৫৯ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ১ অক্টোবর, ২০২১ / ১৪ আশ্বিন, ১৪২৮
কমিউনিস্ট নেতা এবং বিজ্ঞানী গঙ্গাধর অধিকারী প্রসঙ্গে
তপন মিশ্র
আলবার্ট আইনস্টাইন যে ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা এবং বিজ্ঞানীর গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করে ব্রিটিশ সরকারকে খোলা চিঠি লেখেন তাঁর নাম ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আইনস্টাইন চিঠি লেখেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ডকে। তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয়।
ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী বার্লিনের হাম্বোল্ট বিশ্ববিদ্যালয় (Humboldt-Universitat) থেকে রসায়ন বিজ্ঞানে পিএচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং তাঁর মার্কসবাদের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারেই আইনস্টাইন আসেন এবং গঙ্গাধর অধিকারীর সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়। ওখানেই ওনার সঙ্গে আইনস্টাইন কিছু সময় তাঁর গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ডঃ অধিকারী ১৯২২ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে রসায়ন বিজ্ঞান গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বার্লিনে গবেষণা করার সময় ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এবং আলবার্ট আইনস্টাইনের গবেষণা বিষয়ক বক্তৃতার একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা ছিলেন। এখান থেকেই তাঁর আইনস্টাইনের সঙ্গে পরিচয়। ডঃ অধিকারীর বন্ধু এবং সতীর্থদের মধ্যে ছিলেন দুই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড (Leo Szilard) এবং ইউজিন ভিগ্নার (Eugene Wigner)। দুজনেই ছিলেন হাঙ্গেরির মানুষ, কিন্তু গবেষণায় যুক্ত থাকার সুবাদে জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। এই দুজনই পরবর্তীকালে, যখন জার্মানিতে হিটলারের উত্থান হয় তখন দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং আমেরিকার মানহাটন গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। ‘নিউক্লিয়ার চেন রিঅ্যাকশন’ প্রযুক্তি আবিষ্কার ছিল জিলার্ডের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পরে তিনি বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ইউজিন ভিগ্নার ১৯৬৩-তে পরমাণুর মৌলিক কণা আবিষ্কার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৮৯৮ সালের ৮ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ের কাছে পানভেলে জন্ম গঙ্গাধর অধিকারীর। বাবা ছিলেন সরকারি দপ্তরে একজন করণিক। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসাবে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মুম্বাই প্রেসিডেন্সিতে অষ্টম স্থান পেয়ে স্কলারশিপ পান। তারপর ইন্টারমিডিয়েটে রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং ১৯২০ সালে গ্র্যাজুয়েট হন। ছাত্রাবস্থায় বাল গঙ্গাধর তিলক এবং এস এ ডাঙ্গের বক্তৃতা শুনতে যেতেন। ক্ষুদিরাম বসুর আত্মবলিদান তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর বিজ্ঞান গবেষণা তাঁর সামনে ছিল এক প্রেরণা। তারপর ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সেস-এ স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়াশোনার জন্য অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি বিভাগে ভর্তি হন। এমএসসি ক্লাসে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বেরিয়াম সালফেটের বিভিন্ন ধরনের শিল্পে ব্যবহার সম্পর্কে। এই সংক্রান্ত গবেষণা সেই সময়ে এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, পরীক্ষক কেবল থিসিস দেখে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই গঙ্গাধর অধিকারীকে ডিগ্রি দেওয়ার সুপারিশ করেন। তারপর তিনি জার্মান ভাষা শিখে পিএইচডি’র জন্য জার্মানি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা এবং পরমাণু বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে জার্মানিতে প্রচুর গবেষণা চলছে। ১৯২২ সালের জুলাই মাসে কলম্বো থেকে জাহাজে তিনি ইয়োরোপ পাড়ি দেন।
গঙ্গাধর অধিকারী গবেষণার কাজ করেন অধ্যাপক ম্যাক্স ফোলমারের (Max Volmer) তত্ত্বাবধানে। ফোলমার ছিলেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির একজন প্রবাদপ্রতিম মানুষ। এই সময়টা খুব আর্থিক কষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। এক এক দিন কেবল একবেলা খাওয়া জুটত। পরে ফোলমার তাঁকে এক রাসায়নিক কারখানায় কিছু আংশিক সময়ের কাজের ব্যবস্থা করে দেন। ফোলমার ছিলেন সমাজবাদের আদর্শে দীক্ষিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে তিনি সমাজতান্ত্রিক জার্মানি (জিডিআর)-র একাডেমি অফ সায়েন্স-এর সভাপতি পদে নিযুক্ত হন। পরে এখানেও গঙ্গাধর অধিকারী ফোলমারের সঙ্গে দেখা করেন। গঙ্গাধর অধিকারী বেশ কয়েকজন ভারতীয় ছাত্রকে গবেষণায় সাহায্য করেন। তার মধ্যে একজন ছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ ডঃ সয়েদ হুসেন জাহির। ডঃ জাহির এক সময়ে সিএসআইআর (Council of Scientific and Industrial Research)’র ডাইরেক্টর জেনেরাল হন এবং পদ্মভূষণ উপাধিও পান।
১৯২৭ সালে গঙ্গাধর অধিকারী মধ্য ইয়োরোপের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হন। এই সংগঠন তৈরি করেন বিপ্লবী বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জার্মানি এবং মধ্য ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে যে ভারতীয় ছাত্ররা সেই সময়ে ছিলেন তাঁদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
কমিউনিস্ট হয়ে ওঠা
