৫৯ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১ জুলাই, ২০২২ / ১৬ আষাঢ়, ১৪২৯
ভারতের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও তার সমাধান
আবুবকর সেখ
দেশের দৃশ্যমান ঘটনাবলির দিকে তাকালেই যে কোনো ব্যক্তির উপলব্ধি হবে যে, ইতিহাসের খুব খারাপ সময়ের মধ্যে আমরা রয়েছি। যাঁরা যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্কতায় বিশ্বাস করেন - যেমন দাভোলকর, পানসারে, কালবুর্গী - তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। গো-রক্ষার নামে মোহাম্মদ আখলাককে হত্যা করা হয়েছে। ‘তেরা নাম মোহাম্মদ’ - শুধু মুসলিম নাম হওয়ার অপরাধে এক প্রবীণকে হত্যা করা হলো ভোপালে। প্রাচীন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে রাম মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহল ও জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে বিকৃত প্রচার চালানো হচ্ছে। উত্তর প্রদেশ ও গুজরাটের পর দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীতে বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের দোকান, বাড়ি এমনকী মসজিদের দরজা পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন ভারতের ইতিহাস নতুন করে আবার লেখা হবে। সিএএ, এনআরসি এবং এনপিআর-এর হুমকি তো আছেই। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে শিক্ষায়তনে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বাতিল করা হয়েছে। দেশে অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌরাণিক কাহিনি পড়ানো হচ্ছে। প্রগতিশীল বিজ্ঞান ভাবনা থেকে পড়ুয়াদের পশ্চাৎমুখী ভাবনার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখানেই থেমে নেই, অতি সম্প্রতি বিজেপি'র দুই নেতা-নেত্রী নবীন জিন্দাল ও নূপুর শর্মা ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মোহাম্মদ সম্পর্কে সচেতনভাবেই কুরুচিকর মন্তব্য করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই গোটা দেশের সাথে এরাজ্যেও সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে এবং তাঁরা প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামেন। উত্তর প্রদেশে প্রতিবাদ জানানোর ফলে এক প্রতিবাদীর বাড়ি বুলডোজার নামিয়ে আইনবিরুদ্ধভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। শতাধিক মুসলিমকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নেতিবাচক কথাবার্তায় পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সামাল দিতে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে একমাত্র বামপন্থীরাই দেশের ঐক্য, শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষায় রাস্তায় নামেন এবং আগামীদিনেও তাঁরা রাস্তায় থাকবেন।
এই সাম্প্রদায়িক কুরুচিকর মন্তব্যের জন্য শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, দুনিয়াজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। এমনকী রাষ্ট্রসংঘের সমালোচনার মুখে পড়তে হয় নরেন্দ্র মোদির সরকারকে।
এই মূহুর্তে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এক চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। দ্রব্যমূল্য পাইকারি সূচকে ১৫.৮৮ শতাংশ অতিক্রমের দিকে। বেকারি, অনাহার, গৃহহীনতা ইত্যাদিতে দেশ এখন চরম দুঃসময়ের মধ্যে। আর এই দুঃসময়ের মধ্যে দেশের করপোরেট সংস্থাগুলি মুনাফার পাহাড় জমিয়ে ফেলছেন। সম্প্রতি সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়া বা সিএমআইই জানিয়েছে করোনা মহামারীর দ্বিতীয় আর্থিক বছরে দেশের বৃহৎ কোম্পানিগুলি মুনাফার সর্বকালীন নজির ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
শোষণ প্রক্রিয়ার ঘটনাবলি থেকে নজর ঘোরাতে এবং শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ভাঙতেই ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করা হয়েছে। সুচারুভাবে দেশের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মানুষের নজর ঘোরাতেই মন্দির-মসজিদ ইস্যু করা হচ্ছে। অন্য ধর্মকে সরাসরি আক্রমণ যা বিজেপি’রই মতাদর্শের প্রতিফলন।
