৫৯ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ১ অক্টোবর, ২০২১ / ১৪ আশ্বিন, ১৪২৮
সিপিআই(এম) দিল্লি রাজ্য ষোড়শ সম্মেলন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সিপিআই(এম) দিল্লি রাজ্য ১৬ তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর। সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত প্রমুখ। দিল্লির আম্বেদকর ভবনে কমরেড রঞ্জনা নেরুলা হলে এই ১৬ তম রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
প্রকাশ্য সমাবেশে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করতে হবে পার্টিকে, পার্টি কংগ্রেসকে। স্বাধীনতার পর দেশের সামনে এত গুরুতর পরিস্থিতি বোধহয় আর আসেনি। একদিকে দেশের এমন কোনো পরিবার নেই এই কোভিড মহামারীর জেরে যাদের কোনো লোকসান হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার এই মহামারীর মোকাবিলা করতে বিফল হয়েছে।
তিনি বলেন, দিল্লিতে আমরা লক্ষ্য করেছি অক্সিজেনের অভাব, ভেন্টিলেটরের অভাব, হাসপাতালে শয্যার অভাব আর তারপর টিকার অভাব। প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উদযাপনের জন্য দু’কোটি ভ্যাকসিন একদিনে দিয়ে দেওয়া হলো। যদি ওনার জন্মদিনে এটা সম্ভব হয় তাহলে বাকি দিনগুলোতে এটা সম্ভব হলো না কেন। দেশে যদি এখন ১৮ বছরের বেশি বয়সের নাগরিকদের ভ্যাকসিন দিতে হয় তাহলে প্রতিদিন এক থেকে সওয়া কোটি ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। এই সরকার সুপ্রিম কোর্টের সামনে ১০০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু এখন বলছে ৬০ শতাংশ মানুষকে দেওয়া হবে, পরে বলবে হয়তো ৪০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। একজনও যদি বাদ থাকে তাহলে তা সকলের জন্য বিপদ। এই পরিস্থিতিকে গুরুত্ব না দিয়ে খালি ভাষণবাজি চলছে কিন্তু নিজেদের যে কর্মসূচি সেটা এগিয়ে নিয়ে চলেছে। লকডাউনের পরিস্থিতিতে অনেকেরই কাজ নেই, এক জায়গায় মানুষের জড়ো হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে কিন্তু বিজেপি’র কর্মসূচিতে এই ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
তিনি বলেন, বিজেপি’র কর্মসূচি রূপায়ণ করার অর্থ দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে নষ্ট করা। আমাদের সাংবিধানিক ব্যবস্থা চারটি স্তম্ভের উপর স্থাপিত। এক হলো ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র, দুই সামাজিক ন্যায়, তৃতীয় হলো কেন্দ্র সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলির পারস্পরিক যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, চতুর্থ আর্থিক আত্মসহযোগিতা। এই চার স্তম্ভকেই নষ্ট করা হচ্ছে।
সীতারাম ইয়েচুরি শ্লেষের সুরে বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় গেছেন আর দেশের মানুষ আশঙ্কা করছেন দেশের আর কী সম্পদ উনি বেচে দেবেন যা বাকি আছে! জেনারেল মোটরস, হারলে ডেভিডসন প্রভৃতি বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা এখানে তাদের কারখানা বন্ধ করে চলে গেছে, কারণ এখানকার মানুষের ক্রয় ক্ষমতা নেই। তাদের ব্যবসা হচ্ছে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যদি কোনো উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি না হয় তাহলে উন্নয়ন হয় না, মুনাফা হয়না। দেশের এখন ৪০ কোটি নওজোয়ান চাকরি চাইছেন। আর মাত্র ৪৫ হাজার চাকরি পেয়েছেন। এর অর্থ দেশে দারিদ্র্য, বেকারি সব বেড়ে চলেছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গরিবের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে চলেছে আমাদের দেশ। মহামারীতে তাই ঘটেছে। দেশের লোক মরছে কিন্তু দেশের সরকারি গুদামের আনাজ পচে যাচ্ছে, তা বিলি করে দেওয়া হচ্ছে না গরিব মানুষের মধ্যে, বেচে দেওয়া হচ্ছে বিদেশে।
তিনি বলেন, দেশে এখন লুট চলছে। দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে দেশের অর্থনীতির আত্মসমর্পণ করানো হচ্ছে। এমন একটাও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র নেই যা বেচে দেওয়া হয়নি। বলা হচ্ছে বেসরকারি হাতে গেলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বেশি লাভ করবে। কিন্তু বেচে দেওয়া হচ্ছে রেলগাড়ি, রেললাইন। যারা এগুলো কিনছে তারা তাদের বিনিয়োগ উশুল করার জন্য দাম বাড়াবে। অর্থাৎ রেলের ভাড়া, টোল ট্যাক্স, বাসের ভাড়া সব বাড়বে। দেশের সাধারণ মানুষের উপর বোঝা বাড়বে।
বিজেপি-আরএসএস’র ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বংসের প্রশ্নে তিনি বলেন, আসামে সেখানকার মুসলিম জনগণ যারা ভারতের নাগরিক তাদের বলা হচ্ছে তারা জমি দখল করে রেখেছে। সেই জমি খালি করানোর জন্য দু’জন মানুষকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো। আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন আসামকে মুসলিমদের হাত থেকে তিনি রক্ষা করবেন। কিন্তু বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশের জনসংখ্যায় ধর্মের ভিত্তিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি গত ৭০ বছরে। লাভ জিহাদ সহ বিভিন্ন আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে মুসলিমদের উপর হিংসা বাড়ানো হচ্ছে। এভাবেই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আরও তীব্র করা হচ্ছে হিন্দুত্বের ভোটব্যাঙ্ককে আরও শক্তিশালী করার জন্য। দেশে ঘৃণা এবং হিংসার আবহাওয়া নির্মাণ করা হচ্ছে। সাংবিধানিক নিয়ম কানুন যা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে, সেসব রদ করা হচ্ছে। সরকারের রিপোর্টে বলা হচ্ছে দিল্লিতে দাঙ্গা হয়েছিল, কিন্তু তা হয়নি। সরাসরি সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়। এই সাম্প্রদায়িক হিংসার জন্য দায়ী বিষাক্ত যে ভাষণ সে সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু যারা হিংসার শিকার তাদের গ্রেপ্তার করে বছরভর আটকে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, ভীমা কোরেগাঁও ঘটনায় ভুয়ো দোষারোপ করে ইউএপিএ আইনে আটকে রাখা হয়েছে অনেককে। স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। তাঁর সাথে কী ব্যবহার করা হয়েছে তা গোটা দেশের মানুষ জানে। কোনো সাংবাদিক এই সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সংবিধান আমাদের যে গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছে তা হরণ করা হচ্ছে।
সংবিধান প্রণেতা আম্বেদকরের সাবধান বাণী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আম্বেদকর বলেছিলেন সংবিধান প্রত্যেক মানুষকে সমান ভোটাধিকার দিয়েছে। প্রত্যেক মানুষের ভোটের মূল্য সমান কিন্তু প্রত্যেক মানুষের মূল্য সমান নয়। যতদিন না মানুষের মূল্য সমান হবে ততদিন এই সাংবিধানিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হবে না। দেশের দলিত এবং আদিবাসী অংশের মানুষের উপর অত্যাচার হচ্ছে, তাদের চাষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর নামিয়ে আনা আক্রমণ সম্পর্কে তিনি বলেন, কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত নয়া আইন এনে এবং নতুন যে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে তাতে ঋণখেলাপিদের আরও লুটের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। কোভিডে মৃতদের পরিবারকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে এবং এই টাকা দেওয়ার দায় চাপানো হচ্ছে রাজ্যগুলির ঘাড়ে। রাজ্য সরকারগুলিকে জিএসটি’র প্রাপ্য দিচ্ছে না কেন্দ্র। জাতীয় লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন মোদী, কোনো রাজ্য সরকার করেনি। কিন্তু কেন্দ্র এখন তার দায় এড়াচ্ছে।
ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) কর্মী এবং দপ্তরের ওপর হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদেরকে,আমাদের পার্টিকে, লালঝান্ডাকে টার্গেট করা হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা, শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে মানুষকে আন্দোলনের পথে নামানোর ক্ষমতা, গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে বাধ্য করার ক্ষমতা একমাত্র লাল ঝান্ডারই আছে। তাই লাল ঝান্ডাকে আক্রমণ করা হচ্ছে। এই আক্রমণের মোকাবিলা কমরেডরা দৃঢ়ভাবে করছেন। অনেকে শহিদ হয়েছেন। এই লড়াইয়ের মোকাবিলা করে আমরা ভারতকে বাঁচাবো, এই লড়াই চলবে যতদিন না আমরা সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে পারি।
তিনি বলেন, মোদীকে বারবার আমরা মনে করিয়ে দিয়েছি যে, লাল ঝান্ডাকে খতম করার চেষ্টা যত বার করা হয়েছে যারা করেছে তারা পর্যুদস্ত হয়েছে। হিটলার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাকে হারিয়ে তার পার্লামেন্টের উপর লাল ঝান্ডা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবাংলায় সত্তরের দশক থেকেই সিপিআই(এম)’র উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু জরুরি অবস্থার শেষে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয় হয়েছিল, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাংলায় বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছিল। কেউ যদি মনে করে লাল ঝান্ডাকে আক্রমণ করে তাকে দমিয়ে, থামিয়ে দেওয়া যাবে - সেটা যাবে না। এটাই আজকে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। ভারতকে বাঁচাতে হলে মোদী সরকারকে পরাস্ত করতে হবে। তার জন্য পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে।
প্রকাশ্য সমাবেশে বৃন্দা কারাত দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশরা যেমন ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি প্রয়োগ করে নিজেদের কাজ হাসিল করত আজ ক্ষমতায় আসীন হয়ে মোদী সরকার নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে সেই বিভাজনের নীতি ব্যবহার করছে। দিল্লির নির্বাচনে পরাজয়ের পর বেছে বেছে বিভিন্ন মহল্লাগুলিতে বিজেপি-আরএসএস আগুন লাগিয়েছে।
তিনি বলেন, দিল্লির আপ সরকারের কাছে মানুষের যে আশা ছিল তা তারা পূরণ করতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক হিংসার সময় আক্রান্ত মানুষকে ত্রাণ দেওয়ার প্রসঙ্গ, তাঁদের পাশে পার্টি কর্মীদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি অভিনন্দন জানান।
সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন ১৫৯ জন প্রতিনিধি। সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশ নেন ৬৬ জন প্রতিনিধি। সম্মেলন থেকে ৩০ জনের নতুন রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়। ৯ জনের সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়। রাজ্য সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচিত হন কে এম তিওয়ারি।
সম্মেলন থেকে মহিলাদের উপর হিংসা বন্ধ করার প্রস্তাব নেওয়া হয়।