৫৯ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১ জুলাই, ২০২২ / ১৬ আষাঢ়, ১৪২৯
নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের প্রশ্নের মুখে ভারসাম্য হারালেন মুখ্যমন্ত্রী
আসানসোলে চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্নের মুখে মুখ্যমন্ত্রী।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ অস্বস্তি কিছুতেই কাটছে না মমতা ব্যানার্জির। এসএসসি সহ নিয়োগ দুর্নীতির একের পর এক ধাক্কায় তার ‘নেই পরোয়া’ ভানের ভেক ধরা পড়ে যাচ্ছে। ধরা পড়ে যাচ্ছে ভরা জনসভায় তাবড় তাবড় অনুপ্রাণিত সংবাদ মাধ্যমের টিভি ক্যামেরার সরাসরি সম্প্রচারের সামনে জবাবদিহি করতে গিয়ে তৃণমূলীদের ভিড়ে ভরা সভায় পরপর দু’দিন বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের বিক্ষোভ আন্দোলনের ঠ্যালায় তাঁকে উত্তর দিতে হলো। উত্তর দিতে হলো হাতে গোনা জনাকয়েক বিক্ষোভকারীর চাকরি চাওয়ার আরজির। তাতেই আরও চটেছেন তিনি ভারসাম্য হারিয়ে। ওদিকে সিবিআই’র পর এসএসসি কাণ্ডে ইডি’র তদন্তও শুরু হওয়াতেও চাপ বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, ২৭ তারিখের বর্ধমান শহরের গোদার মাঠের সভায় টেট-উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের চাকরির দাবির পর ২৮ জুন আসানসোলেও প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ঘটনা ঘটায় কয়েকজন এসএলএসটি চাকরিপ্রার্থী। মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর গুলিয়ে দেওয়া জবাবে নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে কোনো অনুশোচনা ছিল না। তবে চাকরি নিয়ে যে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও চাকরি বিক্রির সঙ্গে তাঁর দলের নেতা ও মন্ত্রীরা জড়িয়ে আছেন তা এড়িয়ে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
চাকরির দাবি করা প্রার্থীদের দেখামাত্রই মমতা মঞ্চ থেকে তাঁদের বসতে নির্দেশ দেন। তবে সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন থাকায় অপ্রিয় প্রশ্ন অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাননি মমতা ব্যানার্জি। তিনি সরাসরি অভিযোগ করেন, বিজেপি এবং সিপিএম তাঁদের পাঠিয়েছে! চাকরিপ্রার্থীরা জানান, তাঁরা শুধু কাজের কথা বলতেই এসেছেন। যার উত্তরে উত্তেজিত অবস্থায় তিনি বলেন, ১৭ হাজার চাকরি রেডি।... আমি তো কোর্টে যাইনি আপনারা গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন বিকাশবাবুকে (সিপিআইএম নেতা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য) গিয়ে বলুন আপনি কেস করে আমাদের চাকরি বন্ধ করেছেন, আপনি ব্যবস্থা করে দিন।
বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বলেছেন, মেধা তালিকা মেনে স্বচ্ছভাবে নিয়োগ হয়নি। ১৭ হাজার এবং তার বেশি যারা নিয়োগপত্র পেয়েছেন তৃণমূলের ধামা ধরে এবং টাকা নিয়ে। ...সে জন্য যারা যোগ্য প্রার্থী তারা আদালতে গিয়েছেন। আদালতে আমি যাইনি, তাদের হয়ে আমি এবং আমার জুনিয়রেরা সওয়াল করেছি যেটা আমাদের নৈতিক দায়। দুর্নীতি দেখলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করাটা স্বাভাবিক কাজ। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, ১৭ হাজার চাকরি যদি দিতে হয় উনি ওখান থেকে সরে যান। আমরা গিয়ে নিয়ম মেনে মেধার ভিত্তিতে ১৭ হাজার জনকে চাকরি দেব, শুধু মাত্র ১৭ হাজার নয় যে পরিমাণ শূন্যপদ ঘোষণা করা হয়েছে সেই সমস্ত পদে।
২৮ জুন বেআইনি শিক্ষক নিয়োগ মামলায় ঘুষ সংক্রান্ত আর্থিক যোগের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এফআইআর করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। শিক্ষক এবং অশিক্ষককর্মী নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টের মামলায় চাকরির বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। সেই দিশায় এ বার তদন্ত শুরু ইডি’র। আগেই কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তভার হাতে নিয়েছে সিবিআই। এবার সেখানে যুক্ত হলো আরেক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। আপাতত স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একটি এফআইআর দায়ের করেছে ইডি।
