৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
কল্পনার দেবলোকে মানুষের বিজয় তোরণ
সৌরভ চক্রবর্তী
লোমহর্ষক দিন ছিল ২৩ আগস্ট। সারা ভারত অধীর আগ্রহে এবং তীব্র স্নায়ুর চাপে অপেক্ষা করছিল চন্দ্রাভিযানে ভারতের ইতিহাস সৃষ্টির সাক্ষী হতে। পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে ভারতের চন্দ্রাভিযান ৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম কি পারবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পাখির পালকের মতো অবতরণ করতে! পারবে কি পৃথিবীর চারটি দেশের মধ্যে অন্যতম হতে যারা চন্দ্রপৃষ্ঠ জয় করতে সমর্থ হয়েছিল?
সিঁদুরে মেঘও ছিল। চন্দ্রযান-২-এর অসাফল্য। এবার কি চন্দ্রযান-৩ মিশন সেই অসাফল্যকে জয় করে সাফল্যের বিজয় পতাকা ওরাতে পারবে চন্দ্রপৃষ্ঠে? এসব নিয়েই সারাদিন কেটেছে ওই দিন।
চূড়ান্ত স্নায়ুযুদ্ধের খেলা শুরু হলো বিকেল ৫ টা ৪৫ মিনিট থেকে। শুরু হলো ইসরোর লাইভ টেলিকাস্ট। প্রথমেই আমরা দেখলাম, চন্দ্র কক্ষ থেকে পাক খেতে খেতে চাঁদের ট্রাজেক্টরি বা গমন পথ ধরে বিন্দু বিন্দু করে এগিয়ে চলেছে ল্যান্ডার বিক্রম। তারপর সেই লোমহর্ষক দৃশ্য -
গ্রাফিক্সে ভেসে উঠলো ল্যান্ডার বিক্রম। প্রথমে কাত হওয়া অনুভূমিক অবস্থান, পরে অনুভূমিক থেকে উলম্ব অবস্থানে নিজেকে নিয়ে এলো বিক্রম। তারপর যেই ধীরে ধীরে চাঁদের মাটিতে পা রাখল বিক্রম, ঘড়িতে তখন সন্ধে ৬ টা বেজে ৪ মিনিট - যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল টেলিভিশনে চোখ রাখা প্রতিটি ভারতবাসীর।
নির্মাণ হলো ইতিহাস। ভারত প্রথম দেশ যে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নিজের তেরঙ্গা পতাকাকে উড্ডীন করলো।
শেষ ১৫ মিনিট, যাকে বলা হচ্ছিল ‘‘টেরর অব ফিফটিন মিনিটস’’ - চন্দ্রযান-৩ মিশন দেখালো চূড়ান্ত প্রযুক্তির প্রদর্শন।
গতিবেগ কমানো, অবস্থানের পরিবর্তন, ‘অ্যাটিচিউড হোল্ড ফেজ’, ‘ফাইন ব্রেকিং ফেজ’, ‘ফাইনাল ডিসেন্ট ফেজ’, এবং সর্বশেষে ‘টাচ ডাউন।’
এতগুলো পর্বে পরপর লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী রইলাম আমরা। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই পর্বের সবটাই ল্যান্ডার বিক্রম স্বাধীনভাবে নানা ক্যামেরা এবং সেন্সরের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনভাবে একাই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেছে। এই পর্বে বেঙ্গালুরুর ‘MOX - ISTRACK’ -এর পরিচালনার কোনো বিষয় ছিল না।
বেঙ্গালুরু থেকে কোনো ধরনের কমান্ড দেওয়া হয়নি।
যা আমরা চোখের সামনে দেখলাম সবটাই করেছে ল্যান্ডার বিক্রম।
বিক্রমের প্রথম চ্যালেঞ্জটাই ছিল চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোটার দূরে চাঁদের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে তার অনুভূমিক অবস্থান থেকে প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোন পরিবর্তন করে উলম্ব অবস্থায় আসা - এ ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই জায়গাতেই অসফল হয়েছিল ২০১৯-এর চন্দ্রযান-২ মিশন।
চাঁদের পৃষ্ঠের ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে শুরু হয়েছিল পাওয়ার ব্রেকিং পর্ব। এখানে বিক্রম ৪টা ইঞ্জিনকে চালু করেছিল এবং তা ছিল ‘রেট্রো ফায়ারিং’, মানে গতিবেগ কমিয়ে আনতে উলটো দিকে চাপ দেওয়া। সে যখন ৬.৮ কিলোমিটার দূরে তখন সে দুটো ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছিল, দুটো ইঞ্জিন চালু ছিল।
প্রথম পর্বে ল্যান্ডার বিক্রমকে ১.৬৮ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড থেকে ৩৫.৮ মিটার প্রতি সেকেন্ডে গতিবেগ নামিয়ে আনতে হয়েছিল, তারপর সেখান থেকে ৬০ মিটার প্রতি সেকেন্ড গতিবেগে নিয়ে আসতে হয়েছিল - এটা ছিল ‘রাফ ব্রেকিং ফেজ’। বিক্রম তখন ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে ৭.৪২ কিলোমিটার দূরে নেমে আসবে - ৬৯০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল এই পর্ব।
এরপরে ‘অ্যাটিচিউড হোল্ড ফেজ’ - বিক্রম যখন চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭.৪২ কিলোমিটার দূরে, ১০ সেকেন্ডের এই পর্ব। আশ্চর্যজনক পর্বের সাক্ষী ছিলাম আমরা। বিক্রম ৩.৪৮ কিলোমিটার চলতে চলতে তার নিজের অবস্থান অনুভূমিক থেকে উলম্ব অবস্থানে নিয়ে এলো। তখন তার অনুভূমিক গতি ৩৩৬ মিটার প্রতি সেকেন্ড এবং উলম্ব গতি কোন ৬০ মিটার প্রতি সেকেন্ড। এখানে ল্যান্ডার বিক্রমের ৭৪০ নিউটনের চারটে ইঞ্জিন কাজ করেছে যেখানে চন্দ্রায়ন ২ মিশনে, ৪০০ নিউটনের চারটে ইঞ্জিন ছিল। এরসাথে বিক্রমের ৮ টা ছোটো থ্রার্স্টার ইঞ্জিন কাজ করেছে।
এবার ‘ফাইন ব্রেকিং ফেজ’ এ উলম্ব অবস্থান থেকে ২৮.৫২ কিলোমিটার থেকে ৮০০ থেকে ১০০০ মিটারে নেমে এলো। ১৭৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল এই পর্ব।
বিক্রম যখন ৭.৪২ কিলোমিটার দূরে তখন ‘অ্যাটিটিউড হোল্ড ফেজ’ চালু হয়েছিল। এখানেই চন্দ্রায়ন ২ ব্যর্থ হয়েছিল। নানা যন্ত্রপাতির গণনা এই সময় হলো।
বিক্রম যখন ৮০০ থেকে ১০০০ মিটারে নেমে এলো, সেখানেই আবার ক্যামেরা দিয়ে পরীক্ষা করে যাচাই করা হলো - তারপর যখন নেমে এলো ১৫০ মিটারে - হ্যাজার্ড ভেরিফিকেশন বা বিপদ আপদের পরীক্ষা হলো এবং এই পর্বে এসে তার একটা বিকল্প পছন্দের সুযোগ ছিল। সে কি এখান থেকেই উলম্বভাবে নেমে যাবে নাকি খানা খন্দ এড়াতে সর্বাধিক ১৫০ মিটার অনুভূমিক ভাবে গিয়ে তারপর উলম্বভাবে নামবে।
চন্দ্রযান-২ তে ‘ফার্স্ট অর্ডার অটোমেটেড গাইডেন্স সিস্টেম’ ছিল আর চন্দ্রযান-৩ এ ‘সেকেন্ড অর্ডার অটোমেটেড গাইডেন্স সিস্টেম’ দেওয়া হয়েছিল। চন্দ্রযান-২ এ পাঁচটা ইঞ্জিন ছিল, যার একটা কেন্দ্রীয় ইঞ্জিনকে শেষে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, এর ওপর নানা গণনার ভার ছিল, এই কাজে ভুল হয়েছিল। এবার এই ইঞ্জিন বাদ দেওয়া হয়েছিল। বিক্রমের চারটে পাকে যথেষ্ট পোক্ত করা হয়েছিল। নামার পছন্দের জায়গার সীমা চন্দ্রযান-৩-এ যেখানে ছিল ৫০০ বাই ৫০০ মিটার, চন্দ্রযান-২ এ সেখানে হলো ৪ কিমি বাই ২.৫ কিমি। নামার শেষ গতিবেগের সীমা অনুভূমিক গতি বেগের ক্ষেত্রে ২ মিটার প্রতি সেকেন্ড থেকে বাড়িয়ে ৩ মিটার প্রতি সেকেন্ড করা হয়েছিল।
