E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ২ এপ্রিল, ২০২১ / ১৯ চৈত্র, ১৪২৭

তৃণমূল–বিজেপি’র অনৈতিক সুবিধাবাদী রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ বালির মানুষ তারুণ্যের মেজাজে মেতেছে

শংকর মুখার্জি


পথসভায় বলছেন বালি কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী দীপ্সিতা ধর।

সাবেক বালি পুরসভার পুরোটা নিয়ে বালি বিধানসভা। গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত পুরনো জনপদ, চটশিল্পেরও পুরোনো কেন্দ্র। নাগরিক আন্দোলনেরও সমৃদ্ধ ইতিহাসের অধিকারী। যার নেতৃত্বে ছিল বামপন্থীরা সহ গণতান্ত্রিক মানুষ। আগামী ১০ এপ্রিল এই কেন্দ্রে ভোট।

বাম ছাত্র আন্দোলনের পরিচিত মুখ ২৭ বছরের দীপ্সিতা ধর সংযুক্ত মোর্চা মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী। কখনও শিক্ষা-কাজের দাবিতে, কখনও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-বিরোধী আন্দোলনে জেএনইউ’র ক্যাম্পাস থেকে কলকাতার রাজপথে সামনের সারিতে থেকেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন দীপ্সিতা। অন্যদিকে বালির তৃণমূলের বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়া দলবদলু হয়ে এবারে বিজেপি’র প্রার্থী। তাঁর প্রার্থীপদ নিয়ে বিজেপি’র অন্দরে কম নাটক হয়নি। আরেক দলবদলু হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র রথীন চক্রবর্তী এই কেন্দ্রের প্রার্থীর দাবিদার ছিলেন। যাক শেষপর্যন্ত বৈশালীকে হতাশ করেনি বিজেপি। কিন্তু দলবদল নিয়ে সাধারণ ভোটারদের কাছে তাঁকে এত অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে যে, প্রার্থী হয়েও কার্যত তাঁকে হতাশই হতে হচ্ছে। তৃণমূল প্রার্থী করেছে তুলনামূলকভাবে রাজনীতিতে অনামী রানা চট্টোপাধ্যায়কে। গত দু’টি বিধানসভা নির্বাচনে এখানে তৃণমূল প্রার্থী জয়ী হয়েছিল। তবে তৃণমূল-বিজেপি’র এই অনৈতিক সুবিধাবাদী রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ বালির মানুষ। এর বিপরীতে সকলের জন্য শিক্ষা, সকলের জন্য কাজের দাবির আন্দোলনের মুখ আর প্রচারে ছাত্র-যুবদের জীবনযন্ত্রণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গান শোনানো দীপ্সিতার তারুণ্যের মেজাজে মেতেছে বালি। রাস্তার মোড় থেকে গলি, বস্তির সংকীর্ণ ঘর থেকে মধ্যবিত্তের উঠান আর শ্রমিক মহল্লায় সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীকে নিয়ে প্রচারে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা চোখ টানছে। যা দেখে সত্যিই মনে হবে, কোটি টাকা দিয়ে তৈরি কোনো বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন নয়, যেন এখানে মানুষ তার নিজের মেয়েকেই খুঁজে পেয়েছে।

