৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
আবার বাজি কারখানায় বোমা বিস্ফোরণ
তৃণমূল-কি বাংলাকে জতুগৃহে পরিণত করতে চায়?
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ বা মৃত্যুমিছিল বন্ধের লক্ষণ নেই। ২৭ আগস্ট আবার বেআইনি বাজির কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটল রাজ্যে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় এবারে নিহতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ৯ জন। আহত বহু। চলছে লাশ পাচার। ঘটনাটি ঘটেছে উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরে। বেআইনি এই বাজি কারখানাটি ছিল দত্তপুকুর থানার জনবহুল মোচপোল এলাকায়। গ্রামবাসীরা অধিকাংশই বলেছেন, বিস্ফোরণে নিহত বাড়ির মালিক শামসুল আলি স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের তত্ত্বাবধানে এই মারণ ব্যাবসা চালাত দাপটের সঙ্গে। বাজির আড়ালে ওই কারখানায় বোমা তৈরি হতো। পুলিশ জানেও সেকথা। প্রতিবাদ করে লাভ হয় নি। মাসিক ‘বন্দোবস্তে’র জেরে অভিযোগকারীকেই পুলিশি হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। ঘটনায় ব্যাপক ক্ষুব্ধ এলাকার মানুষ। ক্ষুব্ধ প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, পাশের একটি ইটভাটায় কার্যত বিস্ফোরক নির্মাণের ল্যাবরেটরি চলত। বিস্ফোরণের তীব্রতায় ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েক হাজার ফুট দূরের বাড়িতেও দেহাংশ উড়ে গিয়ে পড়ে। এমনকী, কয়েকশো মিটার দূরের বাড়িতে জানালার কাচও ভেঙে চুরচুর হয়ে যায় বিস্ফোরণের অভিঘাতে। তাঁরা নিজেরাই দেখেছেন কারখানা থেকে দূরে কীভাবে ছিটকে পড়েছে কংক্রিটের ছাদ।
বিস্ফোরণস্থল একতলা বাড়িটির এবং লাগোয়া পাশের দোতলা বাড়ির একাংশেরও কার্যত একই অবস্থা। বিস্ফোরণের তীব্রতায় দুই বাড়ির ছাদের একাংশ উড়ে গিয়ে রাস্তা পেরিয়ে পড়েছে প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে পাশের বাড়ির উপর।
স্থানীয় বাসিন্দা মফিজুদ্দিন আলি জানিয়েছেন, তাঁর নতুন তৈরি বাড়ি ভেঙে পড়েছে বিস্ফোরণে। রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি আর তাঁর ছেলে। বহু টাকা ঋণ নিয়ে বানিয়েছিলেন বাড়ি। সেই টাকা শোধ করবেন কীভাবে, থাকবেন বা কোথায়, এখন তা নিয়েই চিন্তা তাঁর।
ঘটনার পরেই দু’টি পে-লোডার এনে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু করে পুলিশ। উদ্ধারকাজ চলাকালীনও মৃদু বিস্ফোরণ হতে দেখা যায়। অবস্থা গতিকে ফের দমকলের গাড়ি এনে ধ্বংসস্তূপে জল দেওয়া হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেকের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে সিপিআই(এম)। ২৭ আগস্টই ঘটনাস্থলে যান সিপিআই(এম) উত্তর ২৪ পরগনা জেলা নেতৃবৃন্দ। তৃণমূল ঘটনার দায় চাপাতে চাইছে আইএসএফ’র উপর। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ২৮ আগস্ট ঘটনাস্থলে যান এবং আতঙ্কিত গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন।
মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘কোনও বিপদ হলেই মুখ্যমন্ত্রী কারও না কারও ঘাড়ে দোষ চাপান। কখনো সিপিআই(এম), কখনো বামফ্রন্ট আবার এই ঘটনায় আইএসএফ-কে দায়ী করছেন। জেলা পুলিশ সুপারের দপ্তর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে এই কারখানা চলছিল কিভাবে। প্রশাসনের কাছে, পুলিশের কাছে, তৃণমূলের কাছে কোনো খবর ছিল না এটা হতে পারে?