বিক্রম যে ক্যামেরা এবং সেন্সরের ব্যবহার করেছে
লেসার ইনারসিয়াল রেফারেন্সিং অ্যান্ড এক্সেলারোমিটার (এলআইআরপি) প্যাকেজ-এর সাহায্য অবস্থান, গতি,উচ্চতা, পারিপার্শ্বিকতা স্থির করা হয়েছিল।
লেসার ডপলার ভেলোসিমিটার (এলডিভি)-র সাহায্যে লেসার রশ্মির স্পন্দন পাঠিয়ে গতিবেগ ঠিক করা হয়েছিল।
কেএ ব্যান্ড অ্যালটিমিটার - রেডিয়ো তরঙ্গের সাহায্যে দূরত্ব মাপা হয়েছিল।
ল্যান্ডার পজিশন ডিটেকশন ক্যামেরা (এলপিডিসি) - অবতরণ স্থলের ছবি তোলা।
লেসার অলটিমিটার - লেসার রশ্মি পাঠিয়ে উচ্চতা নির্ণয়।
এলডিভি - লেসার রশ্মির সাহায্য গতিবেগ স্থির করা।
ল্যান্ডার হরাইজেন্টাল ভেলোসিটি ক্যামেরা (এলএইচভিসি) - অনুভূমিক গতির নথি রাখা।
ল্যান্ডার হ্যাজার্ড ডিটেকশন অ্যান্ড অ্যাভয়ডেন্স ক্যামেরা (এলএইচডিএসি) - খানা খন্দ ও বিপদ আপদ চিহ্নিতকারী।
ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে চন্দ্রযান-৩ মিশন
৪ জুলাই শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টারের দ্বিতীয় লঞ্চিং প্যাড থেকে ৪ জুলাই ‘লঞ্চ ভেহিকেল মার্ক ৩’ চন্দ্রযান-৩ কে নিয়ে উৎক্ষিপ্ত হয়। ১৭০বাই ৩৬,৫০০ কিমি কক্ষপথে চন্দ্রযানের প্রপালশন মডিউল এবং ল্যান্ডার - রোভার মডিউল স্থিত হয়। মানে চন্দ্রযান একবার পৃথিবীর খুব কাছে ১৭০ কিমি এবং সবথেকে দূরে যখন সে চলে যাবে পৃথিবীর থেকে দূরত্ব হবে ৩৬,৫০০ কিমি। এইখানে চন্দ্রযানের ইঞ্জিনের সাহায্যে অবস্থান পরিবর্তন করে পাঁচবার কক্ষপথ বাড়ানো হয়েছিল। শেষের কক্ষপথ ছিল ২৩৬ বাই ১,২৭,৬০৩ কিমি।
এরপর ১ আগস্ট পৃথিবীর বন্ধনে আবদ্ধ কক্ষপথ ছেড়ে চাঁদের কাছাকাছি ২৮৮ বাই ৩,৬৯,৩২৮ কিমি কক্ষপথে চন্দ্রযানকে স্থিত করা হলো - এই কৌশলের নাম হলো ট্রান্সলুনার ইঞ্জেকশন।
এরপর ৫ আগস্ট ‘লুনার অরবিট ইনসারশন’ ক’রে চন্দ্রযান-৩-কে চন্দ্রকক্ষে স্থিত করা হলো। এরপর পাঁচবার কক্ষপথ ছোটো করে এনে ১৬ আগস্টে ১৫৩ বাই ১৬৩ কিমি কক্ষপথে আসে।
১৭ই আগস্ট প্রপালশন মডিউল থেকে ল্যান্ডার - রোভার মডিউলের বিচ্ছেদ ঘটে। প্রপালশন মডিউলের কাজ এখানেই শেষ হয়।
এরপর দুবার ডিবুস্টিং বা গতিবেগ এবং কক্ষপথ কমিয়ে আনার কাজ হয়। ২০ আগস্ট দ্বিতীয় ডিবুস্টিং- এর পর ল্যান্ডার- রোভার মডিউল ২৫ বাই ১৩৪ কিমির কক্ষপথে স্থিত হয়।
এই সমস্ত কাজটা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হয় বেঙ্গালুরুতে ইসরোর টেলিমেট্রি, ট্রাকিং অ্যান্ড কমান্ড নেটওয়ার্কের (STRAC) মিশন অপারেশন কম্পেক্স MOX-এর মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দ্বারা।
ল্যান্ডিংয়ের সময়টুকু ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্র বেঙ্গালুরুর MOS - ISTRAC র সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতেই সব হচ্ছে।
