৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
ধূপগুড়ি বিধানসভা উপনির্বাচন
বামফ্রন্ট প্রার্থীর সমর্থনে এগিয়ে আসছেন কৃষক-খেতমজুর ও চা বাগান শ্রমিকরা
সঞ্জিত দে
প্রার্থীকে নিয়ে ধূপগুড়িতে মিছিলে সুজন চক্রবর্তী।
আগামী ৫ সেপ্টেম্বর ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে। ধূপগুড়ি ব্লকের ১টি পৌরসভা এবং ৯টি গ্রামপঞ্চায়েত ও নবগঠিত বানারহাট ব্লকের তিনটি গ্রামপঞ্চায়েতের ২৬০টি বুথের ২ লক্ষ ৬৮ হাজার ভোটদাতা এই নির্বাচনে তাঁদের অধিকার প্রয়োগ করবেন। নিরাপত্তার জন্য ইতিমধ্যে ১৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানো হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। এই বিধানসভা এলাকার মধ্যে কৃষি অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ গ্রাম যেমন আছে, তেমনি ৫টি চা বাগান সহ বনবস্তির বাসিন্দারা আছেন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র জয়ী প্রার্থীর মৃত্যু হয়। তার পনেরো দিনের মধ্যেই এই কেন্দ্রের উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা করে জাতীয় নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রস্তুত বামফ্রন্ট
ভোটের দিন ঘোষণা হতেই ধূপগুড়ি বিধানসভা এলাকায় প্রচারে নেমে যান সিপিআই(এম) কর্মীরা। রাজ্য বামফ্রন্ট দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সব দলের আগে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে। এই কেন্দ্রের প্রার্থী হলেন বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম)’র ঈশ্বর চন্দ্র রায়। যুব ফেডারেশনের কাজের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র রায় পার্টির কাজে যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ভাওয়াইয়া গানের সুপরিচিত একজন বেতার ও দূরদর্শনের শিল্পী। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। এই উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রার্থীকে সমর্থন করছে কংগ্রেস। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ - এক দীর্ঘ লড়াইয়ের সাক্ষ্য বহন করছে ধূপগুড়ি। যে লড়াইয়ের অন্যতম সেনানী ছিল কৃষক সমাজ সহ ধূপগুড়ির ছাত্র, যুব, শিক্ষক, মহিলা এবং গণতন্ত্রপ্রিয় শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক সমাজ। এই অঞ্চলের মাটি বরাবর লালঝান্ডাকে সাথি করে নিয়েছে। লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত সব স্তরেই আগাগোড়া বিপুল জয় হয়েছে লালঝান্ডার। একটা সময় যেমন জোতদার জমিদারের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই হয়েছে, তেমনি গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।
সত্তরের দশকে উত্তরখণ্ড আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রগতি রোখার জন্য মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে। যে আন্দোলনের মদত ছিল গ্রাম্য জোতদার, জমিদার ধনী শ্রেণির। লালঝান্ডা সেই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে শক্ত জমি বানিয়ে মেহনতি ভুখা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে নিবিড় জনসংযোগ তৈরি করেছিল। এই দশকেই খাদ্যের হাহাকার করা মানুষের মৃত্যু মিছিলকে রোধ করার ক্ষমতা অর্জন করেছিল লালঝান্ডা।
বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হবার পর গ্রাম শহরের সাধারণ মানুষের চাহিদা ও দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়নের ধারাকে আন্দোলনের চেহারা দিতে পেরেছিল ধূপগুড়ির মাটি। নকশাল-কংশাল নামে বিশৃঙ্খলা, খুন সন্ত্রাসের বিপথগামী রাজনৈতিক কার্যকলাপকে প্রতিহত করতে পেরেছিল ধূপগুড়ি। দুর্বার কৃষক আন্দোলন একসময় আন্তর্জাতিক প্রচার পেয়েছিল রেডিয়ো পিকিং-এর মাধ্যমে। পাশাপাশি চা বাগিচা শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধাতে সক্ষম হয়েছিল এই এলাকার লালঝান্ডার নেতৃত্বে। নব্বইয়ের দশকের শেষ লগ্নে বামফ্রন্ট সরকারকে উচ্ছেদ করতে ফের উত্তরবঙ্গকে নিয়ে পৃথক কামতাপুর রাজ্যের দাবি করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম নেয় ধূপগুড়ির মাটিতে। আরএসএস’র পরিকল্পনায় বিজেপি’র মদতে এই আন্দোলন শুরু হয়। এই সময়েই আরএসএস’র পরিকল্পনায় তৃণমূলের জন্ম হয়।
