৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
রান্নার গ্যাসের দাম কমানো কি গার্হস্থ্য জীবনে সুবিধা আনবে?
ঈশিতা মুখার্জি
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা হঠাৎ সিদ্ধান্ত করেছে যে, রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের দাম সিলিন্ডার পিছু ২০০ টাকা কম করে দেবে সরকার। এটা স্পষ্ট যে, সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা দেখায় না এবং ধাপে ধাপে মাত্রাতিরিক্তভাবে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, তারাই যখন গ্যাসের দাম কমানোর কথা বলে, তখন এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো অভিসন্ধি কাজ করে। সংবাদের শিরোনামে যে অভিসন্ধির কথা উঠে আসছে তা হলো, ২০২৩ সালের মধ্যে যে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে এবং ২০২৪ সালে যে লোকসভা নির্বাচন রয়েছে সেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে গেলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে এরকম একটা কোনো ঘোষণার প্রয়োজন হতো। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বগামী, চূড়ান্ত বেকারির জন্য মানুষের হাতে আয় নেই, তাই সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা দুর্বিষহ। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি সরকারকে নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে কোনোভাবে কোনো পণ্যের মূল্য হ্রাসের কথা বলতেই হতো। তাই তারা বেছে নিল এমন একটি পণ্য যার মূল্য একমাত্র সরকারের ইচ্ছাতেই মাসে মাসে বেড়ে গেছে। এখন প্রতি সিলিন্ডার রান্নার গ্যাসের দাম হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। কীভাবে বেড়েছে রান্নার গ্যাসের দাম প্রতি মাসে? পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম মাসে মাসে বাড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি সরকার শুধুমাত্র তেল কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর জন্য। তাই যখন বিশ্বে তেলের দাম কমেছে, তখনও আমাদের দেশে বিজেপি সরকারের বদান্যতায় দেশের ভিতরে পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে। কোনোভাবেই এই দাম পণ্য পরিষেবা কর বা জিএসটির আওতায় সরকার আনেনি। বরং এই পণ্যে পণ্য পরিষেবা কর আরোপ করা হলে মানুষের কিছুটা সুরাহা হতো। কোনো কিছুই সরকার করেনি। আজকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা সিলিন্ডার পিছু ২০০ টাকা কমিয়ে দিলে অতীতের মূল্যবৃদ্ধি তো মিথ্যা হয়ে যায় না। যে কারণে দাম কমানো, তা যে আসন্ন নির্বাচন, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সরকার দাম কমানোর জন্য এমন এক পণ্য বেছে নিয়েছে, যার দাম মাসে মাসে বাড়িয়ে এমনিতেই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। রান্নার গ্যাস হলো সেরকম একটি পণ্য।
২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতি সিলিন্ডারের দাম ছিল ৯০৫.৫০ টাকা । এর পর ২০২২ সালের মার্চ মাসেই তা একলাফে হয়ে গেল ৯৫৫.৫০ টাকা। তারপর তা বেড়ে যেতেই লাগল। ২০২২ সালের ৭ মে বেড়ে হলো ১০০৫.৫০ টাকা। মাত্র কয়েকদিনের ফারাকে ১৯ মে হলো ১০০৮.৫০ টাকা। সেই থেকে গত এক বছরে মাঝে মাঝেই রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে শুধুমাত্র তেল কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর জন্য। তাই ২০০ টাকা কমালেও তেল কোম্পানি তার মুনাফা বজায় রাখতে পারবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সুরাহা কোথায় হবে? জানা যায় যে, বর্তমানে ৩৩ কোটি গ্রাহক রয়েছে রান্নার গ্যাসের। মূল্যবৃদ্ধির প্রকোপ এতই বেশি যে এবং গ্যাসের দাম বাড়তে বাড়তে এমন তুঙ্গে উঠেছে যে, তা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরেই চলে গেছে। মানুষকে সুরাহা দিতে হলে এক বছর ধরে যে ধাপে ধাপে কখনো ৫০টাকা, কখনো ৫ টাকা হিসেববিহীনভাবে যে হারে দাম বেড়েছে, তার সবটুকুই তুলে নিতে হবে। সবটুকু তুলে না নিলে মানুষের কোনো উপকারে আসবে না। বর্তমানে প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম কলকাতায় ১১২৯ টাকা, মুম্বাইতে ১১০২ টাকা, দিল্লিতে ১১০৩ টাকা এবং চেন্নাইতে ১১১৮.৫০ টাকা। অন্তত এক বছর আগের দামে ফিরে না আসলে কি সুরাহা হবে সাধারণ মানুষের? তাই স্বাভাবিকভাবেই ন্যায্য দাবি উঠছে - কোনো ভিত্তি ছাড়া হঠাৎ ২০০ টাকা কমানো নয়; যদি সরকারের সদিচ্ছা সত্যিই থাকে তবে সরকারকে ধাপে ধাপে যে বৃদ্ধি হয়েছিল দামের, তা কমিয়ে দিতে হবে।