ভারতের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর লাগামহীন অত্যাচারের বিষয়ে পার্টির ২৩তম কংগ্রেসে (কান্নুর, ৬-১০ এপ্রিল, ২০২২) রাজনৈতিক প্রস্তাবে ২.৩৯ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ ‘‘বিজেপি রাজ্য সরকারগুলির মদতে মুসলিম ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে হিংসা ও ঘৃণা ছড়ানোর বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার দ্রুত বাড়ছে। অস্ত্রধারী উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ঘটানোর জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনাটি ছিল এক পূর্ব পরিকল্পিত সংগঠিত আক্রমণ। হিংসায় অপরাধী বা কেন্দ্রীয় পূর্ণ মন্ত্রীদের যাঁরা আগুন ভাষণ দিয়েছিলেন, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে কোনো আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়নি। ন্যায়বিচার পাওয়া তো দূরের কথা, বহু আক্রান্তকেই অভিযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত তথাকথিত ধর্ম সংসদে ব্যাপক সংখ্যায় মুসলিম গণহত্যার আহ্বান জানানো হয়েছে।’’
পার্টির ২৩তম কংগ্রেসে শুধুমাত্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা পরিস্থিতির বিবরণ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি। এবিষয়ে বাম ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচি অধ্যায়ে বুর্জোয়া-জমিদার শাসনের বিকল্প হিসেবে বাম ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচির উল্লেখ করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে ২.১৬৩ ধারার (খ) উপধারায় সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘‘ভারতের সংবিধানকে সুরক্ষিত রেখেই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে রক্ষা করা। সাংবিধানিক শাসনের প্রধান স্তম্ভগুলিকে শক্তিশালী করতে বিকল্প নীতি প্রণয়ন। ধর্মনিরপেক্ষতার মৌলিক নীতি হিসেবে রাষ্ট্রের চরিত্র ও রাজনীতি হতে ধর্মের পৃথকীকরণকে সাংবিধানিক নীতি হিসেবে তুলে ধরা। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে ভিত্তি করে ঘৃণা ও হিংসার প্রচারকে নিষিদ্ধ করা, মানুষের জীবন, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সুনিশ্চিত করা। যেকোনো সরকারি সংস্থায় কর্মরত উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিবর্গকে সরিয়ে দেওয়া, ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর অধীনে থাকা সশস্ত্র বাহিনী কিংবা নজরদারি গোষ্ঠীর নিষিদ্ধকরণ, গণপ্রহারে হত্যা প্রতিরোধে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন। সিএএ/এনপিআর/এনআরসি বাতিল ঘোষণা, কেবল আসাম রাজ্যে এনআরসি আপগ্রেডেশন বাদ দিয়ে।’’
এখন এটা দেখার যে, আমাদের দেশের ক্ষেত্রে যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে তার সমাধান কীভাবে সম্ভব। এবিষয়ে মহান বস্তুবাদী দার্শনিক কার্ল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
১৮৩৬ সালে মার্কস উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথমে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শুরু করলেও ঠিক তার পরের বছর বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৮৩৬ সালের প্রথম দিকে মার্কস দর্শন শাস্ত্র নিয়ে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। বিশেষ করে এপিকিউরানিজম (Epicureanism) নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। অবশেষে দর্শনশাস্ত্রে গবেষণার ফলে মার্কস বহির্জগতের বিষয়ে দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি কী - এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেন।
মার্কসের মনে প্রবল চিন্তার প্রকাশ হলো কী করে জগতের মানুষকে বন্ধনমুক্ত করা যায় এবং স্বাধীন করা যায়। জ্ঞানের জন্য দুর্বার আকাঙ্ক্ষা ঈশ্বরের অস্বীকার এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মার্কসকে তাড়িত করে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মানুষের মুক্তির উপায় খুঁজে বের করা। এপিকিউরাসের দর্শন তাঁকে প্রভাবিত করে। এই দর্শনের মধ্যে নিহিত স্বাধীনতার চিন্তা মানুষের মনের মুক্তি, ধর্মের শৃঙ্খল থেকে অব্যাহতি, কুসংস্কার থেকে মুক্তি প্রভৃতির উপর তিনি জোর দিলেন। ঈশ্বরের বিশ্বাসহীনতার এপিকিউরাসের সমস্ত যুক্তি মার্কস মেনে নিলেন।