সিপিআই(এম)’র দাবি, নিহতদের দশ লক্ষ টাকা ও আহতদের পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নেতৃবৃন্দ জানান, বামফ্রন্ট আমলে এই সমস্ত অঞ্চলে প্রত্যেক বাজি কারখানার ৬ মাস অন্তর পুলিশি নজরদারি চলত। বেআইনি কাজ দেখলে গ্রেপ্তার করা হতো। এখন সেসব উঠে গেছে। ফলে মর্মান্তিক বিস্ফোরণ ঘটছে আর মারা যাচ্ছেন তারা গরিব শ্রমজীবী মানুষ।
দত্তপুকুরের ঘটনা সম্পর্কে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘বারুদের স্তুপে বাংলা। তিন মাস যেতে না যেতেই এগরা, মালদহ, বজবজের পর আবারও ভয়াবহ বিস্ফোরণ। মুখ্যমন্ত্রীর কথার কোনো মূল্য থাকছে না! ভয়াবহ চেহারা রাজ্যের।’’
প্রসঙ্গত, এগরা বিস্ফোরণে ১১ জনের মৃত্যুর পর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমা চেয়েছিলেন রাজ্যের মানুষের কাছে। কিন্তু রাজ্যকে জতুগৃহে পরিণত করা থেকে বিরত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ মমতা ব্যানার্জির পুলিশ। তিনি হম্বিতম্বি করেই দায় সেরেছেন। এগরার ঘটনার পর পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। রাজ্যের সমস্ত বেআইনি বাজি কারখানার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার এবং বেআইনি বাজি কারখানার কর্মীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য নবান্ন থেকে নাকি নির্দেশ গিয়েছিল। তাও দত্তপুকুরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই নির্মম কাণ্ড রোখা গেল না কেন? কেন বিস্ফোরণ কাণ্ডে সহজ ধারা দিয়ে জামিন পেতে পরোক্ষে সহায়তা করা হয়? ওয়াকিবহাল অংশের বক্তব্য, ২৭ আগস্ট দত্তপুকুরে যা ঘটল, তাকে আর নিছক ‘দুর্ঘটনা’ বলা চলে না। প্রশাসন পরিণতি বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল আগাগোড়া। সবুজ বাজি তৈরির ক্লাস্টারের কথা বলে মুখরক্ষার চেষ্টা করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, অন্য দিকে প্রশাসনের পরোক্ষ মদতে ও উৎসাহে চলেছে নিয়মভাঙার খেলা।
এই ধরনের প্রায় প্রতিটি ঘটনায় তৃণমূল কংগ্রেস দুষ্কৃতী এবং পুলিশ প্রশাসনের আঁতাত একটি সাধারণ সত্য। শুরু সেই খাগড়াগড় থেকে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাজি কারখানা স্থাপনসহ সমস্ত নিয়ম অগ্রাহ্য করে কার্যত প্রশাসনের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে এই বাজি-সাম্রাজ্য। অঘটন ঘটলে প্রশাসনের আশ্বাস, কিছু দিন বেআইনি বাজি উদ্ধার, এবং ধরপাকড়ের প্রহসন। তার পর উত্তেজনা থিতিয়ে পড়লে ফের ‘যে কে সেই’। ঘটনার বিরাম নেই। পরিসংখ্যান থেকে বিষয়গুলি স্পষ্ট হবে আরও। এর আগে ১৬ মে এগরায় তৃণমূল নেতার বাড়িতে বাজি কারখানায় বোমা বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। বীরভূমের দুবরাজপুরেও বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে এ বছরই। হতাহতের কোনও সরকারি তালিকা প্রকাশিত হয়নি। তার আগেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজে ঘন বসতি এলাকাতেই অবৈধ বাজির কারখানায় বিস্ফোরণে এক মহিলা, এক শিশু সহ ৩জনের প্রাণ যায়। কিছু আগে ওই জেলারই মহেশতলায় আরেক বিস্ফোরণে নিহত হন ৩জন। এই জেলার নোদাখালিতেই ২০২১-এ বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন ৩ জন।
বিস্ফোরণ কেন্দ্রের তালিকা ঘাঁটলে উঠে আসছে উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটি, পশ্চিম মেদিনীপুরে কেশপুর, পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি, হুগলির মগরাহাটের নামও। নৈহাটিতে ২০২০’তে বিস্ফোরণে নিহত হন ৫ জন, ২০১৯-এ কেশপুরে নিহত হন ১ জন, ওই বছরই কাঁথিতে মারা যান ২ জন, হুগলির মগরাহাটে মারা যান ৩ জন। ওই ঘটনায় আহতও হন আরও ৩ জন।
২০১৮’তে উত্তর ২৪ পরগনারই হালিশহরে ৩ এবং ২০১৭’তে আমডাঙায় ৫ জন নিহত হন। ২০১৭’তে চম্পাহাটিতে ১ জন নিহত হন। ২০১৬’তে নীলগঞ্জ এলাকায় ১, বজবজে ২ জনের মৃত্যুর উল্লেখ রয়েছে তালিকায়। ২০১৫’তে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় বিস্ফোরণে নিহত হন ১২ জন। ২০১৪’তে বর্ধমানের ময়নায় ৩, ২০১৩’তে পাঁশকুড়ায় ৩, বর্ধমানের কালনায় ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি ঘটনাতেই আহত হয়েছেন একাধিক।