ল্যান্ডার বিক্রম এবং চন্দ্রযান-২-এর অরবাইটারের বেঙ্গালুরুর MOX- ISTRAC যোগাযোগ চলছে। রোভার প্রজ্ঞান কেবলমাত্র ল্যান্ডার বিক্রমের সাথেই যোগাযোগ করতে পারবে। মহাকাশ থেকে আসা সংকেত 'ইন্ডিয়ান ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক ' (যার এ্যান্টেনা রয়েছে বেঙ্গালুরু থেকে কিছু দূরে রামনগর জেলার বায়ালালুতে) এর মাধ্যমে MOX - ISTRAC এর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
ISTRAC এর আরও গ্রাউন্ড স্টেশন আছে - লক্ষ্ণৌ,বায়াক (ইন্দোনেশিয়া), শ্রীহরিকোটা, পোর্টব্লেয়ার, ব্রুনেই, ত্রিবান্দ্রমে।
এছাড়াও ইসরোর ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের মধ্যে নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি এবং ইয়োরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সাথে যোগাযোগ আছে - তারও চন্দ্রযান-৩ এর দেখভাল করছে।
চন্দ্রযান-৩-এ এআই ব্যবহার
ইসরো জানিয়েছে চন্দ্রায়ন ৩ মিশনে ‘আরটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স’ বা এআই ব্যবহার করা হয়েছে। পথ নির্দেশিকা, যান চলাচল বা নেভিগেশন, নিয়ন্ত্রণে মেসিন লার্নিং এআই ব্যবহার করা হয়েছে।
অবতরণের সময় ল্যান্ডার হ্যাজার্ড ডিটেকশন অ্যান্ড অ্যাভয়ডেন্স ক্যামেরা (এলএইচডিএসি) - এআই এর এলগোরিদম ব্যবহার করছে।
রোভার প্রজ্ঞানের পথ চলাচলের নেভিগেশন ক্যামেরা RX/TX, পেলোড বা পরীক্ষণ য়ন্ত্র APXS, LIBS এআই দ্বারা চালিত।
চন্দ্রযান-৩-এ পেলোড বা পরীক্ষণ যন্ত্র
আমরা জানি চন্দ্রযান-৩ এ তিনটে মূল উপাদান। প্রপালশন মডিউল, ল্যান্ডার মডিউল এবং রোভার মডিউল। চন্দ্রযান-২ এর মতো এবার অরবাইটার নেই।
প্রপালশন মডিউলের কাজ ছিল ল্যান্ডার- রোভার মডিউলকে চন্দ্রকক্ষের ১০০ বাই ১০০ কিমি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া আর তারপরেই প্রপালশন এবং ল্যান্ডার - রোভার মডিউলের বিচ্ছেদ।
ল্যান্ডারের পেলোড
চন্দ্রায়নস সারফেস থার্মোফিজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট (ChaSTE)-এর মাধ্যমে চন্দ্রপৃষ্টের তাপ পরিববাহিতার পরিমাপ করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই এই পেলোড চমৎকার ডেটা সংগ্রহ করেছে যাতে দেখা যাচ্ছে চাঁদের মাটির ওপর তাপমাত্রা যেখানে ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, সেখানে চন্দ্রপৃষ্ঠের নিচের তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
‘ইস্ট্রুমেন্ট ফর লুনার সিসমিক অ্যাকটিভিটি’ (ILSA)-এর মাধ্যমে চন্দ্রকম্পনের ধরন ধারণ পরিমাপ করা হবে।
ল্যাঙ্গমুয়ির প্রোব ( এলবি) -এর মাধ্যমে চন্দ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি ‘প্লাজমা ডেনসিটি’ বা আয়ন ঘনত্বের পরিমাপ করা হচ্ছে।
রোভারের পেলোড
আলফা পার্টিকেল এক্সরে স্পেক্টোমিটার (APXS)-এর মাধ্যমে ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, পটাসিয়াম, টাইটেনিয়াম, সিলিকন, আয়রনের উপস্থিতির খোঁজ করা। ইতিমধ্যেই সালফার, টাইটেনিয়াম সহ উপরোক্ত সবকটি মৌলের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। অক্সিজেনের উপস্থিতিও নিশ্চিত হয়েছে - হাইড্রোজেনের খোঁজ চলছে।
