E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ১ অক্টোবর, ২০২১ / ১৪ আশ্বিন, ১৪২৮

পূর্ব বর্ধমান জেলায় কৃষক সভার ব্লক সম্মেলন

জমির আন্দোলনকে তীব্র করেই শোষণ আক্রমণ প্রতিরোধের ডাক

শঙ্কর ঘোষাল


গলসী-২ ব্লকের উড়োগ্রামে লাল পতাকা উড়িয়ে কৃষক আন্দোলনকে জোরদার করার শপথ নিচ্ছেন কৃষকরা।

খেতমজুর ও গরিব চাষির বিকশিত সংগ্রামী ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই সামন্ততন্ত্র ও কর্পোরেট পুঁজির ক্রমবর্ধমান চাপের বিরুদ্ধে কৃষক ঐক্য গড়ে তোলার জটিল ও দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়া নিয়ে অতীতে অনেক আলোচনা হয়েছে, কিন্তু এই সংকটময় সময়ে সঠিক শ্রেণিচেতনাবোধ জাগিয়ে তুলে জমির আন্দোলন সহ কৃষক আন্দোলনকে মজবুত ও নতুন মাত্রা দিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন কৃষকসভার ব্লক সম্মেলনগুলিতে কৃষক প্রতিনিধিরা। পূর্ব বর্ধমান জেলার ২৭টি ব্লক সম্মেলনেই কৃষক প্রতিনিধিদের কণ্ঠে ছিল এই সময়ে লুঠ হয়ে যাওয়া গরিবের খাস, পাট্টা জমি ফের পুনর্দখল করার বৃত্তান্ত । আলোচনায় উঠে আসা এই বক্তব্য ছিল জেলার সংগ্রামী কৃষক-খেতমজুরদের কাছে যথেষ্ট প্রেরণাদায়ক। শাসকশ্রেণির নির্মম আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে জমির আন্দোলনের চরিত্র আরও শক্তিশালী করতে সমাজের সবচেয়ে সংগ্রামী গরিবদের এককাট্টা করার উপরই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এই সংগ্রামে অন্তঃপুরের বন্ধন ছিঁড়ে মহিলাদেরও সামনের সারিতে যুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। অতীতে যাঁরা জমি, মজুরির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের লড়াই, সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়েই আন্দোলনের স্রোতধারা বজায় রাখতে নতুন দায়িত্ব ও দায়ভার কৃষক কর্মীরা কাঁধে তুলে নিয়েছেন সম্মেলনগুলিতে। গলসীর জমির আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এখানে কৃষক প্রতিনিধিদের কাছে তার ব্যতিক্রমী হয়নি। পুরুষদের সাথে মহিলারাও পাশে থেকে কীভাবে জমি পুনর্দখল করা সম্ভব হয়েছে - সেই আলোচনা উঠে আসে কালনা, কাটোয়া, মেমারী, রায়না, খণ্ডঘোষ, জামালপুর, ভাতাড়, মঙ্গলকোটের কৃষক প্রতিনিধিদের বক্তব্যে। অতীতের কৃষক আন্দোলনের স্মৃতিকে জীবন্ত রেখেই ভবিষ্যতে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলনের দিশা মানুষের চেতনায় নিয়ে যাবার দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন প্রজন্মের লড়াকু কর্মীরা। বর্তমান শ্রেণিবিভক্ত সমাজে তাকে আরও জীবন্ত করে তোলার শপথ নিয়েছেন এই কৃষক প্রতিনিধিরা।

রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের ভয় এবং জমির প্রলোভন দেখিয়েও লাল ঝান্ডার কর্মীদের জমি পুনর্দখলের আন্দোলন বিমুখ করতে পারেনি তৃণমূল ও প্রাক্তন জমির মালিক। খেতমজুর সনাতন ঘড়ুই গলসীর খানো পঞ্চায়েতের সামড়া জামাড় গ্রামে গরিবের লুঠ হয়ে যাওয়া খাস জমি পুনর্দখলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নিজের বাড়িতে অভাব, নিজের জমি নেই তবু কৃষকসভার কর্মী হিসাবে জমি লুঠেরাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন মাথা উঁচু করে। জীবন বাজি রেখে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এখানকার গরিবরা, পূর্ব বর্ধমান জেলা কৃষকসভার গলসী-২ ব্লকের সম্মেলনে জমির আন্দোলনের সেই অভিজ্ঞতাই বিনিময় হয়েছে। সনাতন ঘড়ুই এদিন আলোচনা করতে গিয়ে সেখানকার জমির আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কথা অঞ্চল কমিটির পক্ষে বলেছেন, প্রথমে শাসকদল তাঁদের ভয় দেখায়। হুমকি দেওয়া হয় গরিবরা যাতে জমির আন্দোলন না করেন। প্রাক্তন জমির মালিক তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে জমি দেবার প্রলোভন দেখায়। কিন্তু সনাতন ঘড়ুইরা দৃঢ়তার সাথে জানিয়ে দেয়, যারা গরিবের জমি লুঠ করে তাদের প্রতি এখানকার কৃষক, খেতমজুরদের ঘৃণা ছাড়া আর কিছু নেই। সব গরিবদের জমি ফিরিয়ে দেবার দাবিই করেছেন এলাকার কৃষকসভার কর্মীরা। এখানে জমির আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, ব্যক্তিগতভাবে কে কতটা জমি পাবে তা কখনোই বড়ো হয়ে ওঠেনি। এটা ছিল শাসক ও প্রাক্তন জমির মালিকদের বিরুদ্ধে গরিবের তীব্র ঘৃণা থেকেই গণ-বিস্ফোরণ। জমির আন্দোলনে প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে একের পর এক লুঠ হওয়া জমি পুনরুদ্ধারের পর জেলার কৃষক আন্দোলনে কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে।

তৃণমূল ও প্রাক্তন জমির মালিক রাজি না হলে লাল ঝান্ডা নিয়েই চাষের সময় জমি পুনর্দখল নিয়েই চাষ করেন গরিবরা জোটবদ্ধভাবে। সেই জমি পুনর্দখলের লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে ২০১১ ও ২০২১ সালে গরিবের জমির কেড়ে নিয়েছে শাসকদলের মদতে প্রাক্তন জোতদাররা,সেই জমি পুনর্দখলের শপথ নিয়েছেন গরিবরা। গলসী-২ অঞ্চলের যেখানে জমির আন্দোলন হয় সেখানকার সম্মেলনে ২১০জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এটা শুধু একটা ব্লকের চিত্র নয়, একই দিনে খণ্ডঘোষ-২, মেমারী-১ ও ২, কালনা-২, পূর্বস্থলী-১ ও ২ , রায়না-২ ব্লকের সম্মেলনেও লুঠ হয়ে যাওয়া গরিবের জমি ফেরাতে আলোচনা হয়েছে। পূর্ব বর্ধমান জেলার ২৭টি ব্লক কমিটিতেই জমি লুঠেরাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছেন প্রতিনিধিরা। আগামী ২রা অক্টোবর ধাত্রীগ্রামে জেলা সম্মেলনে সেই লড়াইয়ের পরিকল্পনা চূড়ান্ত রূপ পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সংগঠনের জেলা সম্পাদক সৈয়দ হোসেন জানিয়েছেন, সম্মেলন থেকে স্লোগান ও বার্তা দেওয়া হয়েছে - সব গ্রামে কৃষকসভা ও সব কৃষককেই কৃষকসভার সংগঠনের তলায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে। পূর্ব বর্ধমান জেলায় যে ২৭টি ব্লক সম্মেলন শেষ হয়েছে তা সম্পন্ন হয়েছে কৃষকদের গণসংগ্রহে। যেমন গলসীতে ৫০০-র বেশি পরিবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ চাল, কেউ সবজি, কেউ পুকুরের মাছ দিয়েছেন। কৃষকরা মনে করছেন তাঁদের নিজেদের সংগঠন পূর্ব বর্ধমান জেলা কৃষকসভা। প্রত্যেকটি সম্মেলনেই গ্রাম কমিটিগুলিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পূর্ব বর্ধমান জেলায় ২৭টি ব্লকের কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, আউশগ্রাম, ভাতাড়, বর্ধমান সদর, কাটোয়া সহ সর্বত্র সম্মেলনেই গরিবরা আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে জমির আন্দোলন ছাড়াও পেট্রোপণ্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন প্রতিনিধিরা। কীভাবে গরিবের হেঁসেলে প্রভাব ফেলেছে জিনিসের দাম বৃদ্ধি তা তুলে ধরেছেন প্রতিনিধিরা। ডাল, সর্ষের তেল, আনাজপাতি সহ সব জিনিসের দাম আগুন, কিন্তু তৃণমূল এবং বিজেপি দুই দলেরই এ নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মরছে গরিব , সাধারণ মানুষ। জমির আন্দোলন থেকে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, খেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন, গণতন্ত্রের অধিকার রক্ষার আন্দোলন দুর্বল করতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি কীভাবে গরিবের মনের মধ্যে বিষ ঢুকিয়েছে গত বিধানসভা নির্বাচনে দুই ফুল, সেই অভিজ্ঞতাও বিনিময় করেছেন ২৭টি সম্মেলনেই কৃষক প্রতিনিধিরা।

