ্ট্র বিধানসভায় এই মুহূর্তে বিজেপি’র আসন ১০৭। এছাড়া পাশে রয়েছে শিবসেনার বিক্ষুদ্ধ ৩৯ জন বিধায়ক। এর পাশাপাশি প্রায় ডজনখানেক নির্দল বিধায়কের সমর্থনও বিজেপি’র পিছনে রয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে বিজেপি’র ক্ষমতা দখল শুধু সময়ের অপেক্ষা। মহারাষ্ট্রে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে চলেছেন একনাথ শিণ্ডে। এর আগে দু’বার মহারাষ্ট্রে সরকার ফেলার চক্রান্ত করে অবশেষে সফল হলো বিজেপি।
মহারাষ্ট্রের এই রাজনৈতিক ডামাডোলের পরিণতিতে ভারতীয় গণতন্ত্রে কালো দাগ আরও দীর্ঘয়িত হলো বলে মন্তব্য করেছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি বলেছেন, গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটকের পর এবার মহারাষ্ট্র। বিপুল টাকার খেলা, রাষ্ট্রযন্ত্র ও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার ব্যাপক অপব্যবহার করে দখল করা হচ্ছে সরকার।
এদিকে ২৯ জুন বিদ্রোহী বিধায়করা একনাথ শিণ্ডের নেতৃত্বে কামাখ্যা মন্দিরে পুজো দিয়ে চার্টার্ড বিমানে গুয়াহাটি ছেড়ে আশ্রয় নেয় আরেক বিজেপি-শাসিত রাজ্য গোয়ায়। সেখান থেকে তাঁরা মহারাষ্ট্রে সরকার গডতে বিজেপি’র ক্রীড়নকের ভূমিকায় পাশে এসে দাঁড়ায়।
নানা কৌশলে সরকার ফেলে দিয়ে বিজেপি’র ক্ষমতা দখলের নীতিহীন ও গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপ মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে আবারও সামনে চলে এসেছে। সেখানে উদ্ধব থ্যাকারে নেতৃত্বাধীন মহা বিকাশ আগাড়ি সরকার ভেঙে দিয়ে যেকোনভাবে ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করতে চেয়েছে বিজেপি। এই উদ্যোগে শিখণ্ডি হিসেবে ব্যবহার করেছে বিধানসভায় শিবসেনার চিফ হুইপ একনাথ শিণ্ডেকে। তিনি বিক্ষুব্ধর ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ২১ জন বিধায়ককে নিয়ে প্রথমে সুরাট এবং পরে গুয়াহাটির বিলাসবহুল হোটেলে আস্তানা গেড়ে মহারাষ্ট্রে শিব সেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোট সরকারকে ফেলার নানা ফন্দি ফিকির করে গেছেন। এর ফলে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। ঘটনার গতিপ্রকৃতিতে উদ্ধব থ্যাকারে নেতৃত্বাধীন সরকারের অস্তিত্ব নিয়েই সংকট দেখা দেয়। তবে এই ঘটনার পরিণতি এটাই স্পষ্ট করেছে যে, বিজেপি-আরএসএস’র গণতন্ত্রের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। যে কোনো মূল্যে ঘোড়া কেনাবেচা করে অনৈতিক উপায়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করাই এদের উদ্দেশ্য।
ঘটনাক্রমে লক্ষ করা গেছে, মোদি-অমিত শাহের রাজ্য গুজরাটে দলভাঙানো বিধায়কদের নিয়ে ষড়যন্ত্র সফল হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থাকায় কয়েক কোটি টাকা খরচ করে তিনবারে চার্টার্ড বিমানে একনাথ শিণ্ডে ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গুয়াহাটিতে। সেখানেও রয়েছে বিজেপি সরকার। শুধু তাই নয়, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নানা কায়দায় দল ভাঙিয়ে ‘কংগ্রেস-মুক্ত শাসন’ কায়েম করার অন্যতম কুশলী কারিগর মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে এই গোটা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব সঁপে দেন মোদি-অমিতশাহ। এদিকে হিমন্তও দিল্লির প্রভুদের কাছে তার ‘দক্ষতা’ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে যান। তাঁর বদান্যতায় গুয়াহাটির