৫৮ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ২ এপ্রিল, ২০২১ / ১৯ চৈত্র, ১৪২৭
গত ১০ বছর ভোট লুটের জবাব দিতে সংযুক্ত মোর্চা প্রার্থীকেই বিধানসভায় পাঠাতে চান কসবার মানুষ
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
কসবা বিধানসভা কেন্দ্রের সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থী শতরূপ ঘোষের প্রচার।
সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থী শতরূপ ঘোষকে নিয়ে কসবার মানুষের উচ্ছ্বাস আর আকাশছোঁয়া আবেগ কার্যত লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে ফুটে উঠছে পূর্ব কলকাতায়। সারি সারি বাড়ির বিভিন্ন তলা থেকে ঝরনার মতো ফুলের পাপড়ি নেমে আসছে প্রচার মিছিলে থাকা প্রার্থী শতরূপকে লক্ষ্য করে। কসবা বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষ দিন গুনছেন ইভিএম’র বোতামে আঙুল ছুঁইয়ে জবাব দিতে। তারই প্রতীক এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ২০১১ থেকে কোনো স্তরের নির্বাচনেই ইভিএম তো দুরের কথা তাঁরা বুথের ধারে কাছেই ঘেঁষতে পারেন নি। তাই এবার দলবেঁধে ভোট কেন্দ্রে পৌঁছতে চান। বুথ আগলাতে চান। ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ভোটাধিকার কেড়ে নেবার শাস্তি দিতে চান। কাকে শাস্তি দিতে চান? কাকে আবার! মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে গোটা কসবা জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রাখা জাভেদ খান আর তাঁর দলকে। আর কসবার ওয়ার্ডগুলির অলিগলিতে ক্রমাগত বাড়তে থাকা সংযুক্ত মোর্চার মিছিলের দৈর্ঘ্য দেখতে দেখতে জমানা শেষের দিন গুনছেন জাভেদ খান।
কেন বাড়ছে সংযুক্ত মোর্চার মিছিলে সব অংশের মানুষের ভিড়? উত্তর দিতে এতদিন ভয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল এলাকা। কিন্তু এখন সদ্য ভোটার হওয়া তরুণেরাও হাতে লাল, তেরঙ্গা বা আইএসএফ’র ঝান্ডা হাতে সিপিআই(এম) প্রার্থী শতরূপ ঘোষের সংযুক্ত মোর্চার মিছিলে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই খুলেআম বলছেন তৃণমূল প্রার্থী জাভেদ খানের নানা অত্যাচার এবং অবৈধ কার্যকলাপের কথা, তাঁদের উপলব্ধির কথা। কি বলছেন ওরা? ২১ বছর বয়সি এমবিএ পাস যুবক মহম্মদ সাকিব, পার্থপ্রতিম ঘোষ বলছেন, বিশ্বাস করিনা তৃণমূলকে। আমরা কোনো ভাতা চাই না, কাজ চাই। নিয়োগ চাই। প্রতিশ্রুতি অনেক শুনেছি। মুখ্যমন্ত্রী চল্লিশ শতাংশ বেকারত্ব কমিয়েছেন বলেছেন। কিন্তু টেট বন্ধ। অস্থায়ী ছাড়া সবরকমের নিয়োগ বন্ধ, কোথায় চাকরি? কে পেল চাকরি? ঘুষ দিতে হচ্ছে কেন চাকরি পেতে? আমাদের অপমান করা হচ্ছে। তার বদলা নিতে আমরা এই মিছিলে এসেছি। কারণ মোর্চা বলছে চাকরি হবে, আবার শুরু হবে টেট সহ অন্যান্য স্তরের সরকারি নিয়োগ।
২৭ মার্চ শতরূপ ঘোষের ভোট প্রচারের সঙ্গী হয়ে অবাক হতে হলো। প্রচার শুরু হয় তপসিয়া-টবিন রোড বাস স্ট্যান্ডের কাছে অটো স্ট্যান্ড থেকে। বাইপাসের পশ্চিম পারের ব্রিকফিল্ড লেন, জে জে খান রোড, ধাবা পাড়া হয়ে শতরূপ ঘোষের সমর্থনে প্রচার পরিক্রমা ক্রমশ বড়ো মিছিলের আকার নিয়ে পেরোতে থাকে মহল্লাগুলি। অপরিসর সেসব গলি পেরনোর সময় ঘটতে থাকে অভূতপূর্ব সব ঘটনা। প্রার্থী শতরূপের দিকে এগিয়ে আসে শুভেচ্ছা জানানোর অজস্র হাত। গতবার (২০১৬) তাঁকে অন্যায়ভাবে রিগিং করে ৬৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকেই প্রায় ২১ হাজার ভোটে হারিয়ে জাভেদ খান নিজের হার বাঁচান। কারণ শতরূপ বাকি বিধানসভা ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন প্রায় ১২ হাজার ভোটে। এই এলাকার সমস্ত বুথ থেকে সিপিআই(এম)’র এজেন্টদের মেরে বের করে দেওয়া হয়। যারা বুথ কামড়ে পড়েছিলেন সেই মীনা দাস, বালা ভাই, হিরু ভাই, মহম্মদ নাজিমদের ব্যাপক মারধর করা হয়। কেড়ে নেওয়া হয় আইডেন্টিটি কার্ড।
