৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
উপনির্বাচনঃ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে ত্রিপুরা
হারাধন দেবনাথ
সিপিআই(এম) প্রার্থীর প্রচার ধনপুরে।
৬০ সদস্যর ত্রিপুরা বিধানসভার দুটি আসনে উপনির্বাচন ৫ সেপ্টেম্বর। শাসক বিজেপি’র সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে সিপিআই(এম)-র। বর্তমান বিধানসভায় সিপিআই(এম) ১০, প্রধান বিরোধী দল তিপ্রা মথার ১৩, কংগ্রেস ৩, শাসক বিজেপি এবং শরিক আইপিএফটি’র ৩২ জন সদস্য রয়েছে। এই নির্বাচনে জয়-পরাজয় সরকারের অস্তিত্বে এখুনি কোনো প্রভাব না ফেলতে পারলেও সিপিআই(এম) প্রার্থীরা জয়ী হলে বিধানসভায় জনগণের কণ্ঠস্বর শক্তিশালী হবে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী, গণতন্ত্র বিরোধী, সংবিধান বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে রায় দেবার সুযোগ এসেছে উপ-নির্বাচনে। রাজ্যের যে দুটো কেন্দ্রে উপনির্বাচন হচ্ছে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিম এবং উপজাতি ভোটার রয়েছেন। ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বক্সনগর কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। ধনপুর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী বর্তমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর জয়ের পিছনে ভোট জালিয়াতি, বিপুল অংকের টাকার খেলার অভিযোগ ছিল। শাসক বিজেপি’র গণতন্ত্র নিধন যজ্ঞের বিরুদ্ধে উপনির্বাচনে মানুষের মিলিত লড়াইয়ের ভাষা পাচ্ছে লালঝান্ডার প্রচার। কংগ্রেস ও তিপ্রা মথার সাধারণ সমর্থকদের অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে সিপিআই(এম) প্রার্থীর প্রচারে।
পরাজয়ের আতঙ্কে শাসক বিজেপি ভোটকে প্রহসনে পরিণত করার যাবতীয় প্রয়াস নিয়েছে। পাঁচ সেপ্টেম্বর উপভোটের দিন দুপুর বারোটার পর বক্সনগর ও ধনপুর কেন্দ্র থেকে বামফ্রন্ট প্রার্থী তুলে নেবে বলে মন্তব্য করেছেন আইন মন্ত্রী। এর পরিপ্রক্ষিতে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা বা মন্ত্রীর মুখে এ ধরনের বক্তব্য গণতন্ত্র ও ভোটারদের প্রতি মারাত্মক হুমকি। তিনি তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দলের লোকদের নির্দেশ দিয়েছেন আগামী ৫ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচনের দিন বক্সনগর ও ধনপুর বিধানসভা কেন্দ্রের বুথে বুথে বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দিতে হবে। বিরোধী দলের সমর্থকদের বুথের লাইন থেকে বের করে দিতে হবে। একজন মন্ত্রী এভাবে কথা বলা এক ধরনের ফৌজদারি অপরাধও। মন্ত্রীর ভিডিও সংগ্রহ করে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশন, সি ইও এবং দুটি কেন্দ্রের রিটার্নিং অফিসারের কাছে অনুরোধ জানান জীতেন্দ্র চৌধুরী। তিনি অভিযোগ করেন, রতন লাল নাথসহ শাসকদলের আরও বেশ কয়েকজন নেতা-মন্ত্রী দুটি বিধানসভা কেন্দ্রে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাস ছড়াতে মদত দিচ্ছেন।
বিজেপি’র সভায় যেতে বাধ্য করা হয়। না গেলে চাকরি কেড়ে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। উপস্থিত সকল কর্মীকে এক হাজার টাকা ও একটি করে শাড়ি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী টিংকু রায় উপস্থিত ছিলেন দুটি স্থানে। মন্ত্রী বিকাশ দেববর্মা ধনপুর বিধানসভার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের বলছেন, এখনি দরখাস্ত দিলে রাবার বাগান অনুমোদন দিয়ে দেবেন। আরেক মন্ত্রী তো হুমকিই দিলেন, উপভোটের দিন দুপুর বারোটার পর পুরো কেন্দ্রেই জবরদখল করবে।
সিপিআই(এম) প্রার্থীর প্রচার বক্সানগরে।