লেসার ইনডিউসড ব্রেকডাউন স্পেক্ট্রোস্কোপ-এর মাধ্যমে পরিমাণ এবং গুণগত রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চন্দ্রপৃষ্ঠের রাসায়নিক এবং খনিজ গঠন নির্ণয় করা।
রাজনীতি বনাম চন্দ্রযান-৩
‘‘ভারত, আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেছি, তুমিও’’ - চাঁদ ছুয়ে এমনই জানালো বিক্রম। এর আগে বিক্রম কথা বলেছে ২০১৯ এর চন্দ্রায়ন ২-এর অরবাইটারের সাথে - কী বিস্ময়কর! কী ধরনের উৎকর্ষমণ্ডিত মহাকাশ বিজ্ঞানের নিখুঁত প্রয়োগ ভাবা যায়! প্রথম দেশ হিসেবে ভারতের পতাকা অশোকস্তম্ভের জলছবি আজ চন্দ্রপৃষ্ঠে!
কিন্তু একি কথা! বিক্রমের চাঁদে পা দেওয়ার মুহূর্তেই টেলিভিশন পর্দা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল! একভাগে চাঁদে পা রাখা বিক্রম, আর একভাগে প্রধানমন্ত্রী। যে মুহূর্তে বিক্রমের ছবি দুটো টিভির পর্দা জুড়ে দেখালেও আশ মেটেনা সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি গুণ না হয়ে ভাগ হয়ে গেল আর গৌরবের পিঠে ভাগের সবটাই নিয়ে নিলেন প্রধানমন্ত্রী।
শুরু হয়ে গেল উগ্রদেশপ্রেমী রাজনীতির কারবারিদের গৌরবের হাতসাফাইয়ের কাজ। অসংখ্য ফেক ভিডিয়োয় ভরে গেলো সোশ্যাল মিডিয়া।
৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত তথা সারা বিশ্বের সেরা হাজারো বিজ্ঞানীর মেধা-শ্রম দেশপ্রেমের চরম উৎকর্ষতার ফল এই সাফল্য।
এর সাথে না আছে রাজনীতির সম্পর্ক, না আছে যাগযজ্ঞের সম্পর্ক, না আছে তিরুপতিতে পুজো দেওয়ার সম্পর্ক - দেশের নীতির সম্পর্ক আছে ঠিকই। তাই ইসরো আর তার বিজ্ঞানীদের সাথে এ সাফল্য প্রতিটি ভারতবাসীর। এটুকুই সার কথা। এই সাফল্যকে মহাকাশ গবেষণার উত্তুঙ্গ শিখরে নিয়ে যেতে হবে - কে নিয়ে যাবেন? যাবেন সেই ইসরোর বিজ্ঞানীরা। কাদের দেশ মাথায় করে রাখবে? ইসরো আর তার বিজ্ঞানীদের, সেইসাথে সরকারের চাওয়াটুকু।
ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞান আর তার বিজ্ঞানীকুল ঐতিহ্যবাহী, তারা অতীত থেকেই সারা বিশ্বের সমীহ আদায় করে আসছে। সেই ঐতিহ্যের ধারাতেই আজকের সাফল্য। এই বিরাট সাফল্য আজ হঠাৎ করে আসেনি। প্রথম মহাকাশযান আর্যভট্ট থেকে শুরু হওয়া সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আজকের সাফল্য। আমরা কি বিক্রম সারাভাই,সতীশ ধাওয়ান, মাধবন নায়ার, এইচ জি এস মূর্তি, রামকৃষ্ণ রাও,এপিজে আব্দুল কালামের অবদান বিস্মৃত হতে পারি? না পারি না।
আর্যভট্টের পরে ভাস্কর ১,২ ইনস্যাট সিরিজ, এএসএলভি, জিএসএলভি-নিজস্ব প্রযুক্তির হেভি লঞ্চ ভেহিকেল, ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন সাফল্যের কথা বাদ দিতে পারি!
