৫৯ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ১ অক্টোবর, ২০২১ / ১৪ আশ্বিন, ১৪২৮
অসমে কৃষক উচ্ছেদের নামে বর্বরতা চলছে
কমলেশ গুপ্ত
শিপাঝার অঞ্চলের ধলপুরে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলছেন বৃন্দা কারাত সহ নেতৃবৃন্দ।
অসম সরকারের নির্দেশে শিপাঝার অঞ্চলের ধলপুর চর অঞ্চলে গত ২৩ সেপ্টেম্বর উচ্ছেদের সময় পুলিশের বর্বর গুলি চালনার ঘটনায় সম্প্রতি রাজ্য রাজনীতি উত্তাল হয়ে রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম দফার উচ্ছেদের সময় প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমি মুক্ত করার পর আবার ২৩ তারিখে দ্বিতীয় অভিযান চলার সময় দরং জেলার প্রশাসন তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ৪-৫ হাজার মানুষ জড়ো হয়ে পুলিশকে বাধা দিলে পুলিশ গুলি চালায়। তাতে তিনজন নিহত হয় এবং গুরুতর আহত অবস্থায় ৯ জন এখনও গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এই ধলপুর গরুখুটি অঞ্চলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাদ-বিবাদ চলছেই। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিরোধী দল যেমন সিপিআই(এম), সিপিআই, সিপিআই(এমএল), আঞ্চলিক গণমোর্চা, রাষ্ট্রীয় জনতা দল যৌথ বিবৃতিতে উচ্ছেদের নামে বর্বর পুলিশি অত্যাচার এবং গুলিচালনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে। নবগঠিত অসম জাতীয় পরিষদ, রাইজর দল, এইউডিএফ সহ প্রায় সব বিরোধী দল বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি রাজ্যজুড়ে পালন করে চলেছে।
রাজ্য প্রশাসন এই অঞ্চলে ১৯১৬ সালে বিজেপি শাসনে আসার পর থেকে বাসিন্দাদের দিনের পর দিন উৎপীড়ন করে আসছে। ‘গরুখুটি কৃষি প্রকল্প’ স্থাপনের নামে এ অঞ্চলে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর অমানুষিকভাবে উচ্ছেদ করা কার্যকে সাম্প্রদায়িক, সংবিধান বিরোধী এবং চরম বর্বরতার নিদর্শন বলে অভিহিত করেছে সিপিআই(এম)। দাবি তুলেছে বিকল্প সংস্থাপনের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ করা বন্ধ করতে হবে এবং পুলিশের নৃশংস অত্যাচারে এবং গুলিচালনায় নিহত এবং আহতদের পরিবারবর্গকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ সহ উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোকে অবিলম্বে পুনর্সংস্থাপন করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে যে সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিপিআই(এম)। উল্লেখযোগ্য, সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা শিলচরে খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করেছেন যে, রাজ্য সরকার আরএসএস’র সাহায্য নিয়ে হিন্দুদের সুরক্ষা দেবে এবং অসমকে দ্বিতীয় কাশ্মীরে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করবে। এ ধরনের মন্তব্য সংবিধান বিরোধী, এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চূড়ান্ত নিদর্শন। সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা এই উচ্ছেদ অভিযানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন এবং বর্বর গুলিচালনার নিন্দা করেছেন। ২৯ সেপ্টেম্বর সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্যা বৃন্দা কারাত ধলপুর অঞ্চল পরিদর্শন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুপ্রকাশ তালুকদার, পার্টির বিধায়ক মনোরঞ্জন তালুকদার সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। বৃন্দা কারাত নিহত ও আক্রান্ত পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন। িতনি সেই অঞ্চলের মানুষদের ওপর যে বর্বরোচিত আক্রমণ করা হয়েছে ও তাঁরা এখনও যে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন তা সংবাদ মাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে সিপিআই(এম) কংগ্রেস, এইউডিএফ, সহ বিভিন্ন দলের বিক্ষোভ প্রদর্শন চলছেই।
বরপেটা জেলার কলাগাছিয়াতে সিপিআই(এম)’র প্রতিবাদ সভা।
