E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ২ এপ্রিল, ২০২১ / ১৯ চৈত্র, ১৪২৭

এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের মিথ্যাচার সন্ত্রাসের জবাব চাইছেন আলিপুরদুয়ার জেলার মানুষ

সঞ্জিত দে


প্রচারে আলিপুরদুয়ার জেলার ফালাকাটা কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী ক্ষিতীশ চন্দ্র রায়।

তৃণমূল-বিজেপি’র কাছে জবাব চাইছে কুমারগ্রামের সংকোশ নদীর তীর থেকে ডিমডিমা মুজনাই নদীর তীরের সব চা বাগান, বনাঞ্চল, গ্রামীণ কৃষি এলাকার মানুষ। রাজাভাতখাওয়া থেকে জলদাপাড়া, বক্সাদুয়ার সহ সব বনাঞ্চলের মানুষ। ভুটান সীমান্তের জয়গাঁ থেকে ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার থেকে বীরপাড়া শহরের মানুষ। সকলেই হিসাব চাইছেন রাজ্যের শাসকদলের কাছে, তেমনই হিসাব চাইছেন কেন্দ্রের শাসকদলের কাছে। নতুন জেলা সূচনা থেকে দেখে আসছে গত সাত বছর ধরে জেলা গঠনের পর বিগত সব বিধানসভা, লোকসভা নির্বাচনে এ জেলার মাটিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এসে সভা করে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু এই জেলার পাঁচটি বিধানসভা ক্ষেত্রের ভোটারদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বড়োই তিক্ত। জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা চা বাগানের পর গভীর অরণ্য এবং কৃষি এলাকা দিয়ে ঘেরা। অনেকগুলি চা বাগান বন্ধ। অরণ্য ঘিরে পর্যটন শিল্প ধুঁকছে। গ্রামে কৃষকের ফসলের দাম নেই। শহরের ব্যবসায় মন্দা। বাগান, অরণ্য, গ্রাম-শহরের বেকারের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এসবের হিসেব চাইছেন মানুষ। এই হিসেব চাওয়ার সাথেই আরও কিছু হিসেব চাইছেন মানুষ। গত দশ বছর ধরে রাজ্যের শাসক দলের ভয় দেখানো, ভোট লুট, দল ভাঙিয়ে ক্ষমতা দখল, সন্ত্রাস, পার্টি অফিস দখল, আগুন দেওয়া - সব কিছুর হিসেব চাইছেন জেলার মানুষ। এই জেলার পাঁচটি বিধানসভা আলিপুরদুয়ার, কুমারগ্রাম (সংরক্ষিত), মাদারিহাট (সংরক্ষিত), কালচিনি (সংরক্ষিত), ফালাকাটা (সংরক্ষিত)। এই প্রার্থীরা হলেন আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রে কংগ্রেসের দেবপ্রসাদ রায়, ফালাকাটা কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী ক্ষিতীশ চন্দ্র রায়, মাদারিহাট কেন্দ্রে আরএসপি প্রার্থী সুভাষ লোহার, কালচিনি কেন্দ্রে কংগ্রেসের অভিজিৎ নার্জিনারি এবং কুমারগ্রাম কেন্দ্রের প্রার্থী কিশোর মিঞ্জ। সব জায়গায় মোর্চার প্রার্থীরা ঝাঁপিয়ে নেমেছেন প্রচারে। এসময়েই গত ১৮ মার্চ দেখা গেল এই ভয়ের আগল ঠেলে ফালাকাটায় বিজয় কেতন উড়িয়ে বাঁধন ভাঙা মিছিলের স্রোত।

