E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ২ এপ্রিল, ২০২১ / ১৯ চৈত্র, ১৪২৭

এবারের বিজেপি, তৃণমূল এবং বামফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তাহারে পরিবেশ রক্ষার প্রসঙ্গ

তপন মিশ্র


পশ্চিমবাংলার হবু সরকারের পরিবেশ রক্ষার পরিকল্পনার কী প্রস্তাব রাজনৈতিক দল বা জোটগুলি রেখেছে তাদের ইস্তাহারের পাতা ওলটালে আপনি আমি দেখতে পাব। পরিবেশ রক্ষার ভাবনা কোনো এক রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কিন্তু যে দলগুলির কথা আমরা আলোচনা করব তাদের সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে পরিবেশ নিয়ে ভাবনা থাকা জরুরি। অন্তত মানুষ সেই আশাই করেন।

১০ বছর আগেও এই প্রসঙ্গ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের তেমন কোনো ভাবনা ছিলনা। যাঁরা বলেন পরিবেশ রক্ষা রাজনীতির বিষয় নয় কেবল ব্যক্তিগত অভ্যাসের বিষয়, তাঁরা ভুল করছেন। ব্যক্তিগত অভ্যাসের বাইরেও নীতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় আছে যা ব্যক্তি অভ্যাসের মধ্য দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। যেমন ধরা যাক দিল্লি, কলকাতা ইত্যাদি শহরে বায়ুদূষণরোধের বিষয় বা মাটির নিচের জলের ক্রমবর্ধমান হ্রাসের বিষয়।

আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং তার ফলশ্রুতি হিসাবে জলবায়ুর পরিবর্তন। অতি বৃষ্টির জন্য দুর্দশা বা আমফানের মতো ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রান্তিক মানুষ। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কিছুটা বেশি হলেও, অনেক বেশি নয়। এই কারণেই পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয় এবং নীতি পরিবর্তনের বিষয়।

সারা ভারত তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের একটি সর্বভারতীয় দল হিসাবে জাহির করলেও দেশব্যাপী পরিবেশ দূষণ এবং পরিবেশ রক্ষা নিয়ে তাদের ন্যূনতম ভাবনা নেই বললেই চলে। তাদের ইস্তাহার ৬৬ পাতার। এর মধ্যে নেত্রীর ছবি আছে অনেকগুলি। পরিবেশ সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট অধ্যায় বা প্যারা নেই। ইতিউতি পরিবেশের কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ আছে। ইস্তাহারের ২৩ নম্বর পাতায় ‘মাটির সৃষ্টি’ সম্পর্কে বলা আছে “পতিত জমিকে উৎপাদনশীল করে তুলতে এই কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। প্রকল্পটি রাজ্যের ৬টি পশ্চিমী জেলা, যেমন-বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম বর্ধমানে শুরু করা হয়েছিল”। ‘মা-মাটি-মানুষের’ গ্যাঁড়াকলে আমাদের বিজ্ঞান ভুলে যাওয়ার জোগাড়। মাটির সৃষ্টি একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, কোনো সরকারের ক্ষমতার মধ্যে নয়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মাটি সৃষ্টি হয়েছে। আগামী ৫ বছরে এই কাজ সরকার কী করে, তৃণমূল কংগ্রেস কীভাবে মাটি সৃষ্টি করবে তার কোনো উল্লেখ অবশ্য এখানে নেই। বড়োজোর সরকার মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিতে পারে।

৪৬ নম্বর পাতায় ‘জল ধরো জল ভরো’ এবং আর্সেনিক মুক্ত জল সরবরাহের কথা বলা আছে। ৪৮ পাতায় জার্মানির রাইন নদীতে জল পরিবহণ ব্যবস্থার মতো রাজ্যের ২৬৫টি নদী ও তার শাখা প্রশাখাতে পরিবহণ ব্যবস্থা চালুর প্রতিশ্রুতি আছে। আমাদের রাজ্যের ৪/৫টি নদী বাদ দিলে অন্যগুলির নাব্যতা নেই বললেই চলে। সুন্দরবনে জল পরিবহণ ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই ব্যবস্থায় জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার এতটাই দূষণযুক্ত যে সুন্দরবনের পরিবেশ বিপদের মুখে। দূষণ কমানোর জন্য যে উন্নত প্রযুক্তি চাই সে বিষয়ে কোনো ভাবনা নেই। প্রতিশ্রুতির জোয়ারে পরিবেশ রক্ষার ভাবনা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে।