এদিন সংযুক্ত মোর্চার কর্মীদের এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসার দাবিতে সায় দিয়ে শতরূপের মিছিলকে ঢুকতে হয়, ঘুরতে হয় এমন অনেক গলি মহল্লায় যা পূর্ব নির্ধারিত ছিল না। প্রার্থীকে মানুষের অভিনন্দিত করার ভঙ্গি দেখে বোঝা দায় হয়ে যায় এই সব মহল্লাকেন্দ্রিক বুথগুলিতে কেন হারতে হয়েছে বাম প্রার্থীদের। এতদিন মানুষ কোনো নির্বাচনেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন নি, ইভিএম’র পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে উন্নয়ন বাহিনী। চলেছে দেদার ছাপ্পা ভোট। কার্যত গত ১০ বছরে বিরোধী এজেন্টকে বসতে দেওয়া হয়নি। এবার সেটা হতে দেবেন না সংযুক্ত মোর্চার কর্মীরা।
গোটা বৃহত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে পূর্ব কলকাতার কসবা সংলগ্ন জলাভূমি। ইস্টার্ন বাইপাসের এই অংশে কৃষক সভার নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন এবং বামপন্থী উদ্বাস্তু সংগঠন ইউসিআরসি’র নেতৃত্বে বহু আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেশ কিছু এলাকা বসত ভূমি হিসাবে গড়ে ওঠে ৬০’র দশকের শেষদিকে। যেখানে বিশিষ্ট সিপিআই(এম) নেতা এবং বামফ্রন্ট সরকারের নগর উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী প্রশান্ত শূরের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় নগরায়ণ। পরবর্তীকালে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র প্রশান্ত চ্যাটার্জি এই এলাকার উন্নয়নে উদ্যোগ নেন। একদা যেখানে মানুষ হোগলা বন ঘেরা এলাকায় থাকতেন, মাদুর তৈরি ও বিক্রি সহ নানা অনিশ্চিত পেশায় যুক্ত ছিলেন, তাঁরা বামফ্রন্টের সময় উদ্বাস্তু আন্দোলনের জেরে দলিল পান। উন্নতি ঘটে জীবিকার ক্ষেত্রে, যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও সেই মানুষদের ওপর এনআরসি চাপানোর চেষ্টা মানবেন না, একথা স্লোগানে বলছেন তাঁরা। মিছিল থেকে তাঁরা বলছেন বিভাজনের রাজনীতি মানেন না। তাঁরা জোর দিয়ে বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ হবে। স্লোগান তুলছেন ছাত্র-যুবরা, তাতে গলা মেলাচ্ছেন বাকিরা - ভুখমারি সে আজাদি, মহঙ্গাই সে আজাদি, জাতিবাদ সে আজাদি, পুঁজিবাদ সে আজাদি... হম লেকে রহেঙ্গে।
গত ১০ বছর এখানকার রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখানে চলছে নানা অবৈধ কাজ। সবটাই হচ্ছে তৃণমূলের প্রত্যক্ষ মদতে। বেআইনিভাবে এবং পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে জলাভূমি ভরাটের মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপ। অভিযোগ, বিধায়ক জাভেদ খানের নেতৃত্বে সরকারি জমি দখলের এক সুবিশাল চক্র কাজ করছে এখানে। দখল করা জমিতে চলছে নির্মাণের কাজ। গড়ে উঠছে বেনিয়মের বহুতল। অভিযোগ, দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রে সেই বহুতলের একই ফ্ল্যাট বিক্রি করা হচ্ছে একাধিক ক্রেতার কাছে। জটিলতার মুখে পড়ে ঝামেলা সামলাতে বিধায়ক এবং তাঁর ছেলের সশস্ত্র বাহিনী ফ্ল্যাটের বৈধ দাবিদারকে ভয় দেখিয়ে এলাকাছাড়া করছে। প্রশাসনের কাছে গেলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। এক অশুভ চক্র চলছে।
