৫৯ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১ জুলাই, ২০২২ / ১৬ আষাঢ়, ১৪২৯
কয়লা-গোরু পাচার দুর্নীতির তদন্তে সিজিও কমপ্লেক্সে অবশেষে হাজিরা দিলেন অভিষেক-জায়া
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ১৭ জুনের পর আটদিনের ব্যবধানে ২৪ জুন কয়লা পাচার কাণ্ডে আবার কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের জেরার মুখে পড়লেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক বানার্জির স্ত্রী রুজিরা নারুলা ব্যানার্জি। এই প্রথম কয়লা পাচার কাণ্ডের জেরায় তদন্তকারী সংস্থার সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে হাজির হন তিনি। সিবিআই’র তরফে এর আগে দু’-দু’বার তাঁকে জেরা করা হয়েছিল হরিশ মুখার্জি রোডে ‘শান্তিনিকেতন’ ভবনে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র তলবে এদিন প্রায় ছয় ঘণ্টা দফায় দফায় জেরা চলে রুজিরা নারুলা ব্যানার্জির। কোলে দু’বছরের পুত্রসন্তানকে নিয়েই হাজিরা দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, কয়লা পাচারের অভিযোগে ধৃত, বর্তমানে জামিনে মুক্ত বাঁকুড়া থানার আইসি অশোক মিশ্র অভিষেক ব্যানার্জীর ঘনিষ্ঠ তৃণমূল যুব নেতা ফেরার বিনয় মিশ্রর আত্মীয়। পাচার সংক্রান্ত একটি মামলায় আদালতে ইডি’র দেওয়া বিস্তারিত তথ্যে সামনে আসে নানা চাঞ্চল্যকর দিক। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ১০৯ দিনে বিপুল পরিমাণ ১৬৮ কোটি টাকার সই করা ভাউচার মিলেছিল। ইডি’র সূত্র বলছে, তার সিংহভাগ টাকা যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক ( তৎকালীন) বিনয় মিশ্রর নির্দেশে হাওলার মাধ্যমে যায় মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জীর স্ত্রী এবং শ্যালিকার অ্যাকাউন্টে। এই বিপুল আর্থিক লেনদেন হয়েছে ২০২০ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এককথায়, বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ঘুরে কয়লা পাচারের কোটি কোটি টাকা গিয়েছে রাজ্যের শাসকদলের অন্যতম ক্ষমতাবান সাংসদের স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে, অভিযোগ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র।
রুজিরা নারুলা ব্যানার্জিকে জেরার পরিপ্রেক্ষিতে খোদ মুখ্যমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ঘরের বউকেও চোর বলা হচ্ছে! এমনকী গত বিধানসভা ভোটের আগে ফেব্রুয়ারি মাসে হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে সিবিআই জেরার আগে মুখ্যমন্ত্রী রুজিরা নারুলা ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করে তাঁর ‘মনোবল’ বাড়াতে গিয়েছিলেন। আবার গত বছর ভাইপোকে তলবের ঘটনায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, কয়লা চুরির ক্ষেত্রে শুধু তৃণমূলকে ধরলে হবে? তৃণমূলের দায়িত্বে কয়লা নেই। কয়লা তোমার সিআইএসএফ-এর দায়িত্বে, কেন্দ্রের মন্ত্রকের হাতে। তোমার মন্ত্রক কি করছিল?...।
দিল্লি আদালতে হাজিরা সংক্রান্ত মামলায় রুজিরা ব্যানার্জি আবেদন করেছিলেন করোনার সময় বাড়িতে শিশু সন্তান রেখে তিনি দিল্লিতে ইডি অফিসে হাজিরা দিতে পারবেন না। কলকাতায় জেরা করা হোক তাঁকে। অভিষেক ব্যানার্জি দিল্লিতে দু’বার ইডি’র জেরায় হাজির হলেও রুজিরা ব্যানার্জি জেরা এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
এদিন (২৪ জুন) দু’বছরের সন্তানকে নিয়ে কেন জেরায় আসতে হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, শিশুদের দেখভালের ব্যবস্থা রয়েছে বাড়িতে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, আদালতে পিটিশনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই কি তবে কোলে দু’বছরের সন্তানকে নিয়ে সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি করতে হাজিরা দিলেন অভিষেক-পত্নী? সে সম্ভাবনা অমূলক নয় বলেও মনে করা হচ্ছে।