বিজেপি’র নির্বাচনী ইস্তাহারের নাম ‘সোনার বাংলা সঙ্কল্প পত্র ২০২১’। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬২ এবং শেষের দিকে বাংলিশ (বাংলা ও ইংলিশ) পরিবেশের জন্য উদ্দিষ্ট কয়েকটি লাইন আছে। এই অধ্যায়টির নাম ‘এবার পরিবেশ এবার বিজেপি’। এর অধীনে যে চারটি প্যারা আছে সেগুলির নাম অদ্ভুত। যেমন “এবার ফাইটিং পল্যুশন”, “এবার ক্লিন গঙ্গা”, “এবার প্রটেক্টিং ফরেস্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ” এবং “এবার রোবাস্ট ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট”। প্রথমটিতে বায়ুদূষণের উৎস বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে। যারা দিল্লির দূষণের উৎস গত ৬ বছর ধরে বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়নি এবং পৃথিবীর দূষিত শহরগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি এদেশে, সেখানে এই প্রতিশ্রুতি হাস্যকর। দ্বিতীয়টিতে গঙ্গার ভাঙনের কথা এবং নদীর পথ পরিবর্তনের কারণে কিছু আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে তার সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। গঙ্গা নিয়ে বিজেপি’র ভাবনার অন্ত নেই। বলা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে গঙ্গা অববাহিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব পড়বে তার সুষ্ঠু সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে। কংগ্রেস আমলে গঙ্গাকে দূষণ মুক্ত রাখা এবং গঙ্গার স্বাভাবিক জলপ্রবাহ বজায় রাখার জন্য যে ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্লান’ রূপায়ণের চেষ্টা হয় ২০১৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর সেই প্রয়াসের নাম হয় ‘নমামি গঙ্গা’। এর ফলে গঙ্গার কোনো উপকার তো হয়নি বরং গঙ্গার উৎসমুখে বাঁধ তৈরি করে জলধারায় বাধা তৈরি করা হচ্ছে। ফলে গত ফ্রেব্রুয়ারি মাসে উত্তরাখণ্ডে এনটিপিসি’র তৈরি কাঠামো ভেঙে প্রাণহানি সহ সম্পদ হানি হয়েছে। বাংলার নয় উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, বিহার ইত্যাদি রাজ্যে গঙ্গার দূষণ মানুষের অনেক দুর্দশার কারণ। তৃতীয়টি অরণ্য সম্পদ বৃদ্ধি, রাস্তার দু’পাশে বৃক্ষরোপণ, পশ্চিমবঙ্গ বন গবেষণা কেন্দ্র, হাতি এবং বাঘের সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনা আরও ভালো করার প্রতিশ্রুতি আছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই সমস্ত ব্যবস্থাপনা কেন হয়না তার উত্তর এখানে নেই। এ কয়েকটি ক্ষেত্রে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে সেগুলি যে ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয় তা দু’ একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ধরা যাক কর্ণাটকের কথা। এরাজ্যে অরণ্যভূমি ২০ শতাংশের বেশি অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় দ্বিগুণ। এখানে বিজেপি সরকার দীর্ঘদিনের। চাহিদা অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও এখানে কোনো রাজ্যস্তরের বন গবেষণা কেন্দ্র নেই। দেশে ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলে ৩৬টির মধ্যে মাত্র দশটিতে রাজ্যস্তরে বন গবেষণা কেন্দ্র আছে। ভারত সরকার চাইলে অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ফরেস্ট্রি রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশান (ICFRE)-এর অধীনে যেকোনো রাজ্যে শাখা গঠন কেন্দ্র করতেই পারে। এমনি একটি ছোটো গবেষণা কেন্দ্র মেদিনীপুর শহরে ছিল যা বাজপেয়ী সরকারের আমলে তুলে নেওয়া হয়।