১৮৪১ সালে মার্কস ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য ‘’The Difference Between The Democratean and Epicurean Philosophy Of Nature” এই থিসিসের মুখবন্ধেই তিনি নিরীশ্বরবাদকে তাঁর চিন্তার ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। এপিকিউরাসের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে মার্কস বলেন, ‘‘Not the man who denies gods worshipped by the multitude, but he who affirms of the gods what the multitude believes about them, is truly impious.’’(Page -7) -অর্থাৎ ‘‘যে-ব্যক্তি জনসাধারণের পূজিত দেবতাদের অস্বীকার করে সে নয়, দেবতাদের সম্বন্ধে জনসাধারণ যা বিশ্বাস করে সেটাকে যে-ব্যক্তি অনুমোদন করে সে-ই অধার্মিক।” বিভিন্ন দর্শন এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। মার্কস পি বি শেলির কাব্যের নায়ক প্রমিথিউসের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, Philosophy makes no secret of it. The confession of Prometheus: ‘‘In simple words I hate the pack of gods.’’(Aeschylus, Prometheus Bound)। অর্থাৎ দর্শন এটাকে একটুও গোপন করে না। প্রমিথিউসের এই কবুল জবাবঃ ‘‘সাদাসিধে কথায় - দেবতা-পালকে আমি ঘৃণা করি।’’
পাশাপাশি মার্কস এবিষয়েও উপলব্ধি করেন যে, ধর্মীয় বিশ্বাস যুক্তি বিরোধী হলেও ধর্ম একটা বাস্তব শক্তি হিসেবে বিরাজমান। সেকারণে প্রকৃতিবিজ্ঞানের দায়িত্ব হচ্ছে ধর্মের গণ্ডিকে অতিক্রমের চেষ্টা করা। অন্ধ বিশ্বাসগুলিকে ভেঙে দেওয়া এবং সেই সাথে ধর্মের উৎস এবং জনগণ কর্তৃক এর উপরে বিশ্বাসের কারণগুলিকে ব্যাখ্যা করা। মার্কস এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ধর্ম বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের চেতনা বিকাশের প্রাথমিক স্তরে এবং চিন্তার একটি আদিম অবস্থায়। এই স্তরে জগতের সমস্ত বস্তু ও পারিপার্শ্বিককে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা মানুষের ছিল না এবং এগুলিকে কতকগুলি অলৌকিক ও যুক্তিহীন বক্তব্যের দ্বারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা তারা করত। এবিষয়ে মার্কস আরও বলেন, ‘‘প্রকৃতি নির্মাণের খারাপ দিকটাই বরং দেখায় যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। পৃথিবীটা যুক্তিহীন এবং সেটাই ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ। যেহেতু কোনো চিন্তার অস্তিত্ব নেই তাই ঈশ্বর আছেন। এর অর্থ হচ্ছে, যার কাছে জগৎটা যুক্তিহীন মনে হয় এবং যে নিজেই যুক্তি বিরোধী, তিনিই মনে করেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। অথবা বলা যায় যুক্তিহীনতাই হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব।’’
কার্ল মার্কস মাত্র তেইশ বছর বয়সে জার্মানির জেনা (Jena) বিশ্ববিদ্যালয়ে এই থিসিসটি পেশ করেন এবং ১৯৪১ সালের ১৫ এপ্রিল ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু মুসলিমদের যে সমস্যা দীর্ঘদিন থেকে দেখা দিয়েছে, এই একই সমস্যা জার্মানিতে সংখ্যালঘু ইহুদিদের ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছিল।
জার্মানিতে সংখ্যালঘু নাগরিক ইহুদিদের মুক্তির প্রশ্নে ব্রুনো বয়ার (Bruno Bauer, 1809-1882) যে অভিমত ব্যক্ত করছিলেন তার সঙ্গে মার্কস দ্বিমত পোষণ করেন।
ব্রুনো বয়ারের অভিমত ছিল যে, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে যে কঠোর ধরনের বিরোধিতা ছিল তা হলো ধর্মীয় বিরোধিতা। এই বিরোধিতা অবসানের জন্য বয়ার ধর্মের অবসানের কথা বলেন। যখন ইহুদি ও খ্রিস্টানরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, তাঁদের ধর্মগুলির উৎপত্তি হয়েছিল সমাজের বিকাশের বিভিন্ন স্তরে এবং স্তরের এই বিভিন্নতার জন্যই তাদের ধর্মের মধ্যেও একটা বিরোধিতা সৃষ্টি হয়েছে - তখন ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে আর ধর্মীয় বিরোধিতা থাকবে না এবং স্থাপন হবে পারস্পারিক মানবিক সম্পর্ক।
বিপরীতে মার্কসের অভিমত ছিল ইহুদিদের প্রশ্নটি ছিল নাগরিক ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রশ্ন। মার্কস মনে করতেন যে, রাজনৈতিক মুক্তির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কটি হচ্ছে আসলে রাজনৈতিক মুক্তির সঙ্গে মানবিক মুক্তির প্রশ্ন। সেকারণে মার্কস বলেন, ‘‘ইহুদিদের, খ্রিস্টানদের এবং সাধারণভাবে ধর্মীয় মানুষদের রাজনৈতিক মুক্তির প্রশ্নটি হচ্ছে ইহুদি ধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্ম থেকে রাষ্ট্রের মুক্তির প্রশ্ন।