আমরা কি বিস্মৃত হতে পারি ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানের সাফল্য কীভাবে দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছেছে, তার কথা? ইনস্যাট - যা টেলিযোগাযোগ, টেলিভিশন, আবহাওয়ার গতিবিধি-ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষেত্রে যে বিপ্লব এনেছে তার কথা? কৃষক, মৎস্যজীবী থেকে প্রতিটি মানুষ আজ কি ভীষণ উপকৃত তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
আমাদের রিমোট সেনসিং স্যাটেলাইট ডাটা কীভাবে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের হিসেব দিচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সাহায্য করছে, ভুলে যেতে পারি। জিপিএস সিস্টেম ছাড়া আজ চলবে?
এসব একদিনে হঠাৎ ক’রে গড়ে ওঠেনি। তিল তিল করে নির্মিত হয়েছে ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞান, তাকে উৎকর্ষের শিখরে নিয়ে গেছেন প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানীরা। আমরা কি এমনকী চন্দ্রযান ১, ২-কেও বিস্মৃত হতে পারি? এ যেন কখনও আমরা বিস্মৃত না হই, তা হবে আত্মঘাতী পথ।
এর সাথে উৎক্ষেপণের আগে ইসরোর বিজ্ঞানীদের মন্দিরে পুজো দেওয়া, নারকেল ফাটানো - এসব রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কী? মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাজ যেমন মহাকাশ গবেষণা, সফল উৎক্ষেপণ, তেমনি মহাকাশ বা সার্বিকভাবে মানুষের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার দূর করা, উৎক্ষেপণের আগে এসব করলে একে তো সরকারি কর্মসূচিতে এসব করা দেশের সংবিধান অনুমোদন করেনা। দ্বিতীয়তঃ কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস প্রশ্রয় পায়। উৎক্ষেপণের সাফল্যে বিজ্ঞানের পরিসরের মধ্যে অন্যদের অনুপ্রবেশ ঘটে। এ চলতে পারে না, এখনই বন্ধ হোক।
সভ্যতার চালিকা শক্তি হলো বিজ্ঞান প্রযুক্তি, অন্য কিছু নয়। বিজ্ঞান প্রযুক্তির একেকটা সাফল্য দেশ আর দেশের মানুষকে কয়েক কদম এগিয়ে দেয়। এগিয়ে দেয় চিন্তা চেতনাকে। কুসংস্কার, অজ্ঞতা, পশ্চাৎপদতা একটু একটু করে কাটে। কিন্তু বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রয়োগের কথা, ফল বিতরণের কথা যখন আসে তখন রাজনীতি জবরদখল করে নেয় গোটা ক্ষেত্রটাই। তাই একদিকে সফল চন্দ্রযান-৩ হয়, অন্যদিকে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারত বিশ্বের মধ্যে শেষের সারিতে দাঁড়ায়।
এ অবস্থা পালটাবে, বিজ্ঞানের শৃঙ্খলিত প্রয়োগ ও ফল বিতরণ পদ্ধতি একদিন মুক্ত হবেই।
ততদিন বিজ্ঞান প্রযুক্তিকেই আকড়ে থাকব, বিজ্ঞান প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানমনস্কতার জয়গান গাইব।
পুরাণকথা-কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাস বনাম চন্দ্রযান-৩
‘‘এক যে ছিল চাঁদের দেশে চরকা কাটা বুড়ি,
পুরাণে তার বয়স লেখে লক্ষ হাজার কুড়ি।
সারাদিন জাল বোনে সে বুনন হয়না সারা,
পণ ছিল তার ধরবে জালে লক্ষ কোটি তারা।’’
শিশুকালে বাবার বলা এই ছড়া আজও মুখস্ত। আজ বাবা নেই, বাবা থাকলে বলতাম, ‘‘কোথায় সেই বুড়ি? বিক্রম-প্রজ্ঞান তো বুড়িকে খুঁজে পেলো না! ছবিও দিল না!’’