বিজেপি সরকারের পক্ষে কি তা সম্ভব হবে? সরকারের একটি প্রকল্প হল উজ্জ্বলা যোজনা। সরকার খুব গর্ব করে এই প্রকল্পের কথা বলে। বিজ্ঞাপনে ছবি থাকে মহিলার এবং সিলিন্ডারের। সরকারের দেওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে ১০ কোটি পরিবার এই প্রকল্পের আওতায় পড়ে। এই প্রকল্পে যে ছাড় ঘোষিত ছিল অর্থাৎ সিলিন্ডার পিছু ২০০ টাকা সেটা ছাড়াও আরও বাড়তি ২০০ টাকা অর্থাৎ ৪০০ টাকা সিলিন্ডার পিছু ছাড় দেওয়া হবে। কিন্তু এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য কি দরিদ্র পরিবারকে ভরতুকি দেওয়া? আদপেও তা নয়। এই প্রকল্পের আওতায় গ্রাহকেরা প্রথম সিলিন্ডারে ভরতুকি পেয়ে থাকেন। গ্যাসের চুলা কেনা হয়ে গেলে দ্বিতীয় সিলিন্ডার থেকে আর ভরতুকি বহাল থাকে না। বিজেপি সরকার এমন কোনো প্রকল্প ঘোষণা করে না যার ফলে গ্যাস কোম্পানির মুনাফায় হাত পড়ে। তাই এই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা আমাদের জানায় যে, গত বছর উজ্জ্বলা যোজনার ১০ শতাংশ গ্রাহক আর দ্বিতীয় বার সিলিন্ডার কেনেননি। ১২ শতাংশ গ্রাহক দ্বিতীয়বার সিলিন্ডার নিয়ে আর কেনেননি। ৫৬.৫ শতাংশ গ্রাহক চার বারের পর আর কোনো সিলিন্ডার কেনেননি। এই প্রকল্পের হাতছানি থাকলেও আদপেও তা শেষপর্যন্ত মানুষকে স্বস্তি দেয়নি। ভবিষ্যতেও দেবে না। এই প্রকল্প আসলে কোম্পানির বিক্রি বাড়ানোর একটি প্রক্রিয়া। ভরতুকি দিয়ে দাম কমিয়ে বহু মানুষকে এর আওতায় নিয়ে এসে তাকে আসলে পরবর্তী সময়ে মূল্যবৃদ্ধির জালে জড়িয়ে নেওয়া।এবারও তাই করতে চলেছে সরকার।
সর্বশেষ যে কৌতুক করেছে সরকার তা হলো প্রধানমন্ত্রীর উক্তি। তিনি বলেছেন, রাখি উৎসবে তিনি দেশের মহিলাদের উজ্জ্বলা প্রকল্প উপহার দিলেন। প্রথমত, বেশিরভাগ পরিবারে রান্নার কাজ মহিলারা করেন, কিন্তু রান্না তো মহিলারা শুধু নিজের জন্য করেন না। তাহলে ক্ষুধার মুখ মহিলাদের হতো না। তাহলে অনাহারের মুখ মহিলাদের হতো না। তাহলে রান্নার গ্যাস কী করে শুধুমাত্র মহিলাদের পণ্য হলো? দেশে মহিলাদের রোজগার এবং ক্রয়ক্ষমতা এত নয় যে তাঁরাই গ্যাসের সিলিন্ডার কিনবেন। যে পণ্য মহিলারা কেনেন না, ভোগ করেন না , শুধু ব্যবহার করেন তা কী করে মহিলাদের পণ্য বলে প্রধানমন্ত্রী বলেন তা বোঝা যায় না। মহিলাদের পণ্য সিলিন্ডার তখনই হয় যখন মহিলাদের রান্না করাই প্রধান এবং একমাত্র কাজ বলে কেউ মনে করেন। আমাদের দেশের সরকার চালায় বিজেপি দল। তাদের প্রধানমন্ত্রী তো মহিলাদের সম্পর্কে এরকম অবমাননাকর কথা ভাববেন এটাই স্বাভাবিক। রান্নার গ্যাস পরিবারের ব্যবহার্য পণ্য। তবে গ্যাসের অভাবে খড়কুটো জ্বেলে বা উনুনে রান্না করলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মহিলারা পড়ে যান। এ কথা অবশ্য শোনা যায় না শাসকদলের কাছে।
কিন্তু যদি মূল প্রশ্নে ফিরে আসা যায়, তা হলো এই যে, গ্যাসের এই সামান্য দাম কমালে কি দেশের খুচরো মূল্যবৃদ্ধির সুরাহা হবে? যে হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে বিশেষকরে খাদ্যপণ্যে, তার উপশম হবে কীভাবে? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, গ্যাসের দাম সাময়িক হলেও কমবে, রান্না কী করবেন মানুষ? খাদ্যপণ্যের দাম একেবারেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। চাল, গম থেকে, শাকসবজি দাম মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়ে চলেছে ভোজ্য তেলের দাম। কীভাবে তার সুরাহা হবে? কী রান্না করবেন মহিলারা? কোথা থেকে জোগাড় হবে খাবার? সামান্য টাকা গ্যাসের দাম একটু কমলে সাময়িকভাবে একটু বেশি খাবার কিনতে পারবেন কি দরিদ্র পরিবারগুলি? প্রশ্ন এখানেই। খাদ্যপণ্যের দাম তো লাগামছাড়াভাবে বাড়ছে? আদৌ কি সুরাহা হবে এই ভাবে?
রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি দেশের পরিবারগুলির আর্থিক স্থিতির এক মৌলিক সমস্যা। সেই মৌলিক সমস্যাকে অস্বীকার করে আপৎকালীন বিজ্ঞাপন দিয়ে খানিকটা দাম কমানো পরিবারগুলির আর্থিক সংকট কমাবে না।