E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ২ এপ্রিল, ২০২১ / ১৯ চৈত্র, ১৪২৭

নন্দীগ্রাম ফিরে যাওয়া, ফিরে দেখা

ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (ডক্টরস ফর ডেমোক্রেসি)


এই ভোটের আবহে নন্দীগ্রামে আবার গিয়ে পৌঁছালাম। এক সময়ে অবরুদ্ধ নন্দীগ্রামে একজন চিকিৎসককে স্থানীয় মানুষেরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে অত্যন্ত নির্মমভাবে রুল দিয়ে পিটিয়েছিল। এই ব্যাপারে যারা দায়ী ছিলেন তাদের মধ্যে একটি এনজিও ছিল যা ‘‘মহাশ্বেতা দেবীর’’ এনজিও নামে পরিচিত। এই এনজিও-টি মহাশ্বেতা দেবী কতৃর্ক পরিচালিত হতো। সেখানে কাজের থেকে অকাজই বেশি হতো। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেটে এই এনজিও’র লোকজন মহাশ্বেতা দেবীর ব্যাচ দেখিয়ে জোর করে প্রবেশ করতেন, আর কিছু হলেই তারা নার্স দিদিমণিদের ভয় দেখাতেন। সকালবেলা থেকেই প্রসবযন্ত্রণায় কাতর এক মহিলা এবং তাদের বাড়ির লোক উভয়কেই সেই ডাক্তারবাবু বারংবার বলছিলেন মেদিনীপুর নিয়ে যেতে, কিন্তু তারা যথারীতি কর্ণপাত করেননি। রাত ৮টার সময় ওই প্রসূতি মহিলার মা প্রবল চিৎকার করতে আরম্ভ করেন এবং তখন রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার, কিন্তু অবরুদ্ধ নন্দীগ্রামের কিছু মানুষ এসে সেই ডাক্তারবাবুকে রুল দিয়ে প্রচণ্ড মারেন। সেখানকার কর্মরত নার্স তাঁকে বহু কষ্ট করে উদ্ধার করেন। পরে অ্যাম্বুলেন্স চালককে খুঁজে আনা হলো এবং সেই মুমূর্ষু রোগীটিকে মেদিনীপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তিনি ভালোভাবেই সন্তান প্রসব করেন, কেউ মারা যাননি। বামফ্রন্টের আমলেই নন্দীগ্রাম অবরুদ্ধ ছিল, কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ করার কোনো উপায় ছিলো না। আমরা চণ্ডীপুর থেকে চারিদিকে ধানের খেতের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে উঠলাম বাজার, তারপর নন্দীগ্রাম থানা। এই থানার পাশেই অবস্থিত সেই হাসপাতালে গিয়েছিলাম এবং চিকিৎসকের সাথে কথাবার্তা বলেছিলাম। পথেই যেতে যেতে দেখেছিলাম যে সুকুমার সেনগুপ্ত ভবন, সিপিআই(এম)’র ভবন, অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি বন্ধ। কোনো সিপিআই(এম)’র সমর্থক তথা সাধারণ মানুষ কেউই সেখানে বাজার করতে পারত না, দোকান দিতে পারত না, ধোপা, নাপিত, সব বন্ধ করে দিয়েছিল। তার কারণ কিন্তু আজ সবার সামনে পরিষ্কার. কিছুদিন আগেই সেখানে শঙ্কর সামন্তকে খড়ের গাদার মধ্যে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এবং সাধুচরণ চট্টোপাধ্যায় বলে একজন সাব ইন্সপেক্টরকে পেটে ছুরি মেরে তেখালির জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এইরকম সন্ত্রাসের মধ্যে আমি, ডাঃ কৌশিক রক্ষিত, ডাঃ গোপাল দাস এবং প্রফেসর রমেন কুণ্ডু সেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, দেখা করেছিলাম এবং আমাদের সমবেদনা জানিয়ে এসেছিলাম। তারপর কেটে গেছে অনেক বছর।