ইডি সূত্রে জানা গেছে, মূলত বিদেশে ব্যাঙ্কে তাঁর অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন, মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়েই তাঁকে জেরা করা হয়েছে। তাঁর অ্যাকাউন্টে কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার টাকা ঢুকেছিল একাধিক গন্তব্য ঘুরে। সেই অ্যাকাউন্টের চেক, পাশবইয়ের কপি হাতে নিয়ে তাঁকে জেরা করা হয়। দিল্লি থেকে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের একটি তদন্তকারী দলও এদিন কলকাতায় এসে পৌঁছায়। ইডি’র যুগ্ম অধিকর্তার নেতৃত্বে এই তদন্তকারী দলও জেরা করে। এদিন জেরায় অধিকাংশ প্রশ্নই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন রুজিরা নারুলা ব্যানার্জি। একাধিক অসঙ্গতিও রয়েছে তাঁর বক্তব্যে, জানা গেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার একটি সূত্রে।
ঘটনার গতি প্রকৃতি দেখে ওয়াকিবহাল মহলের পর্যবেক্ষণ, কয়লা পাচার কাণ্ডে তদন্তের জাল ক্রমশ তরান্বিত করছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। এই মামলায় তদন্তকারীদের মুখোমুখি হয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি গরু পাচার-কাণ্ডেও সক্রিয়তা দেখাচ্ছে সিবিআই। এই মামলায় ইতিমধ্যেই বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকেও জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েছে সিবিআই। শত কোটি টাকার মালিক সেহগাল হোসেন, তাঁর দেহরক্ষীও এখন একই অভিযোগে সিবিআই হেফাজতে। আবার বিনয় মিশ্রের সন্ধান দিলেও পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। পর্যবেক্ষক মহলের একাংশের মতে, ধারেভারে এই দুই ‘হেভিওয়েট’ মামলার তদন্তের মধ্যেই ইস্ট জোনে সিবিআই-এর যুগ্ম অধিকর্তা বদল উল্লেখযোগ্য।
২৪ জুন সকাল এগারোটা নাগাদ সিজিও কমপ্লেক্সে ইডি দপ্তরে পৌঁছান রুজিরা নারুলা ব্যানার্জি। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত চলে কয়েক দফায় জেরা। আটদিন আগে সিবিআই’র প্রায় সাত ঘণ্টা জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। ইডি’র একটি সূত্রে জানা গেছে আয়কর দপ্তরের সঙ্গে যৌথ তল্লাশি থেকে পাওয়া নথি এবং ডিজিটাল এভিডেন্স থেকে দেখা যায়, ইতিমধ্যে কয়লা পাচার কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া বাঁকুড়া থানার আইসি অশোক মিশ্রের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কে (সিয়াম প্যারাগন ব্রাঞ্চ) রুজিরা নারুলা ব্যানার্জির অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছেছিল। কয়লাকাণ্ডে অশোক মিশ্র ও বিনয় মিশ্রের মতোই ফেরার নীরজ সিংয়ের কথোপকথনের ডিজিটাল প্রমাণ হাতে আসে তদন্তকারী সংস্থার। তাতে দেখা যায় ২০১৮সালের নভেম্বর মাসে অশোক মিশ্রের মাধ্যমে নীরজ সিং দেড় মিলিয়ন ভাট (থাই কারেন্সি) ট্রান্সফার করে। এই নীরজ সিং কয়লা মাফিয়া লালার হিসাবরক্ষক ছিলেন। এখনও পলাতক। ইডি সেই নথি দেখিয়েই এদিন রুজিরাকে জিজ্ঞাসা করেন, ওই অ্যাকাউন্ট কি তাঁর? কেন তাঁর অ্যাকাউন্টে কয়লা মাফিয়ারা টাকা পাঠাতো? তাঁর সঙ্গে কী যোগ? সূত্রের খবর, বর্তমানে জামিনে থাকা পুলিশ আধিকারিক অশোক মিশ্র আবার ভাইপো ঘনিষ্ঠ ফেরার বিনয় মিশ্রের আত্মীয় হন। তাঁর মাধ্যমেই এই লেনদেন হতো। শুধু থাইল্যান্ডের অ্যাকাউন্টে নয়, লন্ডনের বার্কলেজ ব্যাঙ্কেও রজিরা ব্যানার্জির অ্যাকাউন্টে কয়লার টাকা ঢুকেছিল।