E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০

‘অভিষেক ব্যানার্জি গ্রেপ্তার হবেন’ মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে জল্পনা

ঘটনার পরম্পরা দুই শাসকদলের বোঝাপড়াকেই স্পষ্ট করেছে


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সম্প্রতি প্রায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে মুখ্যমন্ত্রীর দু’টি মন্তব্য ঘিরে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। যথাক্রমে ২২ এবং ২৮ আগস্ট তিনি দু’টি মন্তব্য করে ত্রাসের সঞ্চার করেছেন তাঁর নিজের দলের মধ্যেই। ২২ আগস্ট লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থায় ইডি’র তল্লাশি অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, অভিষেক ব্যানার্জির বাড়িতে তল্লাশি মানে ‘তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালানো’। আবার ২৮ আগস্ট দলের ছাত্র-যুবদের এক সভায় আসন্ন ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি গ্রেপ্তার হবেন - খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন এ কথাও। তাঁর ফোনে আসা মেসেজের কথা উদ্ধৃত করে ২৮ আগস্ট বলেছেন এ কথা। কিন্তু ‘কে’ এই মেসেজ পাঠিয়েছে সে কথা মুখ্যমন্ত্রী ওই সভায় উল্লেখ করেননি। মুখ্যমন্ত্রীর এই দু’টি মন্তব্যের পরেই বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক জল্পনা এবং চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী এর আগে ২০১২ সালে সারদা কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছিলেন মদন মিত্র, মুকুল রায়, কুনাল ঘোষ এবং সৃঞ্জয় বসু এরা কি সবাই চোর? তারপরেই সে সময় মুকুল রায় বাদে বাকিরা গ্রেফতার হয় সিবিআই’র হাতে।

তবে জল্পনা আরও বেড়েছে ওই একই মঞ্চ থেকে বক্তব্য রাখার সময় অভিষেক ব্যানার্জি আবারও দুর্নীতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ প্রমাণ হলে ফাঁসিতে ঝুলে পড়ার কথা বলাতে। ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, আমাদের দেশে দুর্নীতিযোগ প্রমাণ হলেও, তাঁর ফাঁসির সাজা হয় না।

এদিকে একাধিক বিষয় উঠে এসেছে, আসছে। ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির সাম্প্রতিক বিদেশ যাত্রা আদালতের অনুমতি ছাড়াই হয়েছে। কেন তাকে ছাড় দিচ্ছে ইডি-সিবিআই? পেছনে কি সেই বোঝাপড়ার ‘পার্টিগণিত’? প্রশ্ন কিন্তু পিছু ছাড়ছে না।

এর পাশাপাশি ২৯ আগস্ট কলকাতার নেতাজি সুভাষ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল দিয়ে ঢুকে অন্তর্দেশীয় বিমান কেন ধরতে গেলেন ভাইপো সাংসদ তা নিয়েও কটাক্ষ এবং জল্পনা চলছে। মূল প্রশ্ন হলো, মোদি-অমিত শাহ এতো ছাড় দিচ্ছে কেন অভিষেক ব্যানার্জিকে? কী তার রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা?

২১ আগস্ট শুরু হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই-ভাইপোর পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’র নিউ আলিপুরের ঠিকানায় প্রায় দু’দিন ধরে তল্লাশি চলে। কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি ওই ঠিকানায় তল্লাশি চালায় ২২ আগস্ট ভোরবেলা অবধি। ২১ আগস্ট দুপুর থেকে অভিষেক ব্যানার্জির সংস্থায় ইডি তল্লাশি শুরু করতেই রাগে ফেটে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এই বেসরকারি সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে রাতভর তল্লাশির ঘটনাকে কার্যত তার নিজের বাড়িতেই ইডির হানা বলে মনে করেছেন মমতা ব্যানার্জি। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ওই বেসরকারি সংস্থায় অভিযানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমার বাড়িতে রোজই অত্যাচার করছে। কালকেও সারারাত করেছে। তিনি তল্লাশি প্রসঙ্গে বলেছেন, হঠাৎ করে চলে গেছে চার-পাঁচটা জায়গায়। সকাল ছটায় খবর পেলাম বাবুরা বেরিয়েছে। আমি আইনজীবীর কাছ থেকে জানতে পেরেছি।

মুখ্যমন্ত্রী আরও অভিযোগ করেন, তদন্ত সংস্থা বাড়িতে বিস্ফোরক রেখে যেতে পারে! বন্দুক রেখে যেতে পারে! কোটি কোটি টাকা ব্যাগে করে রেখে যেতে পারে অভিযুক্ত সংস্থার অফিসে!

যদিও মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর ওই সংস্থার দিকে কয়লা পাচার থেকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে সিবিআই এবং ইডির তদন্ত চলাকালীন বারবার অভিযোগের তীর উঠেছে। তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ এবারের তল্লাশিতেই কেন এত চটলেন সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে সাংসদ আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছেন, শুধু অভিষেক কেন মমতা ব্যানার্জিকেও কাস্টডিতে নেওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ইডি-সিবিআই’র কাছে আছে। বিকাশ ভট্টাচার্যের আরো মন্তব্য, দলের কর্মীদের চাঙ্গা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী এই সব বলছেন। এটা আতঙ্কে নিজের আত্মরক্ষার পরিমণ্ডল তৈরির চেষ্টা করে দলের কর্মীদের তাতিয়ে রাখার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