বিলাসবহুল র্যাতডিসন ব্লু হোটেলে একেবারে রাজারহালে দিনযাপন করেছেন শিবসেনার বিদ্রোহী বিধায়করা। তাঁদের পিছনে খরচ হয়েছে লক্ষ-নিযুত টাকা। অথচ এমন একটা সময় এই ঘটনা ঘটেছে, যখন বরাক উপত্যকা সহ আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভয়াবহ বন্যার প্রকোপে বিধ্বস্ত। পানীয় জল, খাবার, ত্রাণসামগ্রীর জন্য বন্যাদুর্গতরা হাহাকার করছেন। রাজ্যের ৩২টি জেলায় অন্তত ৭০ লক্ষের বেশি মানুষকে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার মহারাষ্ট্রে ক্ষমতার দখলে মত্ত হয়ে উঠেছিল। সমস্ত নীতি-নৈতিকতা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতা দখলের এই উদগ্র বাসনা বিজেপি’র ফ্যাসিস্টধর্মী মানসিকতাকেই প্রকট করেছে।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে দেখা যাবে, ২০ জুন মহারাষ্ট্রে বিধান পরিষদ ভোটে ক্রশ ভোটিং-এর জেরে বিজেপি’র কাছে একটি আসনে হেরে যায় শাসক জোট। অর্থাৎ ১০টি আসনের মধ্যে ৬টিতে জেতার কথা ছিল শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোটের। কিন্তু দেখা যায় বিজেপি এবং শিবসেনা ৫টি করে আসন ভাগাভাগি করে পেয়েছে। এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই শিবসেনার অভ্যন্তরে সন্দেহ দেখা দেয়। এনসিপি, কংগ্রেস বা ছোটো দলগুলির সমর্থন শিবসেনা প্রার্থীর দিকে থাকলেও দলের কোনো কোনো নেতা ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন বলে মনে করেন শিবসেনা নেতৃবৃন্দ। এদিকে বেশ কিছুকাল ধরে বেসুরো কথাবার্তা বলছিলেন একনাথ শিণ্ডে। তাই তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কয়েকজন বিধায়ক বিজেপি-কে ভোট দিয়েছেন বলে ধারণা হয় শিবসেনা নেতাদের।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২১ জুন তড়িঘড়ি পরিষদীয় দলের বৈঠক ডাকেন উদ্ধব থ্যাকারে। সেই বৈঠকে একনাথ শিণ্ডে সহ ২১ জন বিধায়ক অনুপস্থিত থাকেন। খবর আসে শিণ্ডে তাঁর অনুগত বিধায়কদের নিয়ে সুরাটের হোটেলে গিয়ে উঠেছেন। এর মধ্যে বিধানসভায় দলের চিফ হুইপ পদ থেকে শিণ্ডেকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে। এদিকে দলের দুই বিধায়ককে সুরাটে পাঠানো হয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি।
এরপর ২২ জুন গভীর রাতে সুরাট থেকে ১৮৯ আসনের স্পাইসজেটের একটি বিমান নামার ঘণ্টাখানেক পরেই মধ্যপ্রদেশের ভোপাল থেকে ৮ আসনের একটি বিজনেস জেট বিমান গুয়াহাটি বিমান বন্দরে নামে। এছাড়াও এদিন সকালে আরও একটি বিজনেস জেট বিমান সুরাট থেকে গুয়াহাটিতে আসে। সংবাদ মাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী শুধু উড়ানে বিধায়কদের যাতায়াতের জন্যই খরচ হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা।
মহারাষ্ট্রের এই বিদ্রোহী বিধায়কদের আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ব্যবস্থাপনায় এনে রাখা হয় গুয়াহাটির বিলাসবহুল র্যাধডিসন ব্লু হোটেলে। মোদি-অমিত শাহ সহ বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাদের ‘অপারেশন কমল’-এর দায়িত্ব হিমন্তের উপর ছেড়ে দেবার অন্যতম কারণ ছিল— মহারাষ্ট্র সংলগ্ন ‘কমলশাসিত’ রাজ্য নেই। তাছাড়া গুয়াহাটি বা কাজিরঙায় হোটেল-রিসর্টে বিধায়কদের রেখে উত্তর-পূর্বের সরকার ভাঙা-গড়ায় প্রধান মস্তিষ্ক, কুশলী কারিগর হচ্ছেন হিমন্ত নিজে। তাঁর নেতৃত্বেই নর্থ-ইস্ট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স গড়ে ওঠে এবং নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশে বিধায়ক ভাঙিয়ে নানা কৌশলে বিজেপি সরকার গড়ে উঠেছে। ত্রিপুরার ভোটেও তাঁকেই কাজে লাগানো হয়েছিল। কাজেই ‘কংগ্রেস-মুক্ত উত্তর-পূর্ব’ গড়ায় তাঁর যে মুন্সিয়ানা তাকেই এবারে কাজে লাগাতে চেয়েছে বিজেপি। তবে এবারে মহারাষ্ট্রের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে দল ভাঙানোর খেলায় তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে তাঁর প্রতি বিপুল আস্থা দেখালো বিজেপি।
এছাড়া গুয়াহাটিকে এই ‘অপারেশন কমল’-এর জন্য বেছে নেবার আরও একটি কারণ হলো, এখানে কংগ্রেস বা অন্যান্য বিরোধী দল অপেক্ষাকৃত দুর্বল। গুয়াহাটিতে বিদ্রোহী বিধায়কদের রাখলে বিরোধীদের পক্ষে বিক্ষোভ দেখানো বা যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না।
সংবাদ মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে, গুয়াহাটির হোটেল র্যা ডিসনের ৭০টি ঘরে ৩৪ জন বিধায়ককে রাখা হয়। গোটা হোটেলটিকে নিশ্চ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়। শোনা গেছে, এই বিরোধী বিধায়কদের একেকজনের দর উঠেছে দশ কোটি টাকা! এরা হোটেলে আরাম আয়েশে থেকেছেন, মাঝে মাঝে রাজ্যের মন্ত্রীরা এসে দেখভাল করে গেছেন। আবার বিদ্রোহীদের দলপতি একনাথ শিণ্ডে মাঝে মধ্যে নিভৃতে চার্টার্ড বিমানে সুরাট উড়ে গিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে ছক কষে এসেছেন। এভাবেই সরকার ভাঙার খেলায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কোটি কোটি টাকা জলের মতো খরচ করেছে।
এই ঘটনার প্রক্ষিতে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নেতৃত্বাধীন আসামের বিজেপি সরকারের যে ভূমিকা তাতে তাদের অমানবিক ফ্যাসিস্ট সুলভ মানসিকতা প্রকট হয়ে উঠেছে। একমাসের মধ্যে পরপর দু’বারের বন্যায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের কবলে পড়ে রাজ্য। রাজ্যে ৩৫টি জেলার মধ্যে অন্তত ৩২টি জেলা বন্যা কবলিত। বানভাসি মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৭০ লক্ষেরও বেশি। মৃতের সংখ্যা ১১০। হাজার হাজার গবাদি পশু মারা গেছে। ১ লক্ষ হেক্টরের বেশি কৃষি জমি জলের তলায় চলে গেছে। আসামের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শিলচর জলমগ্ন থেকেছে দীর্ঘদিন। ত্রাণসামগ্রী, খাবার বিশেষ করে পানীয় জলের সংকট তীব্র আকার নিয়েছে শিলচর শহরে। অবস্থা এতটাই সঙ্গীন হয়েছে যে, ত্রাণ শিবির খোলারও জায়গা মেলেনি। মৃতদেহ সৎকার করার জায়গা এবং শবদেহ নিয়ে যাবার মতো নৌকা পর্যন্ত মেলেনি। বাড়ির ছাদে, রেল লাইনের ধারে মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এমনই একটি সংকটজনক অবস্থায় আসামের মৎস্য মন্ত্রী শিলচরেরই বাসিন্দা পরিমল শুক্ল বৈদ্য একফুটেরও কম জলে নৌকা বিহার করেছেন। এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। কিন্তু মন্ত্রী নির্বিকার।
হোজাই শহরে টাকার বিনিময়ে বন্যাদুর্গত মানুষদের ত্রাণ কিনতে হয়েছে। ত্রাণ বণ্টনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বক্তব্য ছিল, সরকার ত্রাণ বিলির জন্য পরিবহণ খরচ দেয়নি, তাই পরিবহণ খরচ বাবদ এই টাকা নেওয়া হয়েছে। একই অভিযোগ উঠেছে বজালি জেলায়।
