৫৮ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ২ এপ্রিল, ২০২১ / ১৯ চৈত্র, ১৪২৭
সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীর সমর্থনে ভাঙড়ের উপচে পড়া ভিড় বুঝিয়ে দিল সন্ত্রাস ও ভোট লুটকে এবার তারা রুখে দেবেই
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আইএসএফ’র নৌশাদ সিদ্দিকীর প্রচার।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ মাঠের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আলপথ ধরে নয়, খেতের মাঝখান দিয়েই শর্টকাট করে রাস্তার দিকে ছুটে আসছিলেন ওরা। কারণ অপেক্ষার অবসান হলো এতক্ষণে। টোটো গাড়ি থেকে মাইকে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আইএসএফ’র নৌশাদ সিদ্দিকী আসার ঘোষণা শুনে জাগুলগাছি গ্রামের তিন রাস্তার মোড়ের দিকে দ্রুত পায়ে আসছিলেন ওরা। মহিলাদের অনেকেই আগে থালা ভর্তি গাঁদা ফুলের কুচো নিয়ে পৌঁছে গেছেন ওখানে। মোবাইল ফোন হাতে প্রার্থীর আসার মুহূর্ত আর কথাবার্তার ভিডিও করতে তৈরি যুবকরা। কারণ যারা আসতে পারলেন না তাঁদের জানাতে হবে তো সবিস্তার।
এই উচ্ছ্বাসের কারণ, দশক পেরিয়ে গেল কিন্তু এই অঞ্চলে ভোট চাইতে আসার পরিস্থিতি ছিল না। এখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার টুঁটি টিপে রেখেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের কুখ্যাত সব তাজা নেতা আর তার দলবলেরা। এখানে মানে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রে। কিন্তু প্রার্থীর আসতে দেরি হচ্ছে। ঘড়িতে তখন দুপুর দেড়টা প্রায়। প্রার্থীর এই গ্রামে পৌঁছানোর কথা ঘণ্টা দেড়েক আগেই। কিন্তু প্রার্থীকে প্রায় সবাই নিয়ে যেতে চান নিজের পাড়ায়। তাই মুহুর্মুহু বদলাচ্ছে প্রার্থীর ম্যাটাডোরের গতিপথ। তাই দেরি, তাই অপেক্ষা। উৎসবের মেজাজে অপেক্ষা। শুধু প্রার্থীর জন্য নয়, ভোটের দিন সংযুক্ত মোর্চাকে ভোট দিয়ে দিন বদলের, রাজ্যে পালা বদলের।
অপেক্ষা শুধু অপেক্ষা নয়, অপেক্ষা অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য, অপেক্ষা ‘জোট’টা ইস্পাত দৃঢ় হয়েছে কিনা। কারণ এই ভাঙড়ের দু’টি ব্লকের অধিকাংশ অঞ্চল সন্ত্রাস কবলিত। সঠিকভাবে বললে সন্ত্রাসের পাহাড়-প্রমাণ বাধা ঠেলে এগোচ্ছে সংযুক্ত মোর্চার জোট।
প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটার রয়েছে এখানে। শাসক তৃণমূল এখানে অন্ধকাররাজ কায়েম করেছিল। রাজ্যে শাসকদল যত ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তার সবক’টির নমুনা এখানে পাওয়া যায়।
তাই ২৭ মার্চ রাজ্যে প্রথম দফার নির্বাচন হবার পর যখন বেশ কিছু কেন্দ্রে ইভিএম-এর গন্ডগোলের খবর শুনে এ গ্রামের প্রবীণরা আশঙ্কিত হয়ে জোট প্রার্থীর মিছিলে আসা সিপিআই(এম) কর্মীকে জিজ্ঞেস করেন, ওরা কি কারচুপি করে ভোট ‘লে লেবে’? কারণ প্রশ্ন কর্তা ওই প্রবীণ জানেন তৃণমূলকে এবার ভোট লুট করার কোনো সুযোগ দেবেন না গ্রামের মানুষ। তাঁরা শান্তি চান। তাঁরা কাজ চান, মাথা উঁচু করে গ্রামে থাকতে চান। ভয়ে কুঁকড়ে নয়।
জাগুলগাছির মতো ভাঙড়ের মোড়ে মোড়ে প্রার্থী নওশাদ সিদ্দিকী অভিনন্দন আর ফুলের স্তূপে ঢাকা পড়ে যেতে যেতে বলেছেন সংযুক্ত মোর্চার সঙ্গে আইএসএফ জোটের কথা। তিনি বলছেন এই জোট হয়েছে সরকার প্রতিষ্ঠার পর বেকার যুবকদের চাকরির জন্য, রেগার ১০০ দিনের কাজে যে দুর্নীতি হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি রোখার জন্য, মানুষের হকের পাওনা যারা মারছে সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য, সব ধরনের গরিব মানুষের সুরক্ষার জন্য। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসছে দুই ফুলের দলের প্রার্থীদের দল বদলের মধ্য দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেবার অপচেষ্টার কথা। তিনি সোচ্চারে বলছেন লকডাউনের সময় কিভাবে রাজ্যজুড়ে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের রুটি-রুজির যন্ত্রণা আরও বাড়িয়েছে। কিভাবে আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ত্রাণ না দিয়ে তা চুরি করেছে এই তৃণমূল নেতারা। তাই এদের সরাতে হবে। সম্প্রীতির জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে সংযুক্ত মোর্চার সরকারকে।