গঙ্গাধর অধিকারী জার্মানিতে থাকাকালীন অর্থাৎ ১৯২৭ সালে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি (কেপিডি)’র সদস্যপদ গ্রহণ করেন। মনে থাকতে পারে যে, ১৯১৪ সালে রোজা লুক্সেমবার্গের নেতৃত্বে স্পার্টাশিস্ট লিগের সদস্যরা এই পার্টির গোড়াপত্তন করেন। ১৯১৯ সালে রোজাকে নাজি বাহিনীর সহায়তায় সরকারি বাহিনী হত্যা করে। সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেই সময়টা ছিল জার্মানির অন্ধ জাতীয়তাবাদের যুগ এবং নাজিদের উত্থানের যুগ। তখনও জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতার মুখ্য ভূমিকায় আসেনি কিন্তু ইহুদি, ট্রেড ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচার ছিল তুঙ্গে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মান নাগরিকদের জাতীয়তাবাদকে তখন বিপথে পরিচালিত করার সমস্ত প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে। গঙ্গাধর অধিকারী কেপিডি’র দৈনিক পত্রিকা ‘Rote Fahne’ (Red Flag)-র ছিলেন অন্যতম প্রচারক।
দেশে ফিরেই বিভিন্ন সময়ে তিনি আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা এবং সি ভি রমনের সঙ্গে দেখা করেন এবং গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার কথাও হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কাজে যুক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে বিজ্ঞানের গবেষণা চালিয়ে যেতে পারেননি। অবশ্য সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় তিনি ছিলেন সেই সময়কার একজন অত্যন্ত অগ্রণী চিন্তাবিদ। দেশে ফিরেই কলকাতায় সারা ভারত শ্রমিক এবং কৃষকদের সভা এবং তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সভায় যোগ দেন তিনি। ১৯৩৩-৩৪ সালে তিনি সিপিআই’র সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য হিসাবে ১৯৪৩ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত কাজ করেন ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী।
১৯২৯ সালের মার্চ মাসে আরও ৩১ জনের সঙ্গে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে ডঃ অধিকারীও গ্রেপ্তার হন। এঁদের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন কমিউনিস্ট এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত চলা এই মামলায় অন্য যে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতারা যুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন পি সি জোশী, মুজফ্ফর আহ্মদ (কাকাবাবু), এস এ ডাঙ্গে, এস ভি ঘাটে, সউকত উসমানী (মুল্লা বক্স উস্তা), লেস্টর হটচিন্সন প্রমুখও। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকার এটা ছিল এক উজ্জ্বল দিক। কারাগারের মধ্যে ডঃ অধিকারী ছিলেন জেল গ্রুপের সম্পাদক।
তারপর
কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম অবধারিত। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার সময় এবং পরবর্তীকালে এই সংগ্রাম এক বাস্তব ঘটনা। আমাদের দেশেও তা হয়েছে। সংশোধনবাদীদের বিচ্যুতি পার্টির মধ্যে মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক বিভাজন সৃষ্টি করে। ১৯৬৪-তে পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগ হওয়ার পর ডঃ অধিকারীর মূল কাজ ছিল সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা। কমিউনিস্ট অন্দোলনের মধ্যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে না থাকলেও তাঁর লেখা বইগুলি যে সমাজবিজ্ঞানের গবেষকদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ তাতে সন্দেহ নেই। ১৯৮১ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সম্পাদনা হলো তথ্যসমৃদ্ধ বই “Documents of the History of the Communist Party of India”। এখানে ব্রিটিশ সরকারের রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির কর্মীদের ‘নৌ বিদ্রোহ’, কিষান সভার জমিদারতন্ত্র এবং ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই, ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গড়ার লড়াই, পর্তুগিজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই ইত্যাদির বর্ণনা পাওয়া যায়। বইটি ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা গণিতবিদ এবং টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর গবেষক অধ্যাপক দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বির মৃত্যুর পর গঙ্গাধর অধিকারী যে স্মারক প্রবন্ধ লেখেন তা স্মরণীয় হয়ে আছে।
২০০৬ সালের ২৮ মে মাসে তৎকালীন লোকসভা স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ডঃ গঙ্গাধর আধিকারী পুরস্কার (২০০৪) প্রদান করেন বলরাজ সাহানি-শাহির লুধিয়ানি ফাউন্ডেশন। চলচিত্র জগতের দুই প্রখ্যাত ব্যক্তির নামে এই প্রতিষ্ঠান। এখানে দেওয়া বক্তৃতায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় গঙ্গাধর আধিকারীর আদালতে দেওয়া একটি বয়ানের উদ্ধৃতি দেন। তা হলো, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন যে সওয়াল গঙ্গাধর আধিকারী সেশন জজের সামনে করেছিলেন - “...You may search through the whole file of the evidence and exhibits filed in this case and fail to lay your finger upon a single overt criminal act... . I am merely charged because I was a member of the Communist Party. The nature of the present case is such that the question of defending the individual does not arise. The question is to defend the Party, its ideology, its right to exist. ...It is not for your honour to question, but to implicitly obey the bidding of the executive which in this case is identical with the complainant... . Do your worst, we are not afraid in the least of the punishment you are going to give. We are ready to face even death for our patriotism, freedom, democracy and socialism...। অর্থাৎ তিনি বললেন যে, মামলার বন্দিদের বিরুদ্ধে অপরাধ খুঁজতে বিচারক অনেক চেষ্টা করবেন। এই মামলায় ব্যক্তির পক্ষে বলার কিছু নেই, বরং যা বলার সবটাই পার্টির পক্ষে এবং পার্টির মতাদর্শ এবং এই মতাদর্শ প্রচারের অধিকারের পক্ষে। তিনি আরও বলেন যে, আদালত যত ইচ্ছা শাস্তি প্রদান করতে পারে; এমনকী দেশরক্ষা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের জন্য মৃত্যুদণ্ডকেও তাঁরা ভয় পান না। স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএস নয়, এই সব কারণেই বামপন্থীদের অবদান উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।