E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০

কেন্দ্রীয় সরকারের সংবিধান বিরোধী ও গণতন্ত্র হরণকারী নীতির প্রতিবাদ করুন

স্বরূপ পাল


বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এই বছরে প্রায় ৪৩টি বিল লোকসভায় পেশ করেছে। তার মধ্যে কিছু কিছু বিল আছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল হলো “The Forest (Conservation) Amend-ment Bill 2023”। এই বিলটি জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটিতে পাশ করানো হয়, যেখানে কেন্দ্রীয় শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এই বিলটি নিয়মানুযায়ী পার্লামেন্ট স্ট্যান্ডিং কমিটিতে না পাঠিয়ে বিলটি পাশ করা হয়। ১৯৮০ সালে অরণ্য সংরক্ষণ যে আইন ছিল এই বিল দ্বারা তা সংশোধন করা হলো। অরণ্যের বাইরে বৃক্ষচ্ছেদন বাদ দিলে বর্তমানে দেশের বনভূমির পরিমাণ ২৩ শতাংশ। সরকারি হিসাব বলছে, ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রায় ৪৩ লক্ষ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইন এই ব্যাপক অরণ্য ধবংসের পরিমাণ হ্রাস করতে সক্ষম হয়। কিন্তু নতুন আইনের মাধ্যমে দেশের বেশ কয়েকটি বনাঞ্চলকে সংরক্ষণের বাইরে রাখা হয়েছে। এই বিলের দ্বারা দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে দেশের ভিতর ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত অরণ্যভূমি সংরক্ষণের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে পড়বে সম্পূর্ণ উত্তর-পূর্ব ভারত, হিমালয়ের বিভিন্ন অংশের বনাঞ্চল এবং সুন্দরবন। এই আইনের দ্বারা সরকার যখন চাইবে তখনই বিভিন্নভাবে এই অংশ ব্যবহার করতে পারবে। একইভাবে নিরাপত্তার নামে দেশের যে কোনো প্রান্তে ৫ থেকে ১০ হেক্টর পর্যন্ত বনভূমি অধিগ্রহণ করে অরণ্য ধ্বংস করার ক্ষমতা সরকার এই সংশোধনীতে যুক্ত করেছে। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে অত্যন্ত চালাকি করে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট টিএন গোদাবর্মন বনাম ভারত সরকার মামলায় অরণ্যের যে সংজ্ঞা নিরূপণ করেছিল তা পরিবর্তন করলো। উক্ত আদেশ অনুযায়ী সরকারি অরণ্যভূমির বাইরে যে সমস্ত অঞ্চলে বেসরকারি মালিকানায় অরণ্য রয়েছে, সেগুলিও অরণ্য পরিচালন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার আওতাধীন ছিল। বর্তমান আইনে কেবল সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী যে বনভূমি আছে তাকেই অরণ্য হিসাবে গণ্য করা হবে। ২০১৮ সালের পর করপোরেটের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে বারবার পরিবেশ ও অরণ্য রক্ষা সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তন কেবল দেশের পরিবেশ নয়, আদিবাসী ও অনান্য বনবাসীদের জীবন ও জীবিকার জন্যও এই আইন খুবই ক্ষতিকর। আজকে যখন সারা বিশ্বে ‘গাছ বাঁচাও গাছ লাগাও’-র ডাক দেওয়া হচ্ছে, এই বিল শুধুমাত্র তার বিপরীত নয়, এই বিল পাশ হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এই বিল শুধুমাত্র লুটেরা পুঁজির শ্রীবৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।