এদিকে বন্যা মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সব দায় চাপিয়ে দিয়েছেন মানুষের ঘাড়ে। তিনি হেলিকপ্টার বিহার করে জলমগ্ন শিলচর শহর দেখার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, এবারের বন্যা নাকি মানুষের সৃষ্টি। বিপুল অর্থ খরচ করে ‘নমামি ব্রহ্মপুত্র’-এর মতো ‘নমামি বরাক’ উৎসব করেও কেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা গেল না — এই প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী বন্যা মোকাবিলায় সব দায় মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে এমনও বলেছেন, বন্যার সময় সরকার মানুষকে কেবল উপদেশ দিতে পারে। মানুষকে নিজের জীবন নিজেকেই রক্ষা করতে হবে।
মানুষের ভয়াবহ বিপন্ন মুহূর্তে তাঁদের উপর সব দায় চাপিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ২৪ জুন মহারাষ্ট্র নিয়ে ঘোঁট পাকাতে দিল্লি পাড়ি দেন। সন্ধ্যায় বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার বাসভবনে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। এভাবেই আসামবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকার।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, বন্যাবিধ্বস্ত আসামকে কোনো আর্থিক সাহায্য করেনি কেন্দ্রের মোদি সরকার। অথচ আসামের বন্যা নিয়ন্ত্রণে অনেক প্রতিশ্রুতি বিলিয়েছিলেন মোদি। উলটে কোটি কোটি টাকা খরচ করে মহারাষ্ট্রের শিবসেনার বিদ্রোহী বিধায়কদের নিজেদের হেপাজতে রেখে হিমন্তকে দিয়ে চক্রান্ত করতেই মগ্ন থেকেছেন মোদি। এর আগে বন্যা মোকাবিলার কাজ ফেলে হিমন্ত ত্রিপুরা ছুটেছেন উপ-নির্বাচনের প্রচারে। গত বছরের বন্যায় ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্য সরকার কেন্দ্রের কাছে ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার দাবি জানিয়েছিল। কেন্দ্র দিয়েছে মাত্র ৪৫ কোটি। এর আগের বছরগুলিতেও ৪০ থেকে ৫০ কোটির বেশি দেয়নি। এবারেও সাহায্যের ছিটে ফোঁটাও আসেনি। এই সমস্ত ঘটনার মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকা, বিপন্নতা কোনো বিষয় নয়, বিজেপি’র মূল লক্ষ্য ক্ষমতা দখল।
মহারাষ্ট্রে শিবসেনার বিদ্রোহী বিধায়কদের সামনে রেখে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের যে তৎপরতা, চক্রান্ত চলছে তা বিজেপি’র পুরনো কৌশল। ওরা আগে এমন ন্যক্কারজনক নজির রেখেছে গোয়া, কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশে। বিজেপি ক্ষমতা দখলের উদগ্র বাসনায় গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দেবার পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতাকেও বিসর্জন দিয়েছে। নির্বাচনের আগে বিপুল প্রতিশ্রুতি দেয়, তারপর নির্বাচনে পরাজিত হলেই কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিধায়ক কেনা-বেচা করে ক্ষমতা দখলে প্রবৃত্ত হয় বিজেপি।
মহারাষ্ট্রের উদ্ধব থ্যাকারে সরকার ভাঙতে বিজেপি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে— এই অভিযোগ করে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে গণতন্ত্রকে খর্ব করতে রাষ্ট্রশক্তির এই অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষকে প্রতিবাদে শামিল হবার আহ্বান জানিয়েছে।
মহারাষ্ট্রে সম্প্রতি বিজেপি’র সেই পুরনো কু-নাট্যেরই মহড়া চলেছে। আগামী দু’একদিনের মধ্যেই মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতি প্রকৃতি স্থির হবে। তাতে উদ্ধব থ্যাকারে নেতৃত্বাধীন মহা বিকাশ আগাড়ি সরকারকে পতন ঘটিয়ে বিজেপি রাজ্যের মসনদে বসলেও তাদের সংবিধান-নীতিনৈতিকতা ও গণতন্ত্রকে পদদলিত করার কুৎসিক চেহারাটাই আবারও প্রকট হয়ে উঠবে।