ঘটকপুকুর বাজার থেকে প্রবল সন্ত্রাস-কবলিত গোবিন্দপুর-গাবতলা-নলপুকুর-চণ্ডীপুর পেরিয়ে আসার সময় সব জায়গাতেই সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীকে ঘিরে একই ছবি। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে ভাঙড়ের কোথাও মনোনয়ন জমা করতে পারেনি বিরোধীরা। তাই মানুষের এই স্বতঃস্ফুর্ত আবেগ, যা দেখে চাপে পড়ে গেছে শাসকদল। পিছু হটে এবার অন্য পথ নিয়েছে। টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সে চেষ্টাও ধরা পড়ে গেছে। অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল নেত্রী আনোয়ারা বিবি স্বর্ণজয়ন্তীর গ্রুপগুলির প্রায় ৭০০ মহিলাকে নিয়ে একটি ব্যাঙ্কে বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। অ্যাকাউন্টগুলির পাস বই সহ অন্যান্য কাগজপত্র তিনি রেখেছেন নিজের কাছে। ওই মহিলারা মাঝেমাঝেই তাদের মোবাইলে বার্তা পাচ্ছেন যে, অ্যাকাউন্টগুলিতে টাকা ঢুকছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। কে পাঠাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে টাকা তা জানতে ভাঙড় থানায় অভিযোগ করেছিলেন কয়েকজন। ওই মহিলাকে আটক করলেও তদন্তে গড়িমসি করছে থানা। এই ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।
ভাঙড়ে ভোটার প্রায় আড়াই লক্ষ। দু’টি ব্লকের অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। এখানে মূলত দুই ধরনের ধান চাষ হয়। একটু মোটা ধান যার বাজারচলতি নাম হাজার এক, তার ৬০ কেজির বস্তা ফড়েরা কিনছে বারোশো টাকা দরে। আর মিনি কিটের বস্তা পনেরশো টাকা দরে। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত ১৭৬০ টাকা দর পাওয়া যাচ্ছে না। ফসল ওঠার শুরুতে আরও কম দাম পান কৃষকরা। সেই দরেই তাঁরা ধান ছেড়ে দেন। ছেড়ে দিতে বাধ্য হন মূলত ছোটো কৃষকরা। কারণ সরকারি পরিকাঠামো নেই, হিমঘর নেই চাল সংরক্ষণের জন্য। সরকারের এই কৃষক মারা ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ভাঙড়। সংযুক্ত মোর্চার প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে হিমঘরের এবং কৃষি পরিকাঠামোর কথা।
আবার এখানে ট্যাঙ্ক ফিশারি নামে কৃষি জমিতে যে ভেড়ি তৈরি হচ্ছে তার জেরে বদলে যাচ্ছে জমির চরিত্র। কাজ হারাচ্ছেন খেতমজুর। তাই তারা বিকল্প চান। বিকল্প সরকার চান। এখানে ভেড়িগুলিতে সাদা মাছ অর্থাৎ রুই-কাতলা এসব চাষ হয়। আর মীন ব্যবসার সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন তাদের লাভ সামান্যই। অন্য কাজ না থাকায় তাদের কোনো মতে দিন গুজরান।
এর পাশাপাশি আছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। এখানে পাড়া পিছু প্রায় ৩০ জন করে যুবক দিল্লি, মুম্বাইতে কাজ করতে যান। তারা সেখানে স্বর্ণশিল্প এবং দর্জি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন। লকডাউনে তাঁরা বাড়ি ফেরার পর দেখেছেন দুই সরকারের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। বামপন্থীরা ওই সময় মানুষকে সাধ্যমতো ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। পাশে থেকেছেন। আর তৃণমূলীরা পুলিশ দিয়ে তা আটকানোর চেষ্টা করেছে। মানুষ তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তফাত বুঝেছেন, বুঝছেন। তাঁরা শুনেছেন সংযুক্ত মোর্চা সরকার গড়লে তৈরি হবে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আলাদা দপ্তর। ভুক্তভোগী এঁরা সবাই ঠিক করেছেন আর তৃণমূল-বিজেপি নয়। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবার সংযুক্ত মোর্চা। এবার ভাঙড় থেকে নৌশাদ সিদ্দিকীই যাবেন তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে বিধানসভায়।