৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
দিল্লিতে সংযুক্ত কিষান মোর্চা ও শ্রমিক কর্মচারীদের যৌথ কনভেনশন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের করপোরেট স্বার্থবাহী জনবিরোধী নীতির প্রতিরোধে দেশের কেন্দ্রীয় শ্রমিক-কৃষক ও খেতমজুরদের সংগঠন একযোগে দেশব্যাপী সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়েছে। ২৪ আগস্ট নয়া দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এক বিশাল কনভেনশন থেকে এই আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। কনভেনশন থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে, ২০২১ সালে ৩ অক্টোবর কৃষক আন্দোলনের সময় লখিমপুর খেরিতে কৃষক হত্যার ঘটনাকে স্মরণ করে ৩ অক্টোবর দিনটিকে কালা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। ওই দিন কৃষক খুনের ষড়যন্ত্রকারী কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত ও তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার দাবি জানানো হবে। এছাড়া আগামী ২৬ থেকে ২৮ নভেম্বর দেশের প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলের রাজধানীতে অবস্থিত রাজভবনের সামনে দিনরাত মহাপাদভ (মহা সমাবেশ) অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া এদিনের কনভেনশন থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে, আগামী ডিসেম্বর ও জানুয়ারি দুই মাস ধরে দেশব্যাপী সুদৃঢ় ও সর্বাত্মক প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হবে।
কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন ও ফেডারেশনসমূহ এবং কয়েক শত কৃষক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ - সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে দিল্লিতে এই সুবিশাল কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই যৌথ কনভেনশনে বিভিন্ন রাজ্য থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক-কৃষক ও খেতমজুর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সভাপতি কে হেমলতা সহ সঞ্জয় সিং (আইএনটিইউসি), বন্ত সিং ব্রার (এআইটিইউসি), মুকেশ গালাক (এইচএমএস), হরিশ ত্যাগী (এআইইউটিইউসি), জি আর শিবশঙ্কর (টিইউসিসি), সুচেতা দে (এআইসিসিটিইউ), ফরিদা জালিস (এসইডব্লিউএ) এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী কনভেনশন পরিচালনা করেন।
কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, সারা ভারত কৃষক সভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে, কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা সহ দর্শন পাল (সংযুক্ত কিষান মোর্চা), অশোক সিং (আইএনটিইউসি), অমরজিৎ কাউর (এআইটিইউসি), জি দেবরাজন (টিইউসিসি), অতুল কুমার অঞ্জন, মেধা পাটেকর, অভীক সাহা প্রমুখ।
কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় যারা রয়েছে তারা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। ক্রমান্বয়ে কর্মচ্যুতির ফলে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাচ্ছেন না, তাঁদের কোনো ভরতুকি বা সাহায্য করছে না কেন্দ্রের এই সরকার। তাই কনভেনশন থেকে এই সরকারকে অপসারণের ডাক দেওয়া হয়েছে।
এই কনভেনশন দেশের কোটি কোটি শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর সহ সমস্ত অংশের শ্রমজীবী মানুষের কাছে এই যৌথ কর্মসূচিকে সফল করতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেছে, বিগত ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রের সরকার করপোরেটমুখী যে ধ্বংসাত্মক ও বিপর্যয়কর নীতি জোরালোভাবে অবলম্বন করে চলেছে তার ফলে দেশের শ্রমিক, কৃষক সহ সমস্ত অংশের সাধারণ মানুষের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে এবং তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সম্প্রীতির যে পরিবেশ ছিল তাকে বিনষ্ট করছে।
কনভেনশন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে - কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির ধ্বংসাত্মক নীতির বিরুদ্ধেও দুর্বার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। কনভেনশন গুরুত্বের সাথে ঘোষণা করেছে, ২০২৩ সাল জুড়ে প্রচার ও প্রতিরোধ আন্দোলনকে সমস্ত স্তরে আরও বৃহত্তর সংগ্রামের লক্ষ্যে পরিচালিত করা হবে।