১৯৯৮ সালেই তৃণমূল দল তৈরি করে নেত্রী সর্বপ্রথম উত্তরবঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্লোগান তোলেন - ‘‘দক্ষিণে মমতা উত্তরে কামতা’’। ২০০০ সালের ৪ মার্চ থেকে সিপিআই(এম)’র নেতাকর্মীদের ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদী কেএলও’র হিংস্র আক্রমণ শুরু হয়। ৫ জন পার্টিনেতা-কর্মী খুন হন। এরপর ২০০২ সালের ১৭ আগস্ট ধূপগুড়িতে সিপিআই(এম) অফিসে হামলা চালিয়ে একদিনেই উগ্রপন্থীরা খুন করে ৫জন পার্টি নেতা-কর্মীকে। শহিদ হন মোট ১০ জন। ধূপগুড়ির মাটি শহিদের রক্তে সিক্ত হয়, বাতাস বারুদের গন্ধে ভারি হয়। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী হিংসাত্মক রক্তক্ষয়ী প্রাণঘাতী আন্দোলন প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে ধূপগুড়ির গণ আন্দোলন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো মমতা ব্যানার্জি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর ঘটনায় অভিযুক্ত এই দাগি অপরাধী প্রায় সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন স্থানীয় তৃণমূল নেতা বনে গেছেন।
২০১১ সালে রাজ্যে বামপন্থী আন্দোলনের বিপর্যয়ে সরকার বদল ঘটলেও ধূপগুড়ি বিধানসভার মানুষ লালঝান্ডার পক্ষেই রায় দিয়ে সাথে থেকেছেন। ব্যতিক্রম ছিল ২০২১’র নির্বাচন। এইরকম এক এলাকায় বিধানসভার উপনির্বাচন হচ্ছে। এই নির্বাচনী লড়াইয়ে ইতিমধ্যে পার্টির সর্বস্তরের কর্মী, সমর্থক, দরদি প্রচারে শামিল হয়েছেন, কেউ ঘরে বসে নেই। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী দু’দফায় এসে কয়েকদিন থেকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মিছিল সভা করে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এই ভোট সরকার বদলের ভোট নয়, কিন্তু ধূপগুড়ির উপনির্বাচনের ফলাফল বিজেপি’র বিভাজনের বিরুদ্ধে, তৃণমূলের সন্ত্রাসের চুরি, লুট আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজ্যের তামাম মানুষের গণআন্দোলনের এক নতুন পথ দেখাবে। পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্য জীবেশ সরকার, জিয়াউল আলম প্রতিদিন কর্মসূচিতে থাকছেন। পার্টির কোচবিহার জেলার সম্পাদক অনন্ত রায় নিয়মিত প্রচার কর্মসূচিতে আসছেন। রাজ্য কমিটির সদস্য সায়নদীপ মিত্র ধূপগুড়িতে প্রচারে রয়েছেন। পার্টির জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য প্রতিদিন সব কর্মসূচির পরিকল্পনা করে নজরদারি করছেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে। ধূপগুড়ির দুই প্রাক্তন সিপিআই(এম) বিধায়ক লক্ষ্মীকান্ত রায় এবং মমতা রায়ও প্রচারে যুক্ত রয়েছেন। মমতা রায় প্রতিদিন মহিলা দল নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছেন। ছাত্র যুবদের রাজ্য নেতৃত্ব সকলে ধূপগুড়ির সব গ্রাম শহরে প্রচারের ঝড় তুলছে। আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলার ছাত্র যুব নেতৃত্ব এসে যোগ দিয়েছেন প্রচারে। এবিটিএ, এবিপিটিএ’র জেলার নেতৃত্ব বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন, রাজ্য নেতৃত্ব সভা করেছেন। আগামী ১ সেপ্টেম্বর ধূপগুড়ির ডাকবাংলো ময়দানে আয়োজিত বিশাল নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য রাখবেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম,কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী, সিপিআই(এম) নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি, প্রার্থী ঈশ্বর চন্দ্র রায় এবং পার্টির জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য।
ধূপগুড়িতে কলেজ, প্রচুর নতুন স্কুল স্থাপন, হাসপাতালের উন্নতি, কৃষি নিয়ন্ত্রিত বাজার, দমকল কেন্দ্র, বিদ্যুতের সাব স্টেশন, পৌরসভা গঠন, গ্রামের রাস্তা, সেচের ব্যবস্থা যা কিছু হয়েছে সব বামফ্রন্ট সরকার করেছে। তৃণমূল দশ বছরে নতুন কিছু করে দেখাতে পারেনি। দুই বছর বিজেপি’র বিধায়ক বিধানসভায় থেকেও ধূপগুড়ির মানুষের জন্য কোনো দাবি তুলতে পারেনি। এখন ধূপগুড়ির দাবি মহুকুমা করার, হাসপাতালকে স্টেট জেনারেল হাসপাতাল করার। এসএফআই, ডিওয়াইএফআই গত আট বছর ধরে এই দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। বিগত তিন বছর ধরে নাগরিক কমিটি আন্দোলন করছে। মহকুমা করার দাবি নিয়ে তৃণমূলের মিথ্যাচার ধূপগুড়ির মানুষ বুঝে গেছেন। ২১-এর বিধানসভার নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী ধূপগুড়িতে সভা করে বলে যান মহকুমা করার প্রসেস চলছে। সিপিআই(এম) প্রার্থী ঈশ্বর চন্দ্র রায় প্রচার করতে গিয়ে বলছেন, তিনি বিধানসভায় যেতে পারলে ধূপগুড়ির কৃষক, চা শ্রমিক সহ নাগরিক সমাজের দাবি তুলে ধরবেন এবং দাবির পক্ষে সব আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকবেন। ধূপগুড়ি কৃষিপ্রধান বাণিজ্যিক এলাকা। কৃষকের উপর নির্ভর করে অর্থনীতি আবর্তিত হয়। এই অর্থনীতিকে আরও উন্নত করার পাশাপাশি তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে এবং বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতিকে প্রতিহত করে এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই লড়ছে বামফ্রন্ট।