৫৮ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ২ এপ্রিল, ২০২১ / ১৯ চৈত্র, ১৪২৭
মানুষের স্বার্থে বিকল্পের দিশা দেখিয়েছে যাদবপুর
সেই ঐতিহ্য অটুট রাখতেই সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীকে জয়ী করার প্রস্তুতি চলছে
সন্দীপ দে
যাদবপুর কেন্দ্রের রিজেন্ট স্টেট এলাকায় প্রচারে সুজন চক্রবর্তী।
বিকল্পের দিশা দেখিয়েছে যাদবপুর। করোনার ভয়ঙ্কর মারণ সংক্রমণে যখন বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানব সমাজ, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী অপরিকল্পিতভাবে লকডাউন ঘোষণা করেছেন, চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক ও খেয়ালি ভাবনায় নিদান হেঁকেছেন থালা-বাসন বাজানোর, আর ফরমান জারি করেছেন ঘরে ঘরে প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বালানোর! আর অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মিডিয়ার আলোয় ভেসে থাকার বাসনায় সেপাই-সান্ত্রি-আমলা পরিবৃতা হয়ে হাটে বাজারে ঘুরে ঘুরে রাস্তায় রাস্তায় আঁক কেটেছেন, গাড়ি হাঁকিয়ে এলাকায় এলাকায় গিয়ে সতর্কবাণী প্রচারের নামে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন! এদের দুজনেরই মূল লক্ষ্য ছিল, প্রচারের আলোর বৃত্তে নিজেদের মেলে ধরা। দেশ ও রাজ্যের শাসকদের এই সীমাহীন অপদার্থতা ও উদাসীনতায় গরিব সাধারণ মানুষ চরম বিপদের মুখে পড়েছেন। এমনই একটি অবস্থায় বিপন্ন-অসহায় মানুষদের প্রতি সেদিন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বামপন্থী ছাত্র-যুবরা। আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দুঃস্থ অসহায় মানুষদের বাড়িতে বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া, অতিমারীর মোকাবিলায় প্রচার ও সুরক্ষা সরঞ্জাম বণ্টনের মতো মানবিক উদ্যোগ নিয়ে নজির গড়েছেন যাদবপুর অঞ্চলের বামপন্থী ছাত্র-যুব ও গণতান্ত্রিক মানুষ। তখন কেবল গরিব উপার্জনহীন ও কাজ খোয়ানো মানুষদেরই নয়, এই কেন্দ্রে এমন অনেক প্রবীণ মানুষ ছিলেন যাঁরা চলাফেরায় অক্ষম এবং যাঁদের ছেলেমেয়ে ও পরিবারের লোকজন ছিলেন বাইরে কর্মরত, অনেকেই ছিলেন অসুস্থ, তাঁদের পাশেও সাধ্যমতো দাঁড়িয়েছেন বামপন্থী কর্মীরা। এই সামগ্রিক উদ্যোগে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা ও বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী।
এই বিশাল কর্মকাণ্ড চলতে চলতেই এখানে শ্রমজীবী ক্যান্টিন ও শ্রমজীবী বাজার গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে যাদবপুর গোটা রাজ্যে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। এই শ্রমজীবী ক্যান্টিনের বর্ষপূর্তি হতে চলেছে আগামী ৩ এপ্রিল। এই ক্যান্টিনের মধ্য দিয়ে যাদবপুর ও সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৮০০ জন মানুষের প্রতিদিনের খাবারের সংস্থান হচ্ছে। যাদবপুরের এই দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে পরবর্তীকালে রাজ্যজুড়ে বামপন্থীরা গরিব অসহায় মানুষদের জন্য অসংখ্য শ্রমজীবী ক্যান্টিন, কমিউনিটি কিচেন, শ্রমজীবী বাজার ইত্যাদি গড়ে তুলে অসামান্য নজির সৃষ্টি করেছেন। সেদিন যাদবপুর এটাই প্রমাণ করেছিল যে, মানুষের স্বার্থে তৃণমূল-বিজেপি নয়, প্রকৃত বিকল্প গড়তে পারেন একমাত্র বামপন্থীরাই।
এই করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার মধ্যেই আমফান ঝড়ের তাণ্ডব ও বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে যখন নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত, পরিস্থিতি মোকাবিলায় নগর প্রশাসন ও রাজ্য সরকার কার্যত ব্যর্থ, তখন ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীকর্মীরা। মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য পার্টিকর্মীদের নিয়ে রাস্তায় ছিলেন সুজন চক্রবর্তী।