কনভেনশনের ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চার গৌরবোজ্জ্বল আন্দোলনের কথা। এই আন্দোলনের ফলে সরকার কৃষক বিরোধী আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিপিসিএল, সিইএল সহ কয়েকটি ইস্পাত শিল্পের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের উদ্যোগ কিছুদিনের জন্য হলেও রোখা সম্ভব হয়েছে। ভাইজাগ স্টিল প্ল্যান্টের বেসরকারিকরণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্দোলন জনগণের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, পণ্ডিচেরি, জম্মু-কাশ্মীর, চণ্ডীগড় এবং হরিয়ানায় বিদ্যুৎ কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে প্রকল্প কর্মীরাও যৌথ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁদের ভাতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। শ্রমিক-কৃষকদের বিভিন্ন প্রতিরোধ আন্দোলনের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করে কনভেনশন বলেছে, কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলনই একমাত্র পারে এই শাসনব্যবস্থাকে টলাতে এবং আক্রমণাত্মক নীতিকে রদ করতে।
এদিনের কনভেনশন আরও বলেছে, কেন্দ্রে করপোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাতের সরকার যে দেশ বিরোধী ধ্বংসাত্মক নীতি নিয়ে চলেছে, তার ফলেই দেশের শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা ও দেশের দুর্দশা বাড়ছে এবং এরাই যে প্রকৃত শত্রু সে সম্পর্কে শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। কেন্দ্রের শাসকদল এবং যে সমস্ত রাজ্যে এই দল সরকারে রয়েছে তারা নিজেদের শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে লুট ও লুণ্ঠনের রাজত্ব চালাচ্ছে। শ্রমিক, কৃষক এবং সাধারণ মানুষের জ্বলন্ত সমস্যাকে ঘুরিয়ে দিতে সমাজে সক্রিয়ভাবে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করছে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে দুর্বল করছে, যাতে করপোরেটদের সুবিধা হয়। এজন্য করপোরেট মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াকে সক্রিয়ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। একইধরনের বিভেদকামী মেরুকরণের শাসন-নীতির ফলেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জাতি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। মণিপুরে জাতিদাঙ্গায় অনেক প্রাণ গেছে, মহিলাদের ওপর অত্যাচার হয়েছে। সম্প্রতি হরিয়ানার নুহুতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কনভেনশন।
কনভেনশন গুরুত্ব আরোপ করেছেঃ নয়া উদারনীতির সংকট থেকে দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে সাধারণ মানুষের হাতে আরও অর্থের সংস্থান করতে হবে, যারা দেশের সম্পদ তৈরি করবে এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখবে। সরকারি আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে তাদের বিধিবদ্ধ ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বজনীন করতে হবে। তারমধ্যে কৃষকদের দুর্দশা ঘোচাতে কৃষি উপকরণ সহ সরকার পরিচালনাধীন মান্ডিগুলি সহ কৃষকদের ভরতুকির ব্যবস্থা করা, উপযুক্ত হারে ফসলের সহায়কমূল্য প্রদান ইত্যাদি। করপোরেট, ধনী এবং অতিধনীদের উপর করের হার বৃদ্ধি করেই এটা সম্ভব। কনভেনশন সর্বসম্মতিক্রমে যে দাবিসনদ তৈরি করেছে তাতে রয়েছেঃ শ্রমিকদের প্রতি মাসে ভাতা ন্যূনতম ২৬ হাজার টাকা এবং সমস্ত শ্রমিককে ১০ হাজার টাকা করে পেনশন দিতে হবে। এছাড়া ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সি২+ ৫০ শতাংশ হারে নিশ্চয়তা দিতে হবে। একইভাবে চারটি ক্ষতিকারক শ্রমকোড এবং বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২০ বাতিল করা এবং এমএনরেগা প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ এবং দিনপ্রতি মজুরি ৬০০ টাকা করার পাশাপাশি শহরাঞ্চলেও এই প্রকল্পের প্রসার ঘটানোর দাবি জানানো হয়েছে।
এছাড়াও কনভেনশন গরিব, মধ্য কৃষক ও খেতমজুরদের এককালীন ঋণ মকুবের দাবি জানিয়েছে।
সংযুক্ত কিষান মোর্চা এবং কেন্দ্রীয় শ্রমিক-কর্মচারী সংগঠন লিফলেট, পোস্টার, দেওয়াল লিখন, গ্রুপ সভা, জাঠা, মিছিল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এই সমস্ত দাবি নিয়ে দেশের শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরসহ অন্যান্য মেহনতি অংশের মানুষের মধ্যে নিবিড় প্রচার সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়েছে।