বামফ্রন্টের মাত্র ১৬ পৃষ্ঠার ইস্তাহারে পরিবেশ রক্ষার প্রসঙ্গ অনেকটাই গুরুত্ব পেয়েছে। এখানে পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি আছে। বামফ্রন্টের মধ্যে সিপিআই(এম) একটি সর্বভারতীয় দল। ফলে সর্বভারতীয় চিন্তা থাকাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে বন, নদী, জলাশয় ও জলাভূমি রক্ষা এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার অঙ্গীকার রয়েছে। অরণ্যভূমির সঙ্গে অনেক মানুষের জীবনজীবিকা যুক্ত। তাই এই সম্পদ রক্ষার সাথে সাথে অরণ্যের বিস্তারের উপর নজর দেওয়াতেও বামফ্রন্ট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইস্তাহারের ৮ নম্বর পাতায় ‘পশ্চাৎপদ অংশ’ অধ্যায়ে ‘অরণ্য অধিকার আইন’-এর প্রয়োগকে আরও বিস্তৃত করে একাধারে অরণ্য রক্ষা এবং অন্যদিকে অরণ্যবাসীদের অধিকার রক্ষার প্রস্তাবনা সময়োপযোগী। ইকোলজি (বাস্তুতন্ত্র অর্থাৎ জীব-জন্তু, পাখি-পতঙ্গ রক্ষায় পরিকল্পনা গ্রহণ ও রূপায়ণ করা) পরিবেশ রক্ষার এক সামগ্রিক চিন্তা। কেবল বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে অরণ্য সৃজন সম্ভব নয়। মোদী সরকার কর্পোরেটদের হাতে অরণ্যসৃজনের ভার তুলে দিয়ে অরণ্য বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের সর্বনাশ করতে চায়। মোদী সরকারের দেওয়া আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির একমাত্র লক্ষ হলো কার্বন বাণিজ্য, এখানে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং বনবাসীদের জীবনজীবিকা কোনোভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিচার্য নয়। তবে সামাজিক বনসৃজনকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

নাগরিক জীবনে বায়ু এবং জলদূষণ এক জ্বলন্ত সমস্যা। এক্ষেত্রে বামফ্রন্টের প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত সময়োপযোগী। ইস্তাহারের মতে কলকারখানা, স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির থেকে নিষ্কাশিত বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যানবাহনজনিত দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গৃহীত হবে। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার হ্রাসে জনচেতনা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। শহরাঞ্চলে বহুতলের ক্ষেত্রে সৌরশক্তির ব্যবহার ও বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে। জল ও বায়ু দূষণ, শব্দ ও দৃশ্য দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নগর এলাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো সরকারের পক্ষে কেবল তাদের উদ্যোগে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়। এই কারণেই বনবাসীদের দ্বারা বনপরিচালনা (যৌথ বনপরিচালন ব্যবস্থা) সাফল্যের শিখরে পৌঁছায়। পরবর্তীকালে সরকারের অনীহা আমাদের অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে। এই আলোচনার মধ্যে না গিয়েও বামফ্রন্টের ইস্তাহারে বর্ণিত পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে জনসাধারণকে যুক্ত করার প্রয়াসের বিষয়টি কোনো বিকল্প ভাবনা গ্রহণীয় নয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বামফ্রন্টের ইস্তাহার সমাজের সর্বস্তরে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও অনুসন্ধিৎসা গড়ে তোলার যে পরিকল্পনার উল্লেখ করেছে তা এক গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা। পরিবেশ ভাবনার সামগ্রিকতা না থাকলে তা একটি অপেশাদারি মনোভাবের পরিচয়। তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র ইস্তাহারে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এই অপেশাদারিত্ব প্রত্যাশিত।