এলাকার সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় এই ধরনের নানা অনিয়মের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে স্মারকলিপি। বেছে বেছে তাই সিপিআই(এম) নেতা এবং কর্মীরা এই পর্বে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। কর্পোরেশন নির্বাচনের পর এই আক্রমণের ঘটনা সংখ্যায় বেড়েছে এবং তীব্রতর হয়েছে। ভাঙা হয়েছে একের পর এক পার্টি অফিস। না বিজেপি’কে এর বিরোধিতায় ময়দানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখানকার মানুষ তৃণমূল আর বিজেপি’র ঢলাঢলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আতঙ্কিত বাসিন্দারা বলছেন, মমতা ব্যানার্জির সরকার মুখে বিরোধিতা করলেও এনআরসি করার জন্য ডিটেনশন ক্যাম্প গড়েছেন, তাই তিনি জবাব পাবেন ভোটে।
বেআইনের নজির আছে আরও।এলাকায় তৃণমূল বাহিনীকে নজরানা না দিয়ে কোনো জমি কেউ কিনলেও তার দলিল আটকে দেয় প্রশাসন। ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রেও মিউটেশন সহ পৌরসভা সংক্রান্ত অনুমতি, কাজকর্ম আটকে দেওয়া হয়।
এই সব অবৈধ কারবারে জেরবার মার্টিন পাড়ায় মিছিল ঢুকতেই চমক। মার্টিন বার্ন কোম্পানির পুরনো ইট ভাটা থাকায় এই এলাকা মার্টিন পাড়া নামে পরিচিত। সেখানে একটি সরু গলিতে ঢুকতেই মিছিলের ওপর ফুলের ধারা নেমে এলো। মালা হাতে প্রার্থীকে পরানোর, অভিনন্দন জানানোর ঢল নামলো। এর পাশাপাশি এখানকার মানুষ কাজহীন লকডাউনের সময় পাশে পেয়েছেন বামপন্থীদের বলছেনও সেই কৃতজ্ঞতার কথা। সেখানেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী উত্তর পঞ্চান্ন গ্রামের দুই ছাত্রী শ্রাবন্তী ঘরামী আর সুনিতা রায়ের সঙ্গে কথা হলো। কেন তাঁরা মিছিলে? তাঁরা বললেন তাঁরা চিন্তিত পরীক্ষার পর কিভাবে তাঁরা কলেজে ভর্তি হবে ঘুষ ছাড়া। কেন তাঁরা মেধার ভিত্তিতে ভর্তি হতে পারবেন না? পূর্ব পঞ্চান্ন গ্রামের বাসিন্দা যুবক প্রদীপ মণ্ডল জিজ্ঞেস করলেন, নতুন কলকারখানা কোথায়? কোথায় পাবেন তাঁরা চাকরি? এতদিন তো দেখলাম দুই ফুলকেই। তার অভিযোগ, এখানে সব কাজেই কাটমানি লাগে কেন? সিন্ডিকেটের নাম করে জুলুম চলবে কতদিন ? কেন সন্ধ্যে হলেই এখানকার যুবকদের একটা অংশকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বাধ্য করা হচ্ছে অসামাজিক কাজ করতে? কবে হবে টেট সুষ্ঠু ভাবে? শতরূপ এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে বললেন এই সরকারকে সরাতে হবে। রুখে দিতে হবে দুই ফুলের গোপন যোগসাজশের মধ্য দিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা। ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট সরকারের সময় কলেজে ঘুষ দিতে হতো না, টেট পরীক্ষা হতো ঠিক সময়ে। শিল্পে কর্মসংস্থান হতো, সরকারি চাকরি হতো নিয়ম মেনে। চাকরি পেতে কাটমানি দিতে হতো না। তাই সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীদের জয়ী করতে হবে সর্বত্র। শতরূপের গলা ছাপিয়ে স্লোগান উঠল, ইনকিলাব জিন্দাবাদ...।