পুরাণ হলো racial dream. মানুষের অবদমিত কামনার স্বপ্নকল্প। অজ্ঞানতাজনিত অসামর্থ্য - যে মানুষকে প্রকৃতি আর সমাজের বহু কিছুকে আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসতে পারেনি, সেসব কিছু নিয়েই সে মানসপটে রচনা করেছে স্বপ্নকল্প - রচনা করেছে পুরাণ। পুরাণেই সে নির্মাণ করেছে অতিমানব রাজা, অবতার, লৌকিক ক্ষমতাকে অতিক্রম করে অলৌকিক ক্ষমতা - দেব মাহাত্ম্য। নিজের ছোট্ট সামর্থ্যকে অতিক্রম করেছে সে স্বপ্নে, কল্পনায়, পক্ষীরাজে, পুষ্পক রথে চেপে উড়েছে আকাশে, দৃষ্টির সীমাকে কল্পনায় অতিক্রম করেছে দিব্যদৃষ্টিতে। ঘুমন্ত মানুষ স্বপ্নে স্থল জল অন্তরীক্ষে ভ্রমণ করতে সক্ষম - সেখান থেকে বিশ্বাস করেছে আত্মায় - যেন দেহের মধ্যেই আলাদা এক সত্তা - যেখানে ইচ্ছে সেখানে গমন করতে পারে।
মানুষের অজ্ঞানতাজনিত অসামর্থ্যতার গ্লানি - পুরাণের স্বপ্নকল্পে নিজেকে বিজয়ী করে তৃপ্ত হয়। আবার সেই মানুষই যখন অজ্ঞানতার পরিধি কমিয়ে আনে, বাড়িয়ে তোলে সামর্থ্যের ভাণ্ডার, আয়ত্তের ভাণ্ডার - সেই মানুষই তখন পুরাণকে অতিক্রম ক'রে স্বীয় সামর্থ্যের বিজয়ধ্বজা আকাশে উড্ডীন ক’রে - নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে।
মহাকাশ নিয়ে মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পুরাণ, অলৌকিক দেবলোকের জন্ম দিয়েছে। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘‘এ বিশ্ব দুটি গোলকে ভাগ হয়ে আছে, নিচের গোলক মনুষ্যলোক, ওপরের গোলক দেবলোক - সেটা অপরিবর্তনীয়, যেমন আছে তেমনই থাকবে, কোনও পরিবর্তন হবে না।এ বিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবী, আর পৃথিবীর কেন্দ্রে ঈশ্বরের বাণীবাহক রাজা।’’
দু’হাজার বছর ধরে এই বীশ্ববিক্ষাতেই চলেছিল রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই চিন্তা কাঠামোকেই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন নিকোলাস কোপার্নিকাস, গ্যালিলেও গ্যালিলি।
যতবার মহাকাশে মানুষের জ্ঞানের অন্বেষণে সফলতা, ততবার অজ্ঞানতার ধোঁয়াশা কেটে যাওয়া, মানসপটের স্বপ্নকল্প মুছে যাওয়া, কল্পিত ক্ষমতার গর্বকে সরিয়ে প্রকৃত ক্ষমতার গর্বধ্বজাকে উড্ডীন করা। জমাট কুসংস্কার, বিচারবিযুক্তবাদ, পশ্চাৎপদতার পরিবর্তে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্কতার সংস্কৃতি নির্মাণের চেতনায় আবেশিত হওয়া।
বিক্রমের অবতরণ স্থলের নাম শিবশক্তি!