২৭ জুন মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতার বিরুদ্ধে বেআইনি নিয়োগের অভিযোগ করে মামলায় জয়ী ধূপগুড়ির ববিতা সরকার চাকরি পাওয়ার প্রথম ধাপ পেরলেন। আদালতের নির্দেশে অঙ্কিতার চাকরি পেয়েছেন তিনি। এই নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তার নেওয়া বেতনের প্রথম কিস্তি ৭ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা ইতিমধ্যেই আদালতের রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দিয়েছেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর কন্যা অঙ্কিতা। ইন্টারভিউ না দিয়ে সমস্ত রকমের বিধি ভেঙে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে তপশিলি জাতিসংরক্ষিত কোটায় মন্ত্রীকন্যা চাকরি পেয়েছিলেন, পৌঁছে গিয়েছিলেন মেধা তালিকার শীর্ষে।
ববিতার মতো অন্যান্য মামলাকারী যে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন, তার তদন্ত শুরু করেছে ইডি। এর জন্য ববিতাকে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারেন তাঁরা। কোনও তথ্যপ্রমাণ ববিতা-সহ অন্যান্য মামলাকারীর কাছে আছে কি না, সেটাও তদন্ত করা হবে বলে ইডি সূত্রে খবর। এর আগে ১৭ জুন ২৬৯ জনের বেআইনি নিয়োগ মামলায় শুধু প্রাথমিক নয়, শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মী নিয়োগের দুর্নীতির সব অভিযোগের তদন্ত করবে সিবিআই-এর বিশেষ দল এই নির্দেশ দেওয়া হয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়-এর এজলাস থেকে। তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগা প্রসঙ্গে দ্রুততর তদন্তের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেছে, আবার একটা সারদা হোক এটা আমরা চাই না। অন্যদিকে, প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক ও মন্ত্রী উপেন বিশ্বাস আদালতে উপস্থিত থেকে বলেছিলেন যে ...এই তদন্ত করা উচিত আদালতের নজরদারিতে।
আবার কমিশনের অন্দরে দুর্নীতির বাসা বাঁধার ইঙ্গিত দিয়ে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্যও করেছেন মামলা প্রসঙ্গে। বিশেষ করে কমিশনের সদস্য এবং কর্মীদের কেউ কেউ যে নিজেদের নিকটাত্মীয়দের চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন, তাও কার্যত স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। ‘কমিশনের এক সদস্য তাঁর বোনকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন’ বলে উল্লেখ করে বিচারপতি হুঁশিয়ারি দেন, অভিযুক্তদের ‘এর ফল ভুগতে হবে’।
১৯ জুন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলির নিয়োগ যথাযথভাবে হয়েছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত শুরু করে সিবিআই। পর্ষদ সভাপতি নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় নথি তাঁদের দপ্তরে জমা দেবার নির্দেশ দেয় সিবিআই। একই সঙ্গে ১৬টি প্রশ্ন তৈরি করে পর্ষদের কাছ থেকে জবাব চাওয়া হয় এবং নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল, সিডি, পেনড্রাইভ সহ সব নথি জমা দিতে বলা হয় বলে সংবাদে প্রকাশ। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের ১৮ মে-র মধ্যে শিক্ষা কর্মী নিয়োগের মেধা তালিকা স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে এসেছিল কিনা তা বিশদে জানতে চেয়েছে সিবিআই।
এর আগে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের অনুসন্ধান কমিটি তার রিপোর্টে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলির দিকে নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ করেছে।
২০ জুন দুর্নীতির মামলায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি তৃণমূলের বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে পর্ষদের সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করে হাইকোর্ট। রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০১৪ সালে টেট-এর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। এই বিজ্ঞপ্তি জারির পর ২০১৫ সালে প্রায় ২৩ লক্ষ পরীক্ষার্থী এই পরীক্ষায় বসেছিলেন। পরীক্ষার প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে প্যানেল তৈরি হয় এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৪২ হাজার প্রার্থীকে নিয়োগপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে বহু মামলা হয়। আদালত বারবার স্বচ্ছতার কথা বললেও তা মানা হয়নি।