মার্কস বলেন যে, ধর্ম থেকে রাজনৈতিক মুক্তি, ধর্ম থেকে মুক্তির সমর্থক নয় এবং রাজনৈতিক মুক্তিও মানবিক মুক্তির সমর্থক নয়। এরপর মার্কস মন্তব্য করেন, ‘‘এমনকী যদি ব্যাপকভাবে অধিকাংশ মানুষ ধার্মিক মনোভাবাপন্ন হয়ও, তবুও রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে মুক্ত করা সম্ভব। ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক এই ব্যাপক জনগণ এর দ্বারা ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয় না। অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিক ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে মুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো নাগরিকের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত হানার প্রয়োজন হয় না।’’
মার্কস দেখিয়েছেন যে, রাজনৈতিক মুক্তি এবং মানব মুক্তি সমার্থক নয়। মানবিক মুক্তি অনেক উচ্চ পর্যায়ের ঘটনা। রাজনৈতিক মুক্তির পরও মানুষের ধর্ম বিশ্বাস থেকে যায়। মার্কস বলেছেন, ‘‘মানুষকে দুইভাগে ভাগ করা অর্থাৎ সর্বজনিক জীবনে মানুষ এবং ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র থেকে নাগরিক জীবনে সরিয়ে দেওয়া - এটা রাজনৈতিক মুক্তির কোনো একটা বিশেষ স্তর নয় বরং তার পরিপূর্ণতা। এই মুক্তি তাই মানুষের প্রকৃত ধার্মিকতার অবসানও ঘটায় না, তার জন্য কোনো চেষ্টাও করে না।’’
মার্কস আরও ব্যাখ্যা করে বলেন যে, মানুষকে দুটো সত্তায় ভাগ করা। একই ব্যক্তি একই সাথে ইহুদি ও প্রোটেস্ট্যান্ট এবং নাগরিক - এইভাবে ভাগ করলে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে, অর্থাৎ নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে মানুষকে ভেদাভেদ থেকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসের সম্পূর্ণ অবসান না হলে মানুষ হিসেবে তার প্রকৃত মুক্তি ঘটে না।
তাহলে ধর্মের সম্পূর্ণ অবসান কীভাবে সম্ভব? এই মূল প্রশ্নে মার্কস বলেন, ‘‘যখন সমাজজীবন থেকে একটা বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, যখন রাজনৈতিক মুক্তির মধ্য দিয়ে মানুষ তার নিজের মুক্তি খোঁজে তখন রাষ্ট্রকে অগ্রসর হয়ে ধর্মের অবসান ঘটানো, সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটানো প্রয়োজন। কিন্তু এটা করতে হবে এমনভাবে যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান ঘটানো হয়। প্রাথমিকভাবে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, ক্রমবর্ধমান হারে কর বসানো, যেমনভাবে শেষ পর্যন্ত জীবনের অবসানের যন্ত্র গিলোটিনের অবসান ঘটানো হয়।
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সর্বপ্রথম ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সূচনা করে। ১৮৪৩ সালে মার্কস ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের এই ধারণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান এবং প্রথমে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলেন এবং সর্বশেষে ধর্মের সম্পূর্ণ অবসানের প্রয়োজন ব্যক্ত করেন।
বহু পূর্বের অর্থাৎ ১৮৪৩ সালে মার্কস তৎকালীন জার্মানির ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইহুদিদের সমস্যা সমাধানের যে সূত্র দিয়েছিলেন তা আজ ভারতের মতো বহু ধর্ম, বহু জাতি এবং বহু ভাষা বিশিষ্ট দেশের সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। বর্তমানে ভারতের ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা লাভ হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে বলা যায়, ভারতের সংখ্যালঘুর জটিল প্রশ্নটির সমাধানে মার্কসের বক্তব্য আজও প্রাসঙ্গিক।
রাষ্ট্রের রাজনৈতিক মুক্তির দ্বারা (ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্নতার দ্বারা) ধর্মকে নিছক ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যার নিদান করা যায়। কিন্তু বিপ্লবের আরও উন্নতস্তরে ধর্মবিশ্বাসেরই অবসান ঘটবে। যেভাবে সমাজবিকাশের নিম্নতম স্তরে এর আবির্ভাব ঘটেছিল ঠিক সেভাবেই। মার্কসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী - এটাই হবে ধর্মের চরম পরিণতি।