এরাজ্যের শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে ইডি-সিবিআই’কে নিয়োগ করেছে আদালত। কলকাতা হাইকোর্ট একের পর এক মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সেই নির্দেশের বিরোধিতা করে সরকার থেকে তৃণমূল নেতারা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে মামলা করলেও ইডি এবং সিবিআই তদন্তকে ঠেকানো যায়নি।

তল্লাশি প্রসঙ্গে ২৪ দিন পর বিদেশ থেকে ২০ আগস্ট কলকাতায় ফেরা অভিষেক ব্যানার্জি সম্পর্কে ‘ছেলেটা পরশুদিন ফিরেছে’ বলে সহানুভূতি কুড়োনোর চেষ্টা করেছেন তিনি। তবে তাঁর এই মন্তব্যে একটা বিষয় পরিস্কার তিনি লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড-এর যাবতীয় কাজকে কার্যত বৈধতা দিলেন দলের ভিতরে-বাইরে। আবার লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের কম্পিউটারে কিছু ফাইল ডাউনলোড করা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারকে তৎপর হতে দেখা গেছে মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে তৈরি হওয়া এই সংস্থা ঘিরে তার বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে বারে বারে পার্টির সিপিআই(এম) নেতা গৌতম দেব সংস্থার সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন নিয়ে অভিযোগ করেছেন আগেই।

এই তল্লাশি প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের ১৮ ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালানো হয়েছে কিন্তু তাঁদের লজ্জা নেই। যখন শিক্ষক নিয়োগ সহ অপরাধের টাকা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের মাধ্যমে পাচার হচ্ছিল তখন উনি কী করছিলেন বলুন। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের লোক যে কোম্পানিতে যুক্ত সেখানে তল্লাশিতে কী পাওয়া গেল? কেন ইডি হেফাজতে নিয়ে জেরা করছে না মুখ্যমন্ত্রী আর তাঁর ভাইপোকে? কেন তাকে চুপিসারে বিদেশে গিয়ে টাকা রাখার বন্দোবস্ত করে আসতে দেওয়া হল? তিনি বলেন, চোর দুর্নীতিগ্রস্তদের বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্টে পর্যন্ত সরকারি টাকায় আইনজীবী বসিয়ে রাখছে। মুখ্যমন্ত্রী দিল্লিতে সেটিং করতে পারেন, কিন্তু আমরা এই অপরাধচক্রের শেষ দেখতে চাই।

এর আগে ভাইপো সাংসদ সস্ত্রীক দুবাই হয়ে আমেরিকা চলে যাওয়ার ঠিক পরেই নিয়োগ দুর্নীতির একটি চার্জশিটে উল্লিখিত হয় তার নাম। খবরে প্রকাশ, ‘কালীঘাটের কাকু’ সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র অভিষেকের ‘বার্তা’ পৌঁছে দিতেন প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের কাছে। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ইডি তাদের চার্জশিটে ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছে, নিয়োগ দুর্নীতির টাকা ঘুরপথে এবং সরাসরি ঢুকেছে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থায়। সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’র মাধ্যমে সেই টাকা ঢুকেছে ব্যানার্জি পরিবারের ওই পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেডে। যদিও নির্বাচনী হলফনামা সহ অন্যত্র উল্লেখ ছিল অভিষেক ব্যানার্জি এখন আর যুক্ত নেই সংস্থায়, তা হলেও ইডি দাবি করেছে অভিষেক ব্যানার্জি লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড নামক সংস্থায় এখনও ডিরেক্টর। এবং তাঁর স্ত্রী রুজিরা ব্যানার্জিও। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে সেই টাকা ঢুকেছিল ব্যানার্জি পরিবারের ওই পারিবারিক সংস্থায়। এর আগে কয়লা পাচার কাণ্ডেও মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে এই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড নামক সংস্থায় কয়লা পাচারের টাকা ঢুকেছে বলে নির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছিল ইডি। তিন দফায় কীভাবে ৯৫ লক্ষ টাকা স্রেফ ‘কনসালটেন্সি’র নামে সংস্থার আকাউন্টে বেমালুম ঢুকেছিল তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তদন্তকারী আধিকারিকরা। সংবাদ মাধ্যমে আরও একটি অভিযোগ এসেছে। জনৈক তৃণমূল শীর্ষনেতার রাশিয়ান বান্ধবীর অ্যাকাউন্টে নাকি এই দুর্নীতির টাকা ঢুকেছে।

২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল এই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড নামক সংস্থায় বোর্ড অফ ডিরেকটর্সের অন্যতম সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ‘কালীঘাটের কাকু’ও। তারপর ওই সংস্থারই কর্মচারী হয়ে যান। এখন অভিষেক ব্যানার্জির বাবা এবং মা এই সংস্থার অন্যতম দুই ডিরেক্টর।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া অভিযোগ, কালীঘাটের তৃণমূলের দলীয় দপ্তরে বসে চাকরি বিক্রির চক্র চালাতেন এই সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র। অভিষেক ঘনিষ্ঠ গ্রেপ্তার হওয়া তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দোপাধ্যায়, বেসরকারি কলেজ সংগঠনের নেতা তাপস মণ্ডল এদের সবাইকে নিয়ে মুখোমুখি বৈঠক হতো। তারপর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বার্তা’ মানিক ভট্টাচার্যের কাছে নিয়ে যেতেন সুজয়। এই বার্তার মধ্যে ‘ভয়েস মেসেজ’ও ছিল।