E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ২ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

রাজ্য সরকারের প্রতিহিংসার শিকার মধ্যবিত্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা


ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর রাজ্য সরকারি কর্মচারী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে মিছিল।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ তৃণমূল শাসনে রাজ্য সরকারি কর্মচারী, পঞ্চায়েত কর্মচারী সহ রাজ্য কোষাগার থেকে বেতন পান এমন সমস্ত অংশের কর্মচারী- শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা নজিরবিহীন আর্থিক বঞ্চনা ও প্রশাসনিক প্রতিহিংসার শিকার। দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত তাদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারও আক্রান্ত।বামফ্রন্ট সরকারের আমলে অর্জিত বিভিন্ন অধিকার ও সুযোগসুবিধা প্রকারান্তরে কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ্যভাতার অধিকার।

১৯৭৯ সালে কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভা রাজ্য কর্মচারী সহ এরাজ্যের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ্যভাতা প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরফলে গত শতাব্দীর ৫০-এর দশক থেকে যে দাবিকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্ত কর্মচারী আন্দোলনের একটি বড়ো অংশের বিকাশ ঘটেছিল, তা স্বীকৃতি পায়।একই সাথে ঔপনিবেশিক ‘সার্ভিস কন্ডাক্ট রুলস ‘বাতিল করে ধর্মঘটের অধিকার সহ পূর্ণ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রদান করা হয়। স্বভাবতই ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বামফ্রন্ট আমলে কর্মচারীদের বহুবিধ অধিকার সংবলিত আদেশনামা একের পর এক প্রকাশিত হয়েছে।

কিন্তু এরাজ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের পর অন্যান্য অংশের মানুষের মতোই কর্মচারী ও শিক্ষকদের অর্জিত অধিকারগুলিও আক্রান্ত হতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ্যভাতার অর্জিত অধিকারটিও বর্তমান তৃণমূল সরকারের রোষের শিকার হয়। মহার্ঘ্যভাতা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অথচ এমন একটা সময়ে তৃণমূল সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ অধিকারকে উপেক্ষা করতে শুরু করল, যখন সারা দেশে মূল্যবৃদ্ধি স্বাধীনতা-উত্তরপর্বে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্বভাবতই, মহার্ঘ্যভাতা সময়মতো না মিটিয়ে দেওয়ার ফলে আপাত স্বচ্ছল সংগঠিত অংশেরও নিয়মিত বেতনের ক্ষয় হচ্ছে, যা তাদের মধ্যে সংগত ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

গত কয়েক বছরে বিভিন্নভাবে এই ক্ষোভের সংগঠিত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গত ২০-২১ মে কলকাতায় রাত্রিব্যাপী গণঅবস্থান, ৩০ আগস্ট রাজ্য জুড়ে ব্লকস্তর পর্যন্ত ২ ঘণ্টার কর্মবিরতি এবং ২৩ নভেম্বর বিধানসভা অভিযান কর্মসূচিতে ক্ষোভের কার্যত বিস্ফোরণ ঘটে। ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টেও মহার্ঘ্যভাতা সম্পর্কিত মামলায় রাজ্য সরকার কার্যত নাস্তানাবুদ হয়েছে। এতদসত্ত্বেও সংবিৎ ফেরেনি চূড়ান্ত জনবিরোধী এবং কর্মচারী বিরোধী তৃণমূল সরকারের। কর্মচারীদের ধূমায়িত ক্ষোভে আদালতকে মান্যতা না দেওয়ার বিষয়টি একটি অতিরিক্ত উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। ২৩ নভেম্বর বিধানসভা অভিযান আন্দোলনের আহ্বায়ক ছিল রাজ্য প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মচারী-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের প্রায় ৩০টি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ। মূলত, তিনটি দাবিকে সামনে রেখে এই আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল। দাবিগুলি ছিল কর্মচারী-শিক্ষক বৃত্তের বাইরেও জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন, স্বচ্ছতার সাথে প্রশাসনের সমস্ত শূন্য পদে স্থায়ী নিয়োগের প্রসঙ্গ, চুক্তিপ্রথায় নিযুক্ত কর্মচারীদের নিয়মিতকরণ এবং সর্বোপরি রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনরুদ্ধার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার প্রসঙ্গও দাবিসনদে যুক্ত হয়েছিল।