রাজ্যে ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে ভয় হুমকি শাসানি এসব ফালাকাটার বিভিন্ন গ্রাম-শহরে ছিল। লালঝান্ডার কর্মী-সমর্থক দেখলেই চলতো হামলা। একইসাথে ছিল পার্টি অফিসের দখল নেওয়া, ভাঙচুর করা, আগুন দেওয়া। দ্বিতীয় দফার ক্ষমতা পেয়ে আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়। তেমনই এক নজির ফালাকাটা থেকে মাদারিহাট যাবার রাস্তায় পাঁচ মাইল এলাকায়। ২০১৬ সালে এই এলাকার সিপিআই(এম) অফিস ভেঙে গুঁড়িয়ে আগুন দিয়ে সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এই সন্ত্রাসের আবহেও এলাকার পার্টিকর্মী-সমর্থকরা দাঁতে দাঁত চেপে পার্টির প্রচারের কাজ চালিয়ে গেছেন। এর ফলও পেয়েছেন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কুঁকড়ে থাকা সাধারণ মানুষ, কৃষক, খেতমজুর, দিনমজুর - সকলে সাহস-ভরসা নিয়ে লালঝান্ডার দিকে এগিয়ে এসেছেন। বিগত পাঁচ বছরে ক্রমে ক্রমে দলের ক্ষয়ে তৃণমূলের অধিকাংশ মাতব্বর নাম লিখিয়েছে পদ্ম শিবিরে। গ্রামের সাধারণ মানুষ পার্টি নেতৃত্বের কাছে আবেদন করেছেন ফের পার্টি অফিস চালু করে সকলকে ভরসা-আস্থা দিতে। খেটে খাওয়া মানুষের আরজি এবং সহযোগিতা নিয়ে ফের পার্টি অফিস সাফসুতরো করে সাজিয়ে তোলা হয়। সেই অফিসের আরেকবার উদ্বোধন হয়। পাঁচ মাইলের সংলগ্ন গ্রাম ময়রাডাঙা, দেওগাঁ, শালকুমার এই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতের কৃষক, খেতমজুর, অসংগঠিত শ্রমিকসহ প্রচুর মানুষ এদিন অফিসের উদ্বোধন দেখতে হাজির ছিলেন উৎসবের মেজাজে। এই উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সভা জনসভার আকার ধারণ করে। মহিলা এবং যুবদের উৎসাহ-উপস্থিতি ছিল নজরকাড়া। জনসভা পরিচালনা করেন রবীন্দ্রনাথ বর্মণ। বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা নেতা আতিউল হক, নিতাই পাল,ফালাকাটা কেন্দ্রের প্রার্থী ক্ষিতীশচন্দ্র রায়, মহিলা নেত্রী কাকলি ভৌমিক, জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে কার্তিক গোপ, আরএসপি নেতা জ্ঞানেন দাস প্রমুখ। সভায় হাজির থাকা অনেকেই বলেন, এবারের ভোট ভুল শোধরাবার লুটেরাদের মোক্ষম জবাব দেবার, বাংলাকে সাজিয়ে নেবার আর মানুষের কাজের সুযোগ দেবার ভোট। জবাব এবার আমরা দেবোই।

