E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ২ এপ্রিল, ২০২১ / ১৯ চৈত্র, ১৪২৭

শিল্পবিরোধী অপবাদের বোঝা থেকে মুক্ত হতে চাইছে সিঙ্গুরবাসী

নির্বাচনী প্রচারে এই কথাই স্পষ্ট হচ্ছে

শংকর মুখার্জি


সিঙ্গুরে নির্বাচনী প্রচারে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য। রয়েছেন অভিনেতা বিমল চক্রবর্তী সহ অগণিত কর্মী সমর্থক।

সারা বিশ্বের কাছে শিল্পায়নবিরোধী ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছে সিঙ্গুর। মূলত তৃণমূলের কারণেই এই দুর্নাম বয়ে চলতে হচ্ছে সিঙ্গুরকে। কিন্তু এটাও সত্য, ২০০৮ সালে ৮৫ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া টাটা মোটর কোম্পানি গুজরাটের সানন্দে স্থানান্তরের পর যে দুটি বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে তাতে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ভুল বুঝে হোক, বিভ্রান্ত হয়ে হোক সিঙ্গুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তৃণমূলের পক্ষেই তাঁদের সমর্থন জানিয়েছিল। এর বিপরীতে টাটা মোটরস কোম্পানির নির্মীয়মান কারখানাকে কেন্দ্র করে অনুসারী শিল্প এবং নতুন নতুন ব্যবসাবণিজ্য গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা যদি বাস্তবায়িত হতো তা’হলে রাজ্যের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সিঙ্গুর মডেল হতে পারত। এখন সেসবই ইতিহাস। সিঙ্গুরে এই শিল্পায়নবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ, গত দু’বারের তৃণমূলের বিধায়ক ৮৯ বছরের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জার্সি বদলে এই বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র প্রার্থী। তৃণমূলের জার্সি বদল করে বিজেপি’র প্রার্থী হওয়া এবারে সারা রাজ্যেই একটা সাধারণ ছবি। কিন্তু সিঙ্গুরের ক্ষেত্রে যেটা উল্লেখযোগ্য তা’হলো, দলবদলু রবীন্দ্রনাথবাবু এখন বলছেন, সিঙ্গুরের আন্দোলন ভুল ছিল; তিনি সিঙ্গুরে শিল্পায়নের লক্ষ্যে আগামীদিনে কাজ করবেন। তৃণমূল কংগ্রেস এখানে প্রার্থী করেছে ধ্বংসাত্মক সেই আন্দোলনের আরেক মুখ, মুখ্যমন্ত্রীর রাইটহ্যান্ড বেচারাম মান্নাকে। গত দুটি বিধানসভা নির্বাচনে বেচারাম পাশের বিধানসভা কেন্দ্র হরিপালে দাঁড়িয়েছিলেন, বিধায়কও হয়েছিলেন। এবারে হরিপালে নিজের স্ত্রীকে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তবে তৃণমূলের শিল্পায়নবিরোধী অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

২০১১ সালে ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরও বামফ্রন্ট একদিনের জন্যও সিঙ্গুরে শিল্পায়নের দাবি থেকে সরে আসেনি। বামপন্থী ছাত্রযুবরা ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে গেছে শুধু সিঙ্গুরের জন্য নয়, সারা রাজ্যে শিল্পায়নের দাবিতে। এই শিল্পায়নের দাবি নিয়ে তারা সিঙ্গুর থেকে শালবনী পদযাত্রা করেছে। সংগঠিত করেছে একাধিকবার নবান্ন অভিযান, এমনকি এই আন্দোলনে শহিদ হতে হয়েছে তাদের কমরেডকেও। রাজ্যে সেই আন্দোলনের মুখ, এসএফআই’র রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য এবারে সিঙ্গুরে সংযুক্ত মোর্চা মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী। সৃজন ভট্টাচার্য প্রচারে বলছেনঃ “সিঙ্গুর নিয়ে অনেক খেলা হয়েছে, এবার চাকরি হবে। বিজেপি জিতলে ওই জমিতে ডিটেনশন ক্যাম্প হবে, তৃণমূল জিতলে সরষের খেত হবে, আর কারখানা হবে সংযুক্ত মোর্চা জিতলে।”

রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সুবিধাবাদী রাজনীতি আর বেচারামের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ সহ হাজার অভিযোগ। এই অনৈতিক সুবিধাবাদী রাজনীতিতে সিঙ্গুরের সাধারণ মানুষ শুধু নন, তৃণমূল এবং বিজেপি সমর্থকরাও আজ হতাশ। প্রার্থী নিয়ে বিজেপি’র কোন্দল রাস্তায় চলে এসেছে। বিক্ষুব্ধরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে, মিছিল পর্যন্ত করেছে। এখন শোনা যাচ্ছে, টাকা দিয়ে নাকি সেই বিক্ষোভকে চাপা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে দেওয়াল লেখা, ফ্ল্যাগফেস্টুনের বহুলতা দেখা গেলেও তৃণমূল কর্মীদের মধ্যেও প্রচারে কেমন একটা গাছাড়া ভাব। এখানে দীর্ঘদিন ধরে রবীন্দ্রনাথ এবং বেচারামের মধ্যে বিরোধ ছিল। রবীন্দ্রনাথ দলবদল করলেও সেই বিরোধের চোরাস্রোত এখনও রয়ে গেছে। যার ফল তৃণমূলকে ভোগ করতে হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে যেটা উল্লেখযোগ্য তাহলো, গত দশ-বারো বছরের সিঙ্গুরের ইতিহাস যাই বলুক না কেন, সংযুক্ত মোর্চার প্রচার বিশেষ করে রাজ্যের শিল্পায়ন প্রসঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা সিঙ্গুরের মানুষের কাছে যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি করেছে। এই বিধানসভা কেন্দ্রের সবজায়গাতেই ছাত্রযুবদের মধ্যে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীকে নিয়ে উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা চোখে পড়ছে। গত ৩০মার্চ সৃজন ভট্টাচার্যের সমর্থনে সিঙ্গুরে ছাত্রদের এক বিশাল মিছিল হয়। মিছিল বুড়োশান্তি রেল গেট, সিঙ্গুর থানা ও স্কুল মোড়, সাতমন্দিরতলা, দুর্লভপাড়া মোড়, বাঁকিপুর হয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পরিক্রমা করে মির্জাপুর বাজারে পৌঁছায়। প্রার্থী সহ এসএফআই’র নেতৃত্ব এই মিছিলে অংশ নেয়। শুধু মিছিলই দীর্ঘ হয়নি, এই দীর্ঘপথের দু’ধারে হাজার হাজার মানুষ এই মিছিলকে অভিবাদন জানান।

বিধানসভা কেন্দ্র পুরোটাই পঞ্চায়েত এলাকা। ১৬টা গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে এই কেন্দ্রে। সিঙ্গুরে ধান, আলু, পাটের সাথে ফলের চাষও ব্যাপক হয়। বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থা, সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণ সিঙ্গুরে কৃষিকাজের উন্নতিতে সাহায্য করেছিল। কৃষি, কৃষকের স্বার্থের কথা বলে শিল্প তাড়ালেও গত দশ বছরে কৃষিতে কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারেনি তৃণমূল সরকার। তার প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। একদিকে যেমন ফসলের লাভজনকদাম পাওয়ার সমস্যয় জর্জরিত আলুচাষি, ধানচাষি, ফলচাষিরা; অন্যদিকে কৃষি পরিকাঠামোর সংস্কার ও সম্প্রসারণের অভাবে তাদের ফসলের উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পাচ্ছে।