আবারও বেরিয়ে পরলাম নন্দীগ্রামের উদ্দেশ্যে, দিনটি হলো ২৪ মার্চ, ২০২১। এখন ধানকাটার মরশুম সমাপ্ত হয়ে গেছে, এবার নতুন করে ধান হচ্ছে, সবুজের মাঠ চারিদিকে। রাস্তা ঘাটে, বাজারে বহু মানুষের আনাগোনা, চারিদিকেই একটা সাজো সাজো রব। একদিকে রয়েছে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর পতাকা ও ছবি এবং আরেকদিকে ‘নিজের ঘরের মেয়ে’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। একটা দু’টো লাল পতাকা দেখা যাচ্ছে, এরকম করে ২০ কিলোমিটার যাওয়ার পর পৌঁছালাম সেই নন্দীগ্রাম পার্টি অফিস। পথে আবার নাকা চেকিং হচ্ছে অনেক জায়গায়। নন্দীগ্রাম পার্টি অফিসে গিয়ে আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০০০ লাল পতাকা জমা দিলাম এবং ক্ষণিকের মধ্যেই বেড়িয়ে পড়লাম প্রার্থীর খোঁজে। প্রার্থী তখন রোড শো নিয়ে ব্যস্ত। ছোটো ছোটো গ্রামের মধ্যে দিয়ে এই রোড শো এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এই রোড শোতে অংশগ্রহণ করছিলেন অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র, অভিনেতা বাদশা মৈত্র, রবীন দেব প্রমুখ। কোনো কটূক্তি সেখান থেকে বর্ষিত হচ্ছিল না, বরং বলা হচ্ছিল যে ‘‘আপনার ছেলের জন্য, আপনার ছেলে যাতে গ্রামে থাকতে পারে তার জন্য, আপনার ছেলের চাকরির জন্য, আপনার বিধবা ভাতা যাতে আপনার হাতেই আসে সেই জন্য আমাদেরই ঘরের মেয়ে মীনাক্ষী মুখার্জিকে ভোট দিন।’’ অত্যন্ত সুষ্ঠু এবং সুশৃঙ্খলভাবে বলা হচ্ছিল যে, গত ১০ বছরে যেভাবে আপনাদের ভোটদান থেকে বিরত থাকতে হয়েছে, সেই ভোট আপনারা দিন; তৃণমূলকেও আপনারা দিতে পারেন, কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু অবশ্যই নিজের ভোট নিজে দিন। এই বলতে বলতে ছোটো ছোটো জনপথের মধ্যে দিয়ে আমাদের সেই মিছিল এগিয়ে চললো। পথে মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা মীনাক্ষী মুখার্জির প্রতি বর্ষিত হলো। এর মানে এই নয় যে, মীনাক্ষী মুখার্জির প্রতি তারা সকলে সমবেতভাবে ভোট দেবেন, কিন্তু একটা প্রবল উচ্ছ্বাস আমাদের চোখে পড়লো। আমাদের দেওয়া লাল গেঞ্জি তার মধ্যে কাস্তে হাতুড়ি তারার ছাপ পরিহিত ২৫জন ছাত্রছাত্রী এই মিছিলে যোগদান করেছিলেন। এই মিছিল থেকে আমরা অনেক শিখলাম, সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলা গেল। অনেকেই অনেক ধরনের মতবাদ মনের মধ্যে রেখেছেন। প্রত্যেকে একেবারেই খুশি নন, যেভাবে ১০টি বছর কেটেছে কেউ তাতে খুশি হননি, তা তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট একেবারে। প্রত্যেক বছর নবান্নের সময় এসেছে কিন্তু ফিরে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে এদের ঘরে নবান্নের সেই আনন্দ ও উচ্ছ্বাস সব কিছুই যেন কিরকম ফিকে। নবান্নের নতুন ধানের মেঠো গন্ধে মাতোয়ারা গ্রামটি যেন ধুঁকছে। বাঁচার রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছে। এলাকার সাধারণ মানুষেরা এবারও হাবেভাবে, কখনও প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন। একমাত্র কাজের প্রার্থী হচ্ছেন মীনাক্ষী মুখার্জি তাকেই ভোট দিন। মুখরিত করতে করতে নন্দীগ্রামের মধ্যে দিয়ে মিছিল চলল। তাই আরও একবার সেই নবান্নের কথা মনে করিয়ে দিল এই লাল পতাকার মিছিল। নতুন ধানের গন্ধ যেন মীনাক্ষী মুখার্জির মাধ্যমে সমস্ত নন্দীগ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। হেমন্তে যেমন কাটা হয় ধান, ধান কাটার আনন্দে মুখরিত হয় জনপথ। তেমনই জনতার মুখরিত সখ্যে মীনাক্ষী মুখার্জি এগিয়ে যাচ্ছে। কে জিতবে সেটা বড়ো কথা নয়, তখনও পর্যন্ত লাল পতাকা প্রায় ৩০০টি বুথে পৌঁছেছে। নন্দীগ্রাম আজ মুখরিত। ধীরে ধীরে আবার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন নন্দীগ্রামবাসী, যা বিলীন হয়ে গিয়েছিল। মীনাক্ষী যে পতাকা নন্দীগ্রামকে দিয়ে যাচ্ছে, গ্রামের মজদুর, পরিযায়ী শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষ তাকে সর্বদা উদীয়মান রাখবে নীল গগনে।

জয় হবে মানবতার। অসংখ্য প্রার্থী এবং সীমাহীন অর্থের ঝঙ্কারের মধ্যে, মিছিলের মুখে একমাত্র দৃঢ় প্রত্যয়ে দাড়িয়ে আছে মীনাক্ষী।