যে পুরসভার কথা বলা হলো, তার আজ কোনো অস্তিত্ব নেই। তৃণমূল সরকারের কল্যাণে ১৩৮ বছরের পুরনো এই পুরসভাকে হাওড়া পুরনিগমের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুটি পুরসভাকে একীকরণ করার একটা সরকারি বিজ্ঞপ্তি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পুরনাগরিকদের অভিযোগ জানানোর সুযোগ, শুনানি, নিষ্পত্তি প্রভৃতি প্রক্রিয়াগুলি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনুসৃত হয়নি। বালির এক নাগরিক এর বিরুদ্ধে আদালতেও গেছেন। একটি শতাব্দী প্রাচীন পুরসভার অস্তিত্ব বিলোপের বিষয়টা পুরনাগরিকদের আবেগে আঘাত করেছে তো বটেই, পুরপরিষেবা পেতেও ব্যাপক হয়রানি পোয়াতে হচ্ছে তাঁদের। রাস্তাঘাট, নিকাশি, জঞ্জাল পরিষ্কারের হাল খুবই শোচনীয়। পুর সংক্রান্ত বিভিন্ন সরকারি কাজের জন্য নাগরিকদের হাওড়ায় ছুটতে হয়। যে পরিষেবাগুলি আগে ঘরের সামনে বালি পুরভবনেই মিলত। তার ওপর দীর্ঘদিন ভোট হয়নি, কোনো নির্বাচিত পুরবোর্ড নেই, প্রশাসক নিয়োগ করে চলছে। বোঝাই যাচ্ছে দলমত নির্বিশেষে বালির মানুষ সরকারের এই তুঘলকি সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। এই ভোটের আগে আবার শোনা যাচ্ছে, বালিকে তার পুরনো অবস্থায় নাকি ফিরিয়ে দিতে চাইছে সরকার। কয়েকটা সংবাদপত্রে এ সম্পর্কিত খবর বেরিয়েছে। এ দেখে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে ভাবলে ভুল হবে। আসলে মানুষের ক্রমাগত বিরোধিতায় পড়ে তারা এরকম ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।

এলাকায় প্রচারে বালি কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী দীপ্সিতা ধর।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তৃণমূলের যে আস্থা একেবারেই নেই তার প্রমাণে কোনো উদাহরণের দরকার পড়েনা। তবুও উপরের বিষয়টা এই কারণে উল্লেখ করা হলো যে, এরা মানুষের সামান্য মতামত দেওয়ার অধিকারকেও সহ্য করতে পারেনা। তা’হলে বোঝাই যাচ্ছে মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকারকে তৃণমূল কতটা সম্মান করবে। আর বালিতে বিগত নির্বাচনগুলিতে হয়েছেও তাই। একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষকে তাঁদের সংবিধান প্রদত্ত ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র বামপন্থীদের সমর্থনের অপরাধে শতশত মানুষকে হেনস্তা করা হয়েছে, দুর্ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁদের, চলেছে অকথ্য খিস্তিখেউড়। সিপিআই(এম)’র ওপরও সন্ত্রাস অত্যাচার কম হয়নি। ২৫০ জনেরও বেশি পার্টিকর্মী-নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, ২২টা পার্টি অফিস বন্ধ করে দেওয়া আর তৃণমূল জবরদখল করেছে গোটা তিনেক পার্টি অফিস।

সন্ত্রাস অত্যাচার শেষ কথা বলে না; এখানেও মানুষের কথাই প্রতিষ্ঠা পেতে চলেছে। ইতিমধ্যে এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পার্টিকর্মীরা ২২টি পার্টি অফিসই খুলেছেন। বহু শহিদ বেদি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সেসব আবার নতুন করে গড়ে লাল পতাকা তোলা হয়েছে। পথসভাগুলিতে সিপিআই(এম) প্রার্থী দীপ্সিতা ধর বলছেনঃ ‘‘এবারে বালির গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ, সংযুক্ত মোর্চার কর্মীরা তৃণমূল গুন্ডাদের চোখে চোখ রেখে বুথ রক্ষা করবে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে’’। এ শুধু যে ফাঁকা ঘোষণা নয়, সাধারণ পথচলতি মানুষের ভিড়ে উপচে-পড়া পথসভাগুলিতে স্লোগান আর মুষ্টিবদ্ধ হাতের প্রত্যয়দীপ্ত উত্তোলনে তারই সমর্থন মিলছে।