অন্যদিকে বিজেপি এবং আরএসএস পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠন এই উচ্ছেদ কার্যকে ন্যায্যতা প্রদানের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছে, যাতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তীব্র হয়। এমনকী গরুখুটিতে উচ্ছেদের জন্য ‘জন সচেতন মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন মুখ্যমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞকে জানিয়ে মিছিল করেছে গুয়াহাটিতে।
শিপাঝার ধলপুর চর অঞ্চলে ৭৭ হাজার বিঘা জমি অবৈধ বেদখলকারীরা দখল করেছে এমন অভিযোগ একাংশ জাতীয়তাবাদী সংগঠনের। প্রাক্তন ‘আসু’ সদস্যদের নিয়ে গঠিত ‘সতীর্থ মঞ্চ’, ‘প্রব্রজন বিরোধী মঞ্চ’ প্রভৃতি সংগঠনের অভিযোগ ,শিপাঝার রেভিনিউ সার্কেলের অন্তর্গত কুরুয়া, ধলপুর, কিরাকারি প্রভৃতি চর অঞ্চলে ব্যাপক বেদখল হয়েছে। সেখানকার অনেকটা জমি চারণভূমি (Professional grazing reserve, PGR) এবং Village grazing reserve (VGR)। আরটিআই করে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে বলা হয়েছে, এই চর অঞ্চলের ৭৭,৪২০ বিঘা জমি নাকি সবটাই বেদখলকারীর হাতে রয়েছে। যার প্রায় ৪০০০ বিঘা জমি হচ্ছে ‘চারণভূমি’। কিন্তু এর কোনো নির্দিষ্ট সীমা সংক্রান্ত তথ্য প্রশাসনের হাতে নেই।
অসমের মোট জমির ৪.৬ শতাংশ হচ্ছে চর অঞ্চল। এই চর অঞ্চলে বসবাস করে অসমের মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। এইসব অঞ্চলে বসবাসকারীরা কয়েক পুরুষ ধরে এখানকার জমির ক্ষণভঙ্গুরতার সাথে নিরন্তর সংঘাতের স্বাক্ষর বহন করছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৫০ সালে অসমে প্রবল ভূমিকম্প হয়েছিল। তার ফলে ব্রহ্মপুত্রের গভীরতা এবং নাব্যতা হ্রাস পায় এবং ব্রহ্মপুত্রের বুকে চরসৃষ্টিও বৃদ্ধি পায়। নদীর এক কুলে যখন ভাঙন হয় অন্যকুলে নতুন চর গড়ে ওঠে। এভাবেই নদীর ভাঙাগড়ার খেলা চলতে থাকে। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কোথাও নতুন করে চর সৃষ্টির খবর পেলে কঠোর পরিশ্রম করে তাকে বাসযোগ্য করে তোলে। কোথাও করে কৃষিভূমি কোথাও গোরুমোষের খুঁটি। চরের জমিতে এভাবেই গড়ে ওঠে জীবনচর্যা। চলে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান আর সংগ্রাম। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্মর নতুন নতুন চরে প্রব্রজন চলতে থাকে। সরকারি ভূমিনীতি এবং প্রকল্পের স্বরূপ এমনই যে, প্রব্রজনের এই মানচিত্রকে সুষম করার পরিবর্তে আরও জটিল করে তোলে।
গবেষক ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ এবং সীতা ভরালী নেওগের অধ্যয়নে দেখিয়েছেন যে, অসমের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য যেসব মানুষ উচ্ছেদের মুখে পড়েন তাদের তো বটেই, অসমের খুব কম সংখ্যক মানুষের জমির পাট্টা আছে। অসমের অধিকাংশ জমি এজমালি, ট্রাইবেল বেল্ট, একসনা ইত্যাদি করে সরকারি জমি হিসেবে ঘোষিত। এইসব জমিতে বসবাসকারী মানুষকে আইনি ভাষায় বেদখলকারী হিসেবে ঘোষণা করা যেতেই পারে। ট্রাইবেল বেল্টের বহু জমি আবার শিল্প স্থাপনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। সেখান থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের নথিভুক্ত করা হয়নি। অন্যের জমিতে কৃষিকর্ম করা ভূমিহীনের সংখ্যাও কম নয়। তাই উচ্ছেদ, স্থানান্তরিত ইত্যাদিতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা সরকারি হিসাব থেকে প্রকৃত পক্ষে বহুগুণে বেশি। একইভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নদীর পাড়ে বসবাসকারীদের এক বিরাট অংশ নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা বহুলাংশে ব্যক্তিগত জমির অধিকারী না হওয়াতে যৎসামান্য সাহায্য থেকেও বঞ্চিত হয়। তারা নিরুপায় হয়ে সরকারি জমিতে বসতি স্থাপন করে এবং বারে বারে উচ্ছেদের মুখে পড়ে। উল্লেখযোগ্য যে, নদী ভাঙন এবং অন্যান্য আর্থসামাজিক কারণে অভ্যন্তরীণ প্রব্রজনের স্বরূপ জানতে পারার কোনো তথ্যই সরকারের হাতে নেই। ২০১৫ সালে প্রথমবার ভাঙনে আক্রান্তদের জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল। যদিও এটা কতদূর কার্যকর হয়েছিল তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ক্ষতিগ্রস্তরা নিজেরাই অস্থায়ী ক্যাম্প করে অথবা বাঁধের ওপর বসবাস করে, জমি লিজে নিয়ে চাষাবাদ করে। ওই ক্যাম্পগুলো কখনও সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন কিছু বন্দোবস্ত করে, কিন্তু প্রয়োজনীয় সরকারি পরিকাঠামোর অভাবে এ ধরনের বন্দোবস্তিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মূল্য অধিক হয়ে ওঠে। এ ধরনের রাজনীতিকরণের জন্যই নতুন নতুন বিবাদের সূত্রপাত ঘটে। এভাবে ভাঙনে আক্রান্ত মানুষ অসমের বরপেটা, গোয়ালপাড়া, ধুবুড়ি, হাজো, মঙ্গলদৈ প্রভৃতি বিভিন্ন স্থান থেকে এ অঞ্চলে বসতি করেছে, জমি চাষোপযোগী করে কৃষি কাজে আবার যুক্ত হয়েছে, তাও আজ তিন প্রজন্ম আগে থেকেই। শোনা যায় শিপাঝার রেভিনিউ সার্কেলের এইসব অঞ্চলে সত্তরের দশক থেকেই বসতি শুরু হয়েছিল। স্থানীয় লোকেরা দখলি জমি এইসব হতভাগ্য মানুষের কাছে বিক্রি করেছিল।
গণতান্ত্রিক দেশে যখন শাসকগোষ্ঠী বৃহৎ সংখ্যক মানুষের সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হয় তখন নাগরিক অসন্তুষ্টি প্রশমনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী মতাদর্শকে রাষ্ট্র সামাজিক ন্যায্যতা প্রদান করার তোষণকারী নীতি গ্রহণ করে। তাই কখনও বিদেশি নাগরিক, কখনও ‘জাতি জমি ভিটে’ রক্ষার স্লোগানের মাধ্যমে এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তদুপরি সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী মতাদর্শের সাথে একে মিলিয়ে বর্তমানের সরকার বিভিন্ন জনবিরোধী কার্যের স্বরূপ ধামাচাপা দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ধরনের জনসাধারণের সামাজিক দ্বন্দ্বের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রয়োগ আমরা এ অঞ্চলে আবার প্রত্যক্ষ করলাম। এই প্রয়োগ যে সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন না করে তাকে আরও গভীর করেছে তা বলাই বাহুল্য।
সংখ্যালঘু মানুষের কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা কৃষিভূমিতে নতুন করে ‘কৃষি প্রকল্প’ চালু করার জন্য উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে জানালেও এই ভূমি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে পারে বলে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন। হিমন্তবিশ্ব শর্মা কার্যভার গ্রহণ করে ধলপুরে বেদখল উচ্ছেদ করার ঘোষণা করেছিলেন। কিছুদিন আগে প্রাচীন ধলপুর শিবমন্দিরে মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত হয়ে বেদখলকারীর কবল থেকে উদ্ধার করে মন্দির পুননির্মাণের ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছিলেন। সাথে ধলপুর পাশ্ববর্তী গরুখুটিতে বেকার যুবক-যুবতীদের নিয়ে সমবায় ভিত্তিতে কৃষি খামারের ঘোষণাও করেছিলেন। বিজেপি’র বিতর্কিত বিধায়ক পদ্ম হাজারিকার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছিল এই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা এবং কৃষি খামার গড়ে তোলার জন্য। তাদের প্রত্যক্ষ মদতেই এই ঘটনাগুলো হয়েছে। এখন চাপে পড়ে একাংশকে পুনর্সংস্থাপনের কথা মুখে বলছে। বিজেপি-আরএসএস যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তারা সন্দেহভাজন বিদেশি অর্থাৎ বাংলাদেশি বলেও প্রচার করছে। প্রশ্ন উঠেছে, যদি তারা সন্দেহভাজন তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা এতদিন নেওয়া হয়নি কেন? কেনই বা তাদের আবার জমি দিয়ে পুনর্বাসনের কথা বলা হচ্ছে? আসলে এরা কেউ বিদেশি নয়, সংখ্যালঘু মুসলমান। সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে নিজেদের অকর্মণ্যতা ঢেকে রাখাই এইসব প্রচারের উদ্দেশ্য। পুলিশের চোখের সামনে এক ফটোগ্রাফারকে যেভাবে পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যক্তির ওপর উঠে উল্লাস আর লাফালাফি করতে দেখা গিয়েছিল তা নিশ্চয়ই বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তারা যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রচারে অনেকটা সফল হয়েছে এঘটনা বোধহয় সেকথাই প্রমাণ করে।