E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১ জুলাই, ২০২২ / ১৬ আষাঢ়, ১৪২৯

মৌলবাদী জাগানোর চেষ্টা চলছে - সাধু সাবধান

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


চারদিকের পরিস্থিতি এটাই দাবি করছে ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ শব্দগুলো নিয়ে সিরিয়াস চর্চা বাড়াতে হবে। কোনরকম গা-ছাড়া মনোভাব নিয়ে নয়, খুব সূক্ষ্ম ও সচেতনভাবে সংহতি রেখে কাজটা করতে হবে। মানুষের সামনে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিটা তুলে ধরার সময় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যেন ভেবে না ফেলেন তাদের ‘ধর্ম’কে বা ‘ধর্মবিশ্বাস’কে অসম্মান বা অবহেলা করে কথা বলা হচ্ছে। চরম বঞ্চনা, শোষণের ধারাবাহিক শিকার এই মানুষগুলোর আত্মার খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলো ধর্মকে ঘিরে কাটানো সময়গুলো। এদের জীবনে নির্ভর করার মতো সাহায্যের বড়োই অভাব, এদের জীবনের অন্ধকারের মধ্যে আলো জ্বালানোর পথ দেখানোর সমাজব্যবস্থা যতদিন না গড়ে তোলা যাচ্ছে, ততদিন এরা বেঁচে থাকার জন্য ধর্মকে সাথে নিয়েই বাঁচবেন। যদিও সুবিধাভোগীদের হাতে পড়ে শাসন, শোষণ ও প্রবঞ্চনার হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহৃত হয়ে চলেছে ধর্ম।

কেউ বলেন রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহারকে সাম্প্রদায়িকতা বলা যায়। ধার্মিক মানুষ মৌলবাদী মানুষের মধ্যে পার্থক্য এটাই - ধার্মিক মানুষ তাদেরকে বলা যায় যারা নিজের ধর্মের প্রতি অনুগত হলেও অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করতে শেখেননি। অন্যদিকে, মৌলবাদী মানুষ তারাই যারা অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করতে শিখেছেন। মৌলবাদী তারাই যারা সব সময় অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে চলেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। “অন্যের ধর্মবিশ্বাসের উপর আঘাত করা বা তাকে নিজের ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করাই সাম্প্রদায়িকতা। এর সংগঠিত রূপ হলো মৌলবাদ। মৌলবাদীরা দাবি করে সমাজের ও ব্যক্তির মঙ্গলের জন্যই ধর্মের অনুশাসনের দ্বারা তারা মানুষ তথা সমাজকে পরিচালিত করে। তারা দাবি করে ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা তারা যেভাবে করবে সেই ধর্মাবলম্বী মানুষকে সেভাবেই নীতিগুলি মেনে চলতে হবে।’’(১) তাই মৌলবাদের সমালোচনা করলে তাকে কখনোই কোনভাবেই ধর্মের সমালোচনা বলে চিহ্নিত করা যায় না।

মৌলবাদী বলতে শুধুমাত্র ধর্মের সাথে যুক্ত মৌলবাদীদের কথাই আমরা আলোচনা করতে অভ্যস্ত। এই প্রবন্ধেও আমাদের আলোচনাও সেই পরিসরেই সীমাবদ্ধ রাখব। যদিও দৈনন্দিন জীবনে ধর্মীয় মৌলবাদী ছাড়াও অজস্র রকমের মৌলবাদীদের হাতে মানুষকে পদে পদে অপদস্থ হতে হয়, অবিচারের শিকার হতে হয়, লড়তে হয়। যুগে যুগে এই সব মৌলবাদী শক্তির হাতে কতশত গুণী, সাধক মানুষকে অতলে হারিয়ে যেতে হয়েছে তার সীমা পরিসীমা নেই। আবার ফিনিক্সের মতো জেগে উঠেছে মানুষ।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও রাজ্যেরও ছোটো ছোটো পকেটে ধর্মীয় মৌলবাদীদের তৎপড়তা চোখে পড়ছে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে তারাও নানারকম ভঙ্গিমায় নিজেদের সাজিয়ে যুগোপযোগী উপাচার নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ভাব ও ভঙ্গিমা যাই থাক এগুলো হলো আসলে মানুষের মাথার আর মনের দখল নেবার কর্মসূচি। এর যেমন কিছু তাৎক্ষণিক লক্ষ্য আছে, তেমনি কিছু দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য আছে। বিগত কয়েকদিন ধরে সমাজ মাধ্যমের মেসেজগুলোর ধরনগুলোও বদলে যেতে শুরু করেছে। চায়ের দোকানে, বাসে, ট্রেনে, স্টেশনে, গাড়ির কামরায়, গ্রামের রকে, পুজোর দালানের আড্ডায় বসা মানুষগুলোর মগজেও ঝড় ওঠানোর কাজে নিযুক্ত পেশাদার কর্মীদের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে, যাতে মানুষ মূল্যবৃদ্ধি, কর্মহীনতা, দুর্নীতি, শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, গণতন্ত্র ভেঙে পড়া নিয়ে ভাবতে ভুলে যায়; ভাবতে শুরু করে মুসলমানরা কত খারাপ অথবা হিন্দুরা কত খারাপ সেই নিয়ে। যদিও দিন আনতে পান্তা ফুরনো খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষক-মজুর হাড়ে হাড়ে বুঝছেন সময়টা কত খারাপ। বাজারে জিনিসপত্রের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে, বিগত প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে কর্মসংস্থানের অবস্থা সর্বনিম্ন, চারদিকে খুন-জখম বেড়েই চলেছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ‘অগ্রাধিকার ক্ষেত্র’ মূল্যায়নে দূরদর্শিতার অভাব, অতিমারী ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা, সামাজিক শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত, গণতন্ত্র হারিয়ে যাওয়া, বিচারব্যবস্থাকে অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলা ইত্যাদি। এত কিছু অসুবিধা সত্ত্বেও মানুষ প্রতিক্রিয়া খুব কমই দেখায়।

কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদী আগ্রাসন এতটাই শক্তিশালী যে, নিজেদের একবেলা খাবার না পাবার সম্ভাবনা সহ সব ধরনের জীবন যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে একমাত্র শত্রু ভাবতে শুরু করে তাকে আক্রমণ করতে শুরু করে দেয়। অনেক মানুষ মৌলবাদীদের ঢুকিয়ে দেওয়া সম্মোহনী কথাগুলোকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, অনেকের ভাবার ক্ষমতা থাকে না - মানুষ রোবটের মতো হয়ে পড়ে। এই কারণেই বহুজাতিক পুঁজির অর্থে দেশে দেশে মানুষের মন দখলের উদ্যোগ শুরু হয়েছে কয়েক দশক ধরে। রীতিমতো ব্যয়বহুল গবেষণার মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এই কাজ বিশ্বজুড়ে নানান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিঃশব্দে হয়েই চলেছে। পরিবেশ পরিস্থিতি নিঃশব্দে পরিকল্পনামাফিক এমনভাবে তৈরি করা হয় দীর্ঘদিন ধরে, যাতে টার্গেট গ্রুপের মানুষরা আগেই সমাজের অন্য অংশের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। প্রয়োজনে তাদের ডাকে যেন সমাজের অন্যদিক থেকে কোনো সাহায্য না আসে। যেমন ধরা যাক, মুসলমানরা বা হিন্দুরা খারাপ বলে যারা কানের কাছে সব সময় ঘ্যান ঘ্যান করে তারাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও উপরে উল্লেখিত নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠেন।

৯০-র দশক। বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। সেই সময় কয়েকজন গবেষক চা খাচ্ছি ইউনিয়ন ঘরে। এমন সময় বিধায়ক মিলি এসে বলল, ‘‘জানিস তো এই ছবিটাই সারা ভারতের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মর্মবস্তু। সাধারণ মানুষ এই ভাবেই মিলেমিশে একসাথে বাঁচতে চায়, থাকতে চায়। কিন্তু অপরিণামদর্শী রাজনীতির মানুষরা তাদের আলাদা করে রেখেছে”। তোদের যেমন আলাদা করে বোঝা যায় না - কার নাম জিয়াউল, কার নাম সুনু আর কার নাম বিশ্বম্ভর, ঠিক তেমনি একই ভাঁড়ে চা ভাগ করে খেয়ে যাদের দিনযাপন, একই মণ্ডপে কাজের শেষে সন্ধ্যায় গল্প করে যাদের দিন কাটে, একই অর্থনৈতিক নীতির পাল্লায় পড়ে যাদের দু’বেলা ভাত জোটে না - তাদের কাছে হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রিস্টান আলাদা কোনো সত্তা হয়ে ওঠার সুযোগ কোথায়!

চারদিকের আধো-অন্ধকারের পরিবেশ থেকে মানুষকে উদ্ধার করতেই হবে। তাই মানুষ যাদের কাছে শুধুই ভোট, তারা ভোটের বাক্সের হিসাব করুক। দেশরক্ষার দায়িত্ব রয়েছে যাদের-তারা মানুষের পাশে থাকুন, রাস্তায় থাকুন, ময়দানে থাকুন, মিছিলে থাকুন, কলমে থাকুন, মাউসে থাকুন - তাহলেই হবে। বন্ধুবৃত্ত বাড়াতে বাড়াতে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টাটা শুরু হোক আরও গতিতে। যোগাযোগের মাত্রায় কম-বেশি থাকতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘কাছের মানুষ ঘরের মানুষ’ হয়ে ওঠার সাধনাই সমস্যার সমাধানের দিকে নিশ্চিত করেই এগিয়ে দেবে। একইসঙ্গে যুক্তিতে শান দেওয়া দরকার সকলের - না হলে প্রত্যেকেরই মনের কোণে বসে থাকা মৌলবাদীরা কখন যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে গ্যারান্টি নেই। দেশজুড়ে মৌলবাদী জাগানোর চেষ্টা চলছে - সাধু সাবধান।