কেবল করোনা বিপর্যয়কালেই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই বিকল্প দিশা দেখিয়েছে এই যাদবপুর। উন্নত চেতনা ও উন্নয়নের বহুমুখী কর্মকাণ্ডে এই কেন্দ্রের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। সেই ঐতিহ্যের সরণিকে আরও প্রসারিত করতে সুজন চক্রবর্তী জনপ্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে তাঁর বিধায়ক তহবিলের টাকায় অসংখ্য উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। বিগত পাঁচ বছরে বিধায়ক তহবিলের মোট ৩ কোটি টাকায় এলাকায় পানীয়জলের সমস্যা মেটাতে সরবরাহের ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত করা, বৈদ্যুতিকীকরণ, উঁচু আলোকস্তম্ভ স্থাপন, অসংখ্য রাস্তাঘাট ও শৌচাগার নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যালয়ের সংস্কার ও বিদ্যালয় ভবনের প্রসার,বিদ্যালয়ে কম্পিউটারের ব্যবস্থা করা, সন্তোষপুর খাল সংস্কার,বাঘাযতীন হাসপাতালের উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সুজন চক্রবর্তী নিজেকে উন্নয়নের অন্যতম রূপকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি এই কেন্দ্রের মানুষের স্বার্থে যেমন নানা উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণে সচেষ্ট থেকেছেন, তেমনি প্রতিটি প্রকল্প রূপায়ণের অনুপুঙ্খ হিসাব (ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট) সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিয়েছেন। যা তৃণমূল সরকারের জমানায় কাট-মানি আর দুর্নীতির আবহে নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী চিত্র।
এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখে সবসময় পাশে থাকা, উন্নয়নের নিত্যনতুন ভাবনার উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা তাঁকে সু-জন বন্ধু হিসেবে বিশেষ পরিচিতি এনে দিয়েছে। এর আগে এই যাদবপুর কেন্দ্রের মানুষই তাঁকে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। সে সময় এই লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রাস্তাঘাট, পানীয় জল, ফ্লাইওভার, বিদ্যুদ্য়ন ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ড সহ কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তিনি ভুমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়া জনমুখী আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। এই সমস্ত কিছুর মধ্যদিয়েই যাদবপুর কেন্দ্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে তাঁর বিপুল গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। সেই সুবাদে প্রচারেও তিনি অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন। এই প্রচারের অঙ্গ হিসেবে প্রতিদিন চলছে এলাকা পরিক্রমা, ছোটো বড়ো মিছিল, বৈঠক, পথসভা, জনসভা, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ইত্যাদি।
এই কেন্দ্রের অন্তর্গত ১০টি ওয়ার্ডের সবক’টিতেই সকাল-বিকেল পরিক্রমা, বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কাজ চলছে। প্রতিটি এলাকাতেই মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এসে সুজন চক্রবর্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন, তাঁদের সমর্থনের কথা অকপটে জানাচ্ছেন। লক্ষণীয় দিক হলো, প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই বাড়ির মহিলারা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে সুজন চক্রবর্তীকে স্বাগত জানাচ্ছেন। অনেক জায়গাতেই ফুল-মালায় তাঁকে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন। এমনই দৃশ্য দেখা গেল ৯৬ ওয়ার্ডে বাপুজি নগরের বিস্তীর্ণ এলাকা পরিক্রমার সময়ে। বাপুজি নগর ক্রীড়াঙ্গন সংলগ্ন রাস্তার মোড়ে ছোট্ট মঞ্চে সূচনা সভা। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে পার্টি নেতা সুদীপ সেনগুপ্ত এই অঞ্চলে মানুষের স্বার্থে পার্টির ভূমিকা, করোনাকালে গরিব-অসহায় মানুষের জন্য শ্রমজীবী ক্যান্টিন, শ্রমজীবী বাজার ইত্যাদি গড়ে তোলা, মানুষের কাছে সুরক্ষা সামগ্রী, ওষুধপত্র পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি কাজ ধারাবাহিকভাবে করে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে এখানকার উন্নয়নে সুজন চক্রবর্তীর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন তিনি।
