৫৯ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ১ অক্টোবর, ২০২১ / ১৪ আশ্বিন, ১৪২৮
দেশব্যাপী ধর্মঘটের অভূতপূর্ব সাফল্য
কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের ফ্রন্ট তৈরির পথ প্রশস্ত হলো
সংগ্রামী জনগণকে কৃষক সভার অভিনন্দন
২৭ সেপ্টেম্বর সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে কলকাতায় মিছিলে বিমান বসু, সূর্য মিশ্র, মনোজ ভট্টাচার্য, নরেন চট্টোপাধ্যায় সহ নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারের কৃষক-বিরোধী নীতি, সার্বিকভাবে জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ২৭ সেপ্টেম্বর জোরালো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে স্তব্ধ হলো গোটা দেশ। সংযুক্ত কিষান মোর্চার আহ্বানে এবং দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলির সমর্থন ও অংশগ্রহণে এদিনের বন্ধে অনেকগুলো রাজ্যেই স্তব্ধ হলো জনজীবন। এদিন দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ বিভিন্ন রাজ্যে বন্ধে অচল হয়েছে জনজীবন। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে রাস্তা, রেল অবরোধ, বিক্ষোভ, সমাবেশের ফলে জনজীবনে বন্ধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এই বন্ধে কেবল কৃষক সংগঠনই নয়, দেশের সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন, মহিলা সংগঠন এবং ছাত্র-যুব সংগঠনগুলিও এই বন্ধের সমর্থনে পথে নেমেছিল। এছাড়াও সিপিআই(এম) সহ ১৯টি বিরোধী দল এই বন্ধকে সর্বতোভাবে সমর্থন জানিয়েছিল।
সংযুক্ত মোর্চার ডাকা এদিনের ভারত বন্ধকে সফল করার জন্য দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছে সারা ভারত কৃষক সভা। এদিনের এই সফল বন্ধের মধ্য দিয়ে কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের মোর্চা গঠনের পথ তৈরি হলো বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে কৃষক সভা। কৃষক সভা এক বিবৃতিতে বলেছে, এই বন্ধের মধ্য দিয়ে কৃষক আন্দোলনের এক সর্বভারতীয় চরিত্র ফুটে উঠেছে। এই ধর্মঘট সফল করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বিপুল সংখ্যায় মহিলা, প্রবীণ, যুবক এমনকী শিশুরাও অংশ নিয়েছে। বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ, গুজরাট এবং ত্রিপুরাতে বন্ধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে, দোকানপাট-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যানবাহন চলাচল স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসীতেও বন্ধের প্রভাব পড়ে এবং ব্যাপক অংশের মহিলা সহ হাজারো মানুষ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে শামিল হন। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমরের নির্বাচনী কেন্দ্র মোরেনাতে বন্ধ হয়েছে সর্বাত্মক।
কৃষক সভার বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কেরালা, ত্রিপুরা, তামিলনাডু, বিহার, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র প্রদেশ, রাজস্থান, ওডিশা এবং পশ্চিমবঙ্গে বন্ধের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, অসম, কর্ণাটক, হিমাচল প্রদেশ, মণিপুর এবং গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে বন্ধ সফল হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রেল রোকো, রাস্তা রোকো কর্মসূচিতে অসংখ্য মানুষ অংশ নিয়েছেন। সারা ভারত কৃষক সভার পক্ষ থেকে এদিনের ভারত বন্ধকে সফল করতে জন্য ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের জন্য শ্রমিক সংগঠনগুলির পাশাপাশি বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল, খেতমজুর সংগঠনসহ ছাত্র, যুব, মহিলা প্রভৃতি সংগঠনকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
কৃষক সভা বলেছে, আজকের ভারত বন্ধের রাজনৈতিক অভিমুখ হলো, গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিক-কৃষকের শ্রেণি ঐক্যের ভিত্তিতে যৌথ সংগ্রাম এখন কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে বিশেষ করে কৃষি, শিল্প, পরিষেবা ক্ষেত্রে আন্দোলনে বৃহত্তর অংশের মানুষের ফ্রন্ট গঠনের সহায়ক হবে। যে রাজনৈতিক দলগুলি কর্পোরেট স্বার্থরক্ষার জন্য দাঁড়িয়েছে, তারা জনগণের ক্ষোভের মুখোমুখি হবে এবং জনগণের প্রতিরোধের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিহত করা হবে।
এদিন ভারত বন্ধকে সফল করার জন্য জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছে সিপিআই(এম)। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও এক ট্যুইট বার্তায় কৃষকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।
পাতিয়ালায় ধর্মঘটের সমর্থনে ‘রেল রোকো’।