গ্রামে জাগছে মানুষ। গ্রামের নাম কালিধরপুর বংশীধরপুর। ফালাকাটা ২নং গ্রাম পঞ্চায়েতের এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। সকাল থেকে গ্রামে প্রচারে এসে এক অন্য অভিজ্ঞতা হলো ফালাকাটা কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী ক্ষিতীশচন্দ্র রায়ের। যে গ্রামে গত দশ বছর ধরে এক অন্য আবহ তৈরি করে রেখেছিল রাজ্যের শাসকদল। হকের কথা, অধিকারের কথা বলা কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। সেই গ্রাম দেখল লালঝান্ডার স্রোত। গ্রামের মানুষ কেউ মাঠের কাজ ফেলে কেউ বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে মিশে গেলেন স্রোতের সাথে। বিশেষ করে মহিলারাই এলেন সামনের সারিতে। মুখ খুললেন তাঁরাও। কাজ না পাবার যন্ত্রণা, দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় চাপের কথা তাঁরা বললেন। জোয়ান ছেলে-স্বামী ভিন্ রাজ্যে। সব কিছুই প্রাণ খুলে বললেন। বললেন, এবার অবস্থা পাল্টাতে চাই। নদীর পার ভাঙে, জীবনে অনিশ্চয়তা বাড়ে, সাথে চুরমার হয়ে যায় তিল তিল করে গড়া স্বপ্ন। ঘর বসত চাষাবাদ উঠে যায়, পকেট ভরে শাসকের। এমনই ছবি প্রতিবছর দেখা যায় জটেশ্বর গ্রামে। মুজনাই নদীর জলের সাথে মিশে যায় কান্না আর হাহাকার। আলিপুরদুয়ার জেলার ফালাকাটা ব্লকের জটেশ্বর দুই গ্রামপঞ্চায়েতের বাসিন্দাদের এই হা-হুতাশের সাক্ষী সব ভোট। এমনটাই বললেন যতীন পাল, ক্ষিতীশ পাল, অমল পাল, শচীন রায়রা। সবাই গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক বা খেতমজুর। ভোট প্রচারে বের হয়ে নদী পার ভাঙনের যন্ত্রণার কথা শুনলেন ফালাকাটা কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী ক্ষিতীশচন্দ্র রায়। জটেশ্বর দুই গ্রামপঞ্চায়েতের সাহাপাড়া, পালপাড়া হয়ে চলল ভোট প্রচার। বাড়ি বাড়ি ঘুরতেই একেক বাড়ি থেকে বাসিন্দারা বললেন তাদের নানা যন্ত্রণার কথা। প্রার্থী নিজেও জানেন এই যন্ত্রণার কথা। কারণ তিনি নিজেও তো এই অঞ্চলের বাসিন্দা, নিজেও একজন কৃষক। এলাকার মানুষ বললেন, এবার ভোটে তোমাকে জিততেই হবে কারণ নদী ভাঙন বন্ধ করতে হবে, মুজনাই নদীর উপর সেতু করতে হবে। নদীর দুই পারের দুই গ্রাম জটেশ্বর ও দেওগাঁয়ের কয়েক হাজার বাসিন্দা প্রতি বছর নদীর গ্রাসে ভিটেমাটি চাষের জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। ফালাকাটা ব্লকের ফুলকপি, বাধাঁকপির নাম আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলাজুড়ে। আলু, বেগুন অন্যান্য সবজির চাষ রয়েছে এই সব এলাকায়। কিন্তু সেতু না থাকায় ঘুর পথে যেতে হয় ফসল বিক্রিতে। আর এই নদী ভাঙনকে নিয়েই সব ভোটে চলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। ভাঙন রোধের নামেও চলে দেদার টাকা চুরি। সব দেখে শুনে তিতিবিরক্ত মানুষ বলছেন, আমরা অনেকেই আগে ভুল করেছি। এবার সেই ভুলের সংশোধন করতে চাই। এদিন সকাল থেকে কর্মী-সমর্থকদের সাথে প্রার্থী প্রচার করতে ঘুরছেন শুনে অনেকেই খবর দিলেন তাদের পাড়া ঘুরে যাবার জন্য।