কৃষক নেতারা সম্মেলনে আলোচনায় তুলে এনেছেন কীভাবে মাইক্রোফিনান্স জোঁক হয়ে গরিবের রক্ত চুষে খাচ্ছে। সমবায় ব্যাঙ্ক জোর করে দখল নিয়ে লুঠেরা শক্তি তা লাটে তুলে দিয়েছে। ফলে গরিব কৃষক মহাজন ও মাইক্রোফিনান্সের খপ্পরে পড়ে তাঁরা চড়া হারে সুদ গুনছেন। নতুন এই সাইলকদের সুদ মেটাতে না পেরে বহু গরিব মানুষ বিশেষ করে মহিলারা আত্মঘাতী হয়েছেন। এই সময়ে গত ১০ বছরে আত্মঘাতী কৃষকের মধ্যে তপন মিত্র’র (৫৫) নাম মুখ্যমন্ত্রীর মনে হয়তো আর নেই। যিনি বর্ধমানে মাটি উৎসবের দিনই আলুচাষে লোকসানের জন্য আত্মহত্যা করেছিলেন! ভাতাড়ের ধনা টুডু থেকে ২৫০ জন পূর্ব বর্ধমানে কৃষিজীবী মানুষের আত্মহত্যার লম্বা ফর্দ কারো কথায় মুখ্যমন্ত্রী মনে রাখেননি। এমন অনেক কৃষক, ভাগচাষি, খেতমজুর, বর্গাদার গত ১০ বছরে ঋণের ফাঁসে যন্ত্রণায় মরেছেন, যাঁদের কৃষক বলেই স্বীকৃতি দেয়নি মমতা ব্যানার্জির সরকার। ১লা বৈশাখ যখন মুখ্যমন্ত্রী উৎসবে মেতে ছিলেন, সেই দিনই মেমারীর রাজপুরের আলু চাষি অমিয় সাহা ঋণের ফাঁসে বিষ খেয়েই মাঠেই প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, সে কথাও কি মুখ্যমন্ত্রী ভুলে গেছেন? দেখুন তো মনে করতে পারেন কিনা বিজয়পুরের উৎপল বাগদি, দিগনগরের বোধন হাজরা, আলিগ্রামের বুধন গণ, ভাতাড়ের কালটিকুড়ির সফর মোল্লা, বেলেন্ডার বরুণ পালের মতো অসংখ্য আত্মঘাতী কৃষকের কথা? যাঁদের পরিবার আজও একমাত্র উপার্জনকারী স্বামী, বাবাকে হারিয়ে চোখের জল ফেলছে। মুখ্যমন্ত্রী ভুলে গেলেও জেলার সংগ্রামী কৃষকরা ভোলেননি। প্রতিটি ব্লক সম্মেলনেই আলোচিত হয়েছে তাঁদের কথা। যেমন মোদীর কৃষি আইনের প্রতিবাদ ও আন্দোলনরত কৃষকদের মৃত্যুতে বিজেপি বা আরএসএস’র হৃদয় একটুও কাঁদে না। তেমনই হাটশিমূল গ্রামের কৃষক বাদল মণ্ডলরা বলেছেন, যতই বন্ধু সাজুক মোদী ও মমতা আসলে দুই দলই তীব্র কৃষক বিরোধী। দুই সরকারই মিথ্যার ঢাক বাজাচ্ছে, কেউ বলছেন দ্বিগুণ আবার কেউ বলছেন ৩গুণ বেশি নাকি আয় বেড়েছে কৃষকের। কিন্তু বলগোনার কৃষক শেখ একরামুল হক জানিয়েছেন, দুই সরকারই কৃষককে ঠকাচ্ছে, চাষে লোকসান হয়ে কৃষকের পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে। অধিকাংশ কৃষকের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাই কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই মহিলা কৃষিজীবী বিমলা বেসরা বলেছেন, এখন মা মাটি মানুষ সবই বেসামাল। আর কিছুদিন পর কৃষকের কঙ্কাল দেখবে সরকার। এই কৃষকমারা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিটি গ্রাম কমিটি থেকে অঞ্চল কমিটির এলাকায় গরিব, সাধারণ কৃষককে সাথে নিয়ে শ্রেণি আন্দোলন জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই সম্মেলনে কৃষকরা আলোকপাত করেছেন। গরিবের ঐক্য ও শক্তি বৃদ্ধি করে ফের জমির আন্দোলনে ঝাঁপাতে মরিয়া কৃষকসভা।