ইসরো এমন ঘোষণাই করেছে। শিবশক্তি কোথা থেকে এলো? চন্দ্রযানের সাফল্য ভারতের ঐতিহ্যবাহী মহাকাশ গবেষণাজাত উচ্চ প্রযুক্তির নিঁখুত প্রায়োগিক প্রদর্শন। চন্দ্রদেবলোকে মানুষের বিজয় পতাকার উত্তোলন - কল্পিত দেবলোকের ইমারত চুরমার। কল্পিত পুরাণকথা-কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত। শক্তির প্রদর্শন যদি হয়ে থাকে তাতো বিজ্ঞানীদের প্রজ্ঞাশক্তি, ধীশক্তি, প্রযুক্তিবিদদের মেধা ও শ্রমশক্তি। এর মধ্যে কাল্পনিক ঐশ্বরীয় শক্তি - যে বিশ্বাস চূর্ণ করলো চন্দ্রযান-৩ নিজে, সেই শক্তির আবাহন কেন? আর তা ইসরো করবে?
উৎক্ষেপণের আগে তিরুপতিতে পূজা আর সফল অবতরণের পরে শিবশক্তির আবাহন - মাঝের শিহরণ জাগানো সবটুকু সাফল্য বিজ্ঞান প্রযুক্তির-ইসরোরই বিজ্ঞানীদের। সেই সাফল্যের জয়মাল্য ঈশ্বরের গলায় পরিয়ে দিলো ইসরো। চরম দুঃখের, চরম হতাশার। যে অন্ধবিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করলো ইসরো তাকেই আবার পুনর্জীবন দান করলো! এ অপরাধ! অসহনীয়!
ইসরোর চেয়ারম্যান ডঃ এস সোমনাথের বিজ্ঞানী হিসেবে দক্ষতা অসামান্য, সারা দেশ তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কিন্তু কী বললেন তিনি - ‘‘বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতায় কোনও বিরোধ নেই।’’ ঠিক যখন সারা দেশ বিজ্ঞানের জয়গান গাইছে, ঠিক উলটো কথাটাই বললেন সোমনাথ। অধ্যাত্মবাদ হলো আত্মাতে বিশ্বাস এবং তা নিয়ে এক বিশ্বাসতন্ত্র। বিজ্ঞানে এর কোনও স্থান আছে? বিজ্ঞানী হিসেবে সোমনাথ এসব প্রমাণ করতে পারবেন? উৎক্ষপণের ঠিক আগে তিনি চলে গেলেন তিরুপতির মন্দিরে পুজো দিতে! দেশের সংবিধান অনুমোদন করে?
বিজ্ঞানীদের কাজ শুধুই হার্ড সায়েন্সের গবেষণা? দেশের মানুষের বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ার কাজ তাদের নয়? দেশের উজ্জ্বল বিজ্ঞানীদের সমাহারে গঠিত দেশের সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিষ্ঠান ইসরোর দায় নয় দেশের মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা প্রতিষ্ঠা করা? তীব্র হতাশাজনক!
কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই সুকঠিন, রাতারাতি কোনো ঘটনায় সে লড়াই এ জন্যই জেতা যায় না। বিজ্ঞান থেকে ধর্মকে, প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারকে বের করে আনার যে পথ কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, ডারউইন দেখিয়েছিলেন সে পথ আজও বন্ধুর, কায়েমি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া এ লড়াই জেতা যাবে না। কুসংস্কার - অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই আদতে ব্যবস্থা বদলেরই লড়াই। এ লড়াই জিততে হবে।