ওইদিন বেলা ২টো থেকেই মধ্য কলকাতার ধর্মতলা চত্বর কয়েক হাজার কর্মচারী-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের দৃপ্ত পদচারণায় ও উদ্দীপ্ত স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। লক্ষ্য ছিল অদূরে বিধানসভা ভবনে শীতকালীন অধিবেশনে উপস্থিত সরকার পক্ষের প্রতিনিধিদের কাছে বঞ্চনাজনিত ক্ষোভকে পৌঁছে দেওয়া। সংগ্রামী মেজাজে উদ্বেলিত অথচ সুশৃঙ্খল এই গণ সমাবেশকে আটকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকর্মীদের একাংশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের নির্দেশে মারমুখী হয়ে ওঠে। সাদা পোশাকে পুলিশবাহিনী রেয়াত করেনি অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী-শিক্ষকদেরও। আকাশবাণী ভবনের সামনে অশীতিপর অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে রাস্তায় ফেলে লাঠি পেটা করে শাসকদলের তল্পিবাহক বীরপুঙ্গব পুলিশবাহিনী। পুরুষ পুলিশকর্মীরাই মহিলা কর্মচারীদের টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তোলে। মোট ৪৭ জন কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ও শিক্ষককে লালবাজারে লকআপে সারা রাত রেখে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে একজন সদ্যোজাত শিশুর মাও ছিলেন। আক্রমণকারীরাই আক্রান্ত সেজে বিভিন্ন জামিন অযোগ্য ফৌজদারি ধারায় মিথ্যা মামলা সাজায়। বৈদ্যুতিন মাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে রাজ্য সরকারের এই প্রতিহিংসামূলক আচরণের সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই সারা রাজ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, যার প্রতিফলন ঘটে পরের দিন অর্থাৎ ২৪ নভেম্বর ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সামনে দিনভর জমায়েত ও বিক্ষোভে। রাজ্য সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণ রূপ আরও প্রকট হয় যখন রাজ্য সরকারের কৌঁসুলি বন্দিদের তিনদিনের পুলিশ হেফাজতের আরজি জানায়। গ্রেপ্তার হওয়া কর্মচারী-শিক্ষকদের পক্ষে আদালতে সওয়াল করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। তাঁকে সহযোগিতা করেন এক ঝাঁক প্রগতিশীল আইনজীবী। আদালতে সওয়াল জবাব চলাকালীনও এজলাসের বাইরে আদালত চত্বর বন্দিদের মুক্তির দাবিতে মুখর হয়, মুহুর্মুহু সরকারবিরোধী স্লোগান ওঠে। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট ৪৭ জনকেই শর্ত সাপেক্ষে অন্তর্বর্তী জামিন দিয়েছেন। জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হবে পরবর্তী শুনানি। সারাদিন ধরে অপেক্ষারত কর্মচারীরা সহযোদ্ধাদের মুক্তির পর বিজয় মিছিল করে নব মহাকরণ চত্বরে যান এবং সেখানে তাঁদের সংবর্ধিত করেন। সেখানে যৌথ মঞ্চের আহ্বায়ক বিজয় শঙ্কর সিনহা আবেগদীপ্ত বক্তব্য রাখেন।

তৃণমূল সরকারের এই ন্যক্কারজনক ভূমিকায় স্তম্ভিত সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। যৌথমঞ্চের পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার দমনপীড়ন করে হকের লড়াইকে থামাতে পারবে না। আগামী দিনের আরও বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে ওইদিন থেকে।