আর একটি গণতন্ত্র ধ্বংসকারী বিল যে কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োগ করতে চাইছে তা হলো ‘‘The Government of National Capital Territory of Delhi (Amendment) Bill, 2023”। এই বিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার মানুষের দ্বারা নির্বাচিত দিল্লির সরকারের প্রায় সমস্ত ক্ষমতাকে কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। এই বিল আমাদের সংবিধান বিরোধী এবং এতে গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছে এই বিলের মাধ্যমে। সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধাচারণ করা সত্ত্বেও সংখ্যার বলে বলীয়ান হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এই বিলটিকে আইনে রূপান্তরিত করতে চাইছে। অল্প কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার যে তিনটি বিল পেশ করেছে যা আমাদের ফৌজদারি আইনকে আমূল পরিবর্তন করার এক অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ। এই বিল তিনটি হলো ‘The Bharatiya Nyaya Sanhita Bill, 2023’, ‘The Bharatiya Nagarik Suraksha Sanhita Bill 2023’ এবং ‘The Bharatiya Sakshya Bill 2023’। মনুসংহিতাকে নির্ভর করে এই আইন তিনটি তৈরি হয়েছে, যা শুধুমাত্র আমাদের Criminal Law-র খোলনলচে বদলে দেবার চেষ্টা নয়, এর মাধ্যমে আমাদের সংবিধানের সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক ভাবনাকেও বদলে দেবে। এই বিলের দ্বারা বিচারব্যবস্থা বিলম্বিত হবে। এই বিল আনার সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য - বিরুদ্ধ কণ্ঠ রোধ করা এবং দমন পীড়ন নীতিকে প্রতিষ্ঠা করা। এর দ্বারা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। পুলিশি হেপাজতে মেয়াদ বৃদ্ধি, বিচার ব্যবস্থা বিলম্বিত করা এর অন্যতম উদ্দ্যশ্য। আমরা দেখছি এই সরকার ইউএপিএ-র মতো কালা আইনকে কীভাবে অপপ্রয়োগ করে চলেছে। এই নতুন দানবীয় আইন সরকারের হাতে অধিক অস্ত্র তুলে দেবে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য। আমরা এর আগেও দেখেছি যে, বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা সরকার নিয়েছে। বিচারপতি নিয়োগে যে কলেজিয়াম পদ্ধতি তা তুলে দিয়ে ক্ষমতা সরকার নিজের হাতে নিতে চেয়েছে। ২০২২ সালে সরকার “National Judicial Commission Bill” এনেছিল। যার উদ্দেশ্য বিচারব্যবস্থাকে সরকারের অঙ্গুলিহেলনে চালানো। আরেকটি গণতন্ত্র ধ্বংসকারী ও সংবিধান বিরোধী বিল, যা কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে এনেছে তা হলো - “The Chief Elections Commission and Other Election Commissions (Appointment, Conditions of Service and Terms of Office) Bill”। এই বিলটি সংসদে আনা মানে সুপ্রিম কোর্টের অর্ডারকে চ্যালেঞ্জ করা। সুপ্রিম কোর্টের সংবিধানিক বেঞ্চ আমাদের সংবিধানের ৩২৪ নং ধারাকে ব্যাখা করে বলেছিলেন যে, নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ হতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী একটি অ্যাডভাইসরি কমিটি হবে, যাতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। এরা নাম সুপারিশ করবেন এবং তার ভিত্তিতে নিয়োগ করবেন আমাদের রাষ্ট্রপতি। নতুন বিল অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এই কমিটিতে থাকবেন না, নতুন বিল অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং একজন ক্যাবিনেট মিনিস্টার এই কমিটিতে থাকবেন, অর্থাৎ সম্পূৰ্ণ ক্ষমতা executive-র হাতে থাকবে এবং এতে অবশ্যম্ভাবী রাজনৈতিকীকরণ হবে।

আমরা দেখছি একইভাবে এই সরকার বিরোধীদের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে সংখ্যার জোরে শ্রম আইনকে করপোরেটের স্বার্থে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছিল, শ্রমিকদের করুণ অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে বর্তমানের শ্রম আইন, এখানেও Executive-র হাতে অধিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বিচার ব্যবস্থার থেকে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর একটি অগণতান্ত্রিক ও সংবিধান বিরোধী পদক্ষেপের উদাহরণ হলো ইউফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগের চেষ্টা। এর মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর আঘাত আনতে চাইছে। হিন্দুত্ববাদী চিন্তাভাবনা থেকে এই উদ্দেশ্য, যার পিছনে আছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ। এর মধ্য দিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আঘাত আনতে চাইছে। আমরা জানি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কিছু রীতি, নীতি আছে, যা বহু বছর ধরে রয়েছে। তাকে চট করে বাতিল করে দেওয়া যায় না। ২১ তম ‘ল কমিশন’ অনেক আগেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির চিন্তাকে অবাস্তব বলে দিয়েছে।

আমাদের সর্বস্তরে এই অগণতান্ত্রিক, সংবিধান বিরোধী বিলগুলির বিরোধিতা করতে হবে। লোকসভা-রাজ্যসভাতে তো বটেই, এছাড়াও সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথেও এর বিরোধিতায় শামিল হতে হবে।