সুজন চক্রবর্তী বলেন, তৃণমূল কংগ্রেস আর্থিকভাবে বাংলাকে সর্বস্বান্ত করেছে। অন্যদিকে বিজেপি’র লক্ষ্য হলো,ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে যেকোনো মূল্যে বাংলার ক্ষমতা দখল করা। এই অবস্থা থেকে বাংলাকে রক্ষা করতে আমরা নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছি। এই নৈরাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষকে বোঝাতে হবে, তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এই নির্বাচনে আমাদের অন্যতম লক্ষ্য হলো কর্মসংস্থান। আপনাদের সমর্থনের মধ্য দিয়েই আমরা বাংলার পুরনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনব।
বাপুজি নগরের প্রতিটি গলিতে, রাস্তায়, মোড়ে মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। সব জায়গাতেই প্রার্থীকে দেখে মানুষ এগিয়ে এসেছেন, হাত মিলিয়েছেন অথবা সরাসরি সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। বহু মানুষ বাড়ির ছাদে অথবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়ে হাত নেড়েছেন। এভাবে চলার পথে সত্তরোর্ধ্ব শ্যামল সোম তাঁর ছোট্ট বাড়ির দরজায় প্রার্থীকে পেয়ে জানালেন, শুধুমাত্র বামপন্থীদের সমর্থনের জন্য ২০১৩ সালের পর থেকে তিনবার তাঁর বাড়ি ভাঙচুর করেছে তৃণমূলীরা। তথাপি তিনি ওদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেননি। এভাবেই কিছুক্ষণ যাবার পর এক অভিনব দৃশ্য চোখে পড়লো। থমকে গেল পথ পরিক্রমা। একটি উঁচু বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গলা হাঁকিয়ে একজন প্রবীণ মানুষ বলে উঠলেন, আমি রাণুগোপাল সোম, আমার ৮৩ বছর বয়স। আমি চাই এই কেন্দ্রে আবার সুজন চক্রবর্তী জয়ী হোক। একথা বলেই উদাত্ত কণ্ঠে স্লোগান তুললেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, সিপিআই(এম) জিন্দাবাদ, ভোট ফর সুজন চক্রবর্তী ইত্যাদি। তাঁর সঙ্গে সবাই গলা মেলালেন, সুজন চক্রবর্তী হাত তুলে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। তারপর এই অনবদ্য ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে মিছিল এগিয়ে চললো সামনের দিকে। এভাবে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন, শুভেচ্ছার সঞ্চয় নিয়ে চলছে সুজন চক্রবর্তীর প্রতিদিনের নির্বাচনী অভিযাত্রা।
সুজন চক্রবর্তী প্রতিটি কর্মসূচিতেই কর্মসংস্থানের কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করছেন। তিনি বলছেন, ভবিষ্যৎ ধ্বংসের হাত থেকে বাংলাকে বাঁচাতে হবে। তৃণমূলের অপদার্থতায় আজ বিজেপি’র যে বাড়বাড়ন্ত, তাতে বাংলার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, নৈতিকতা আজ বিনষ্ট হতে বসেছে। এই বিপদের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনী সংগ্রামে জয় অর্জন করতে হবে আমাদের। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন, যাদবপুরের মানুষ বিকল্প সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য আমি গর্ববোধ করি।
গত নির্বাচনে যাদবপুরের মানুষ তাঁদের প্রিয় প্রতীকে ছাপ দিয়ে সুজন চক্রবর্তীকে নির্বাচিত করে বিধানসভায় পাঠিয়েছেন, যিনি বিধায়ক ও পার্টির নেতা হিসেবে হয়ে উঠেছেন বাংলার মানুষের অন্যতম প্রতিবাদী মুখ, অত্যাচারিত-বঞ্চিত মানুষের এক নির্ভীক কণ্ঠস্বর। আজকে রাজনীতির অঙ্গন যখন নানাভাবে কলুষিত, ঘৃণ্য স্বার্থে তৃণমূল-বিজেপি’র দলবদলের প্রহসনে যখন নীতি-আদর্শ প্রতিনিয়ত ধূলিসাৎ হচ্ছে, তখন রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গরিব সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির সংগ্রামকে জোরালো করতে এবং এলাকার উন্নয়নকে অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন সংযুক্ত মোর্চা মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর জয়কে সুনিশ্চিত করা। একথা সম্যকভাবেই উপলব্ধি করছেন যাদবপুর কেন্দ্রের মানুষ। তাই এই কেন্দ্র জুড়ে এখন তাঁকে পুনর্নির্বাচিত করারই প্রস্তুতি চলছে।