খোদ মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা ২৮ আগস্ট বক্সনগর কেন্দ্রের কমলনগরে মাদ্রাসা শিক্ষক এবং মুসলিম ইমামদের নিয়ে নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিয়েছেন। গত ২৭ আগস্ট বক্সনগর বিধানসভা কেন্দ্রের মাণিক্যনগরে সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে নির্বাচনী সভা করেছে বিজেপি। রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী, বিজেপি প্রার্থী তফাজ্জল হোসেন এবং অন্যান্য বিজেপি নেতারা সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে ভোটের প্রচার সভা - কী নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে না? যারা ওই সভাগুলোতে উপস্থিত থাকছেন তাদের দিয়েই কী করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে প্রশাসন? এনিয়ে ইলেকশন ম্যানুয়েল কী বলে? কেন আচরণবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক।
লালঝান্ডার প্রচারে শাসক দল আতঙ্কিত। জনগণের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নেই বলে হুমকি, প্রলোভন, উপঢৌকন ইত্যাদি শাসকদলকে করতে হচ্ছে। মানুষকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রচারে, সভায়। এরপরও স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া মিলছে না। তাদের ভোটও যে পাবে তা নিশ্চিত নয় বিজেপি। তবে সন্ত্রাসই শেষ কথা নয়। লালঝান্ডার সভাকে ঘিরে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হচ্ছে থলিবাড়িতে। বামফ্রন্ট প্রার্থী কৌশিক চন্দকে জয়ী করার আহ্বানে আয়োজিত সভায় সমবেত হওয়ার আগে মিছিলে পা মেলান লড়াকু মানুষ। বাজার এলাকায় ওঠে আলোড়ন। সভাস্থলের অতি কাছে রয়েছে উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। দোকানি ধনঞ্জয় ত্রিপুরা সেদিকেই আঙুল দেখিয়ে বললেন, মাধ্যমিক পাস করে থলিবাড়িতেই পড়তে পারছে ঘরের সন্তানরা। শুধু কি স্কুল। রাস্তাঘাট, বাজার, মার্কেট স্টল, হাসপাতাল সবই তো গড়ে গেছে বামফ্রন্ট সরকার। থলিবাড়ি হয়ে উদয়পুর, বিলোনীয়া দু’দিকেই যাওয়া যায় এখন। চন্দুল,দক্ষিণ ও উত্তর-তৈবান্দাল, মোহনভোগ মিলিয়ে বিরাট পরিবর্তন। মোহনভোগে গোমতীর পাকা সেতু ঘুচিয়ে দিয়েছে প্রত্যন্তের তকমা। রাবার বাগানে আর্থিক সমৃদ্ধি এসেছে বহু পরিবারে। বিজেপি’র যত ভয় লালঝান্ডার লড়াই-আন্দোলনে। তাই ভয়-ভীতি দেখিয়ে মানুষকে ঘরে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। তবুও লালের দুর্বার আকর্ষণ মানুষের মন থেকে কেড়ে নিতে পারেনি। সুযোগ পেলেই মানুষ পথে নামছেন বিজেপি’র ধ্বংসের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে। গত ৫ বছরে থলিবাড়িতে উন্নয়নমূলক একটি প্রকল্পও গড়ে উঠেনি। মাকড়শার জালের মতো থাকা পাকা রাস্তাগুলি ক্ষতবিক্ষত সংস্কারের অভাবে। মানুষ এদের আর চাইছে না।
লালঝান্ডার প্রচারে না আসার জন্য শাসক বিজেপি হুলিয়া জারি করে রেখেছে। এরপরও বিভিন্ন বাজারে, বাড়ির উঠোনে, মিছিলে, পদযাত্রায় সাহসে ভর করে আসছেন মানুষ। সেদিন দেখা গেল ধনপুর বিধানসভা কেন্দ্রের বাঁশপুকুরে বাজার সভায় সরাসরি আসেননি, কিন্তু দোকানে বসে, দূরে দাঁড়িয়ে অনেকে সিপিআই (এম) নেতৃত্বের ভাষণ শুনছেন। আলাপচারিতায় স্পষ্ট হয়েছে, সভায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কাও আছে। মোহনভোগ ও ধনপুরের সভায় জাতি-উপজাতি উভয় অংশের মানুষের উপস্থিতিতে ঐক্যের কোলাজ ফুটে উঠে। ধনপুর বাজারের এক ব্যবয়াসী বলছিলেন, গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ না হলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিকের পরাজয় নিশ্চিত ছিল। এবারের নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি বিধানসভার প্রধান বিরোধীদল তিপ্রা মথা।
গত বিধানসভা নির্বাচনে ধনপুর কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থীর ভোট ছিল ১৯,৪৪৬ বামফ্রন্ট প্রার্থীর ১৬,৬৬৩, তিপ্রা মথার প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৮, ৬৯২। মানুষ ভোট দিতে পারলে এবং সেই ভোট রফা করতে পারলে লালঝান্ডার জয় কেউ আটকাতে পারবে না। বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ সিপিআই(এম) প্রার্থীদের জয়ী করার আহ্বান জানিয়ে বলছেন, উপনির্বাচনে বিজেপি’কে আটকান। গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন শক্তিশালী করতে আরও দুটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর চাই।