সিপিআই(এম) কর্মী কমলকিশোর রায়, কথা প্রসঙ্গে জানালেন, জানেন গ্রামে থাকার মতো, আয় করার মতো, পরিবেশ ছিল। কিন্তু গত দশ বছর ধরে যেভাবে লুট স্বজনপোষণ চলছে তা দেখে সবাই হতাশ। তাই দলে দলে যুবক ও ছেলেরা চলে যাচ্ছে ভিন্ রাজ্যে। প্রচার করতে করতে গ্রামের আলপথ দিয়ে যাবার সময় দেখা গেল জমিতে অনেক পুরুষ এবং মহিলা আলু তোলার কাজ করছেন। তাদের মধ্যে থেকে দু-তিনজন এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে হাত মেলালেন। প্রার্থী সহ সিপিআই(এম) কর্মীরা জমির মাঝেই চলে গেলেন। সবাই হাতের কাজ ফেলে এগিয়ে এসে জমিতেই গোল হয়ে বসে পড়লেন। ক্ষিতীশ রায় বললেন, বামফ্রন্ট আমলে কী ছিল গ্রামের অবস্থা, কেমন ছিল মানুষের জীবনযাত্রা। গত বিধানসভা নির্বাচনেও এই ফালাকাটা কেন্দ্রে প্রার্থী ছিলেন ক্ষিতীশচন্দ্র রায়। সেকথা মনে করেই অনেকে বললেন, আগের ভুল এবার আর করবেন না। এখানেই কৃষক সোরেন বর্মন, খেতমজুর চন্দনা রায়বর্মন, সরলা বর্মন, ভগবতী বর্মন, অনিতা রায়, জোৎস্না রায়, মায়ারানি রায় বলেন, জব কার্ড আছে কিন্তু কাজ পাইনা। তৃণমূলের ঝান্ডা না ধরলে, মিছিলে না গেলে নাকি কাজ হবে না। গ্রামে কাজ না করেই টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। ব্যাপক স্বজনপোষণ দুর্নীতি চলছে। প্রার্থী ক্ষিতীশচন্দ্র রায় নিজেও একসময় ফালাকাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে আন্দোলন করেছেন শাসকদলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রশাসনের যোগসাজশ থাকায় কিছু করা যায়নি। তাই এখানে তিনি বলেন, আপনারা সকলে এগিয়ে আসুন, আমাদের সাথে জোট বাঁধুন আপনাদের সমর্থন পেয়ে এবার সংযুক্ত মোর্চার সরকার এলে সব যন্ত্রণা থেকে রেহাই মিলবে, দুর্নীতিগ্রস্তদের সাজা হবে। ফালাকাটাবাসীর সাথে শাসকদল এবার ভোট পেতে চরম মিথ্যাচার করছে। ফালাকাটা শহরের বিভিন্ন মোড়ে, পাড়ায় শাসকদল ব্যানার ফেস্টুন লাগিয়ে রাজ্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছে - ফালাকাটাকে পৌরসভা করা হয়েছে। চরম মিথ্যাচার। ২০১০ সালেই বামফ্রন্ট শেষ মন্ত্রীসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ফালাকাটাকে পৌরসভায় উন্নীত করার। সেই সিদ্ধান্তকে দশ বছর বাদে এই রাজ্য সরকার রাজ্যপালের কাছে পাঠিয়েছে মাত্র, কোনো প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। অথচ ফালাকাটাবাসীকে বোকা বানিয়ে প্রচার করছে রাজ্য সরকার যে, ফালাকাটা পৌরসভা হয়ে গেছে। মানুষ এবার ভোটে এই মিথ্যাচারের জবাব দেবে। মাদারিরোডের দুই মাইলের বাসিন্দা এমএ, বিএড করা মণিদীপা দাস একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বললেন, আমাদের মতো যুবক-যুবতীদের জীবনের মানেটাই অর্থহীন করে দিল দশ বছর ধরে এই সরকার। লেখাপড়া শেখা কী আমাদের অপরাধ হয়ে গেছে? একই কথা দেওগাঁ গ্রামের যুবক আজিজুল আলমের। এবার সব কিছুর জবাব দেব ব্যালটে।

প্রার্থী ক্ষিতীশচন্দ্র রায় বলেন, গতকাল ধুলাগাঁ মৌজায় ঘুরেছি। শীলবাড়িহাট, পলাশবাড়িহাট যেখানেই যাচ্ছি, মানুষ এগিয়ে এসে নিজেদের মনের যন্ত্রণা আমাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছেন। আমরা জিতবই। মানুষের এই ভালোবাসা বৃথা যাবে না।