এদিন দিল্লির যন্তরমন্তরে কৃষক, শ্রমিক, মহিলাসহ অন্যান্য গণসংগঠনগুলির উদ্যোগে বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা এই বিক্ষোভ সভায় বলেছেন, গত দশমাস ধরে কৃষকদের আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিক ও অন্যান্য অংশের কোটি কোটি মানুষ পথে নেমেছেন। সরকার গণতান্ত্রিক হলে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমাধানের রাস্তা খুঁজত, কিন্তু মোদী সরকার নিস্ক্রিয়। এই সরকার শুধু কৃষক বিরোধী নয়, শ্রমিক বিরোধী, জনবিরোধী। এমন জনবিরোধী প্রধানমন্ত্রী কখনও দেখা যায়নি। কিন্তু তারা যেন মনে রাখে অন্নদাতারা ভোটদাতাও। এইসব অপমান তাঁরা কড়ায়গণ্ডায় ফেরত দেবেন। উচিত শিক্ষা দেবেন।
এই সভায় সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, এআইটিইউসি’র সাধারণ সম্পাদক অমরজিৎ কাউর সহ শ্রমিক, খেতমজুর, মহিলা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
বন্ধের সমর্থনে রোহতকে সুবিশাল মিছিল।
জলন্ধরে বন্ধের প্রভাব সর্বাত্মক। শুনশান রাস্তা।
পশ্চিমবঙ্গে গ্রামবাংলায় দারুণ সাড়া
সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকা ভারত বন্ধের ভালো সাড়া মিললো রাজ্যজুড়ে। শহরাঞ্চলে বন্ধের মিশ্র প্রভাব পড়ে, গ্রামবাংলায় বন্ধ হয়েছে সর্বাত্মক। এদিন ভয়ভীতি উপেক্ষা করে, জড়তা কাটিয়ে সকাল থেকেই রাস্তায় ছিলেন কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানুষ সহ ছাত্র-যুব-মহিলারা। দফায় দফায় চলেছে রেল ও পথ অবরোধ, কারখানার গেটে চলেছে পিকেটিং।
মোদী সরকারের কৃষকবিরোধী-জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বন্ধ সত্ত্বেও এবারেও বন্ধ ভাঙতে সক্রিয় ভূমিকা নেয় মমতা সরকারের পুলিশ। রাজ্যজুড়েই চলেছে গ্রেপ্তারি ও ধরপাকড়। পুলিশের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই অবরোধে শামিল হন ধর্মঘটীরা।
রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে এদিন বন্ধ ছিল সর্বাত্মক। কৃষি কাজ বন্ধ রেখে রেল অবরোধ, সড়ক অবরোধে শামিল হন কৃষক-খেতমজুররা। শিল্পাঞ্চলে বন্ধের প্রভাব ছিল আংশিক। উত্তরবঙ্গের চা বাগানে বন্ধের মিশ্র সাড়া পড়ে। ইস্পাত, কয়লা, ব্যাঙ্ক, বিমা ক্ষেত্রেও বন্ধের আংশিক প্রভাব পড়ে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরে অন্যান্য দিনের তুলনায় হাজিরা ছিল অনেক কম। জোর করে সরকারি বাস চালানো হলেও জেলাগুলিতে বেসরকারি পরিবহণ ছিল স্তব্ধ। শহরতলি, মফস্সলে অটো, টোটো, ফেরি সার্ভিস ছিল সিংহভাগ বন্ধ।
সারা ভারত কৃষক সভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার জানিয়েছেন, কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে তিনটি কৃষি আইন, বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল, চারটি শ্রমকোড প্রত্যাহারের দাবিকে সমর্থন জানিয়েছেন বাংলার মানুষ। শহরাঞ্চলে বন্ধে মিশ্র প্রভাব থাকলেও সফল হয়েছে গ্রামীণ বন্ধ। সকাল থেকে বন্ধ সফল করতে রেললাইন, রাস্তার দখল নিয়ে লড়াইয়ে ছিলেন ধর্মঘটীরা। দৃঢ়ভাবে দেশের কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বাংলার জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি।
সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু রাজ্যের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, বিভিন্ন কারখানায়, শিল্পে উৎসবের বোনাস দেবার কাজ চলছে। উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ না থাকলেও শিল্প ক্ষেত্রে বন্ধের আংশিক প্রভাব পড়েছে, রাস্তা অবরোধ, রেল অবরোধ করে ধর্মঘটীরা সকাল থেকে রাস্তায় থেকেছেন।
এদিন সকাল সাড়ে দশটায় কলকাতার এন্টালি মার্কেট থেকে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত সংগঠিত হয় কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির আহ্বানে কেন্দ্রীয় মিছিল। এই মিছিলে অংশ নেন রাজ্য বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। মিছিলে ছিলেন সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু, এআইটিইউসি’র রাজ্য সম্পাদক উজ্জ্বল চৌধুরী, টিইউসিসি নেতা প্রবীর ব্যানার্জি, ইউটিউইসি নেতা দীপক সাহা, এআইইউটিইউসি নেতা অশোক দাস, সিআইটিইউ নেতা দীপক দাশগুপ্ত প্রমুখ। মিছিলে শামিল হয়েছিলেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি প্রমুখ। এছাড়াও এদিন মৌলালি মোড় থেকে ধর্মতলা ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত মিছিলে অংশ নেন সারা ভারত কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি’র রাজ্য শাখার আহ্বায়ক কার্তিক পাল সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।