চটশিল্পের কথা না বললে বালির নির্বাচনী প্রচারের কথা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। তিনটি চটকল এই কেন্দ্রে - বালি, অম্বিকা, মহাদেও। চটকলে মজুরি বৃদ্ধি সহ দাবিদাওয়ার আন্দোলনে শ্রমিকরা সবসময়ে পাশে পেয়েছে সিআইটিইউ অনুমোদিত বেঙ্গল চটকল মজদুর ইউনিয়নকে। কিন্তু গত দশ বছরে ধারাবাহিকভাবে এই ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। চটকলের মধ্যে ইউনিয়নকে প্রায় কোনো কাজই করতে দেওয়া হয় না। ইউনিয়নকে দুর্বল করে দিয়ে চটকলে চালু হয়েছে জমিদারি প্রথা। সব চুক্তিশ্রমিক, তৃণমূলের নেতারা কমিশনের বিনিময়ে এদের কাজে ঢোকাচ্ছে। এসবের মধ্যদিয়ে কোটি কোটি টাকা কামানোর বন্দোবস্ত হয়েছে মিলগুলির অভ্যন্তরে।

বালির মানুষের বিনা খরচে স্বাস্থ্যপরিষেবা পাওয়ার এক উৎকৃষ্ট প্রতিষ্ঠান ছিল কেদারনাথ মাতৃসদন। পরিচালনা করত বালি পুরসভা। বামফ্রন্ট সরকারের সময় এর পরিকাঠামোর সম্প্রসারণ ঘটানো হয়। ‘ছিল’ এই কারণেই বলা হয়েছে কেননা দু’বছর আগে নতুনকরে গড়ে তোলা হবে বলে পুরো বাড়িটাই ভেঙে ফেলে তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড। আজও সেই অবস্থাতেই রয়েছে। সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়া থেকে। এই নিয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীর কাছে সেই ক্ষোভের কথা প্রকাশ করে ফেলছেন মানুষ। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠনে বালি পুরসভায় দারুণ অগ্রগতি ঘটেছিল। এখন সেসব অতীত। যারা তৃণমূল করে একমাত্র তাদের গোষ্ঠীগুলিই আর্থিক সহায়তা পায়, অন্যরা বঞ্চিত হয় তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে।

গত পাঁচ বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক এমন একটা কাজ করেনি যা তৃণমূল প্রচারে বলতে পারছে। উল্টে রাস্তাঘাটে, চা দোকানের আড্ডায়, ক্লাবে-মাঠে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে বেআইনি নির্মাণ এবং ঠিকাদারি কাজকর্মে কীরকম ব্যাপক অসৎ লেনদেনে যুক্ত তৃণমূলের সিকি-আদুলি সহ বড়ো - সব নেতারা। প্রচারে এসব প্রসঙ্গের মুখোমুখি হলেই তৃণমূলীরা সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে তাদের দলবদলু বিধায়কের ওপর।

ওই প্রার্থীকে নিয়ে বিজেপি’র অন্দরমহলেও বেশ টানাপোড়েন আছে। আবার প্রার্থীকে নিয়ে জনগণের এমনকি তাদের সমর্থকদের প্রশ্নবাণে যথেষ্ট বিব্রত বিজেপি। তাই সেই অর্থে এখনও সেইভাবে প্রচারও শুরু করতে পারেনি বিজেপি। তবুও এর মাঝেই কয়েকবার বিজেপি প্রার্থীকে এলাকার অনুন্নয়ন, দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ ভোটারদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। তবে তাঁর উত্তর একটাইঃ ‘‘ওই দলে থেকে আমি কাজ করতে পারছিলাম না। আমাকে কোনো কিছুই জানানো হতোনা’’।

তবে মানুষের কাছে সবই পরিষ্কার। জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা বুঝতে পেরেছেন, কে তাদের শত্রু আর কাকে বিপদে আপদে পাওয়া যায়। বিশেষ করে অতিমারী এবং লকডাউনের সময় তৃণমূল, বিজেপি সব ভয়েতে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। শুধু বামপন্থীরা সারাসময়টা তাদের পাশে থেকেছে, ক্ষুদ্র সামর্থ্যকে সম্বল করে ত্রাণ নিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। সেই দিনগুলি আবার ফিরে আসুক মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাকেও ভুলতে চায়না তারা। এই অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করেই সামগ্রিকভাবে গত দশ বছরের এই দমবন্ধকর অবস্থা থেকে তারা মুক্তি পেতে চাইছেন।