শিল্প তাড়ানোর অপকর্ম ঢাকতে, নিজেরা কতোটা কৃষকবন্ধু তা প্রমাণ করতে বহুমুখী হিমঘর, তাপসী মালিক কৃষক মান্ডির মতো কিছু পরিকাঠামো তৈরি করেছিল তৃণমূল সরকার। কিন্তু সেগুলির কোনো সুফল সিঙ্গুরের মানুষ কোনোদিনই পাননি। স্বজনপোষণ আর পরিকল্পনাহীন কাজকর্মে এগুলিতে কোটি কোটি টাকার সরকারি অর্থের শুধু অপচয় হয়েছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। বিশেষকরে ১০০ দিনের কাজে পুকুর চুরি হচ্ছে। কম দিন কাজ করে বেশিদিনের হিসাব দেখিয়ে নিজেদের লোকেদের টাকা কামানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে তৃণমূল নেতারা। তবে নিজেদের লোক হলে কী হবে, তাদের থেকে কমিশন নিতে ছাড়ছে না তৃণমূল নেতারা।এছাড়াও ট্রেড লাইসেন্স, বাড়িঘর তৈরির অনুমতির মতো কোনো কাজই পঞ্চায়েতে ঘুষ ছাড়া হয়না। বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েত মানুষের আশা ভরসার জায়গা ছিল; সেটা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। এসব নিয়ে মানুষের যে বিস্তর ক্ষোভবিক্ষোভ রয়েছে তা তৃণমূল প্রার্থীর একেবারেই অজানা নয়;এবং তা যে তার পক্ষে যাবেনা তা বেচারাম মান্না ভালোই বুঝতে পারছেন। তাই তার এখন প্রচার, তিনি সিঙ্গুরের ভূমিপুত্র। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সৃজন বহিরাগত। আসলে নির্বাচনে নিজের বিপর্যয় বুঝতে পেরে এসব অরাজনৈতিক বিষয়কে হাতিয়ার করতে চাইছে তৃণমূল প্রার্থী। তবে সিঙ্গুরের সাধারণ মানুষ এমনকি তৃণমূলী সমর্থকরাও যে এইসব ছেলেমানুষী প্রচারে একেবারেই সাড়া দিচ্ছেনা তা বেচারামের পথসভাগুলিতেই লক্ষ করা যাচ্ছে। একেই পথসভাগুলিতে সামান্য উপস্থিতি; তাদের কাছ থেকেও তৃণমূল প্রার্থী এইসব কথা বলে হাততালি পর্যন্ত পাচ্ছেন না।

গোপালনগর, বেড়াবেড়ি এবং কামারকুণ্ডু - এই তিনটি গ্রামপঞ্চায়েত এলাকায় টাটা মোটরস কোম্পানির জমি ছিল। এর মধ্যে গোপালনগর, বেড়াবেড়ি সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে, কামারকুণ্ডু হরিপাল বিধানসভায়। এখানকার সাধারণ মানুষ, এমনকি ‘অনিচ্ছুক চাষি’দেরও তৃণমূলের প্রচারে দেখা মিলছে না। মাসে কিছু চাল আর সামান্য সরকারি অনুদান তাদের জীবনের যে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে নি তাও এখন অনেক ওই তথাকথিত অনিচ্ছুক চাষি সংযুক্ত মোর্চার কর্মীদের কাছে প্রচারের সময় বলে ফেলছেন। তাদের অনেকে আবার নতুন শিল্পের পক্ষেও কথা বলছেন। যারা জমি ফিরে পেয়েছিলেন আদালতের নির্দেশে তারাও জমিতে চাষ করতে পারছেন না, জমি চাষের অনুপযুক্ত হওয়ার কারণে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন,ওই জমিকে চাষের উপযুক্ত করে দেবেন। সেকথাও তিনি রাখেননি। এখনও ভোটের কয়েকদিন বাকি, তবে একটা ছবি ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে। সিঙ্গুরের প্রায় সর্ব অংশের মানুষ যেন তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই নিজেদের ওপর চেপে থাকা শিল্পবিরোধী তকমা থেকে মুক্ত হতে চাইছেন।