৬০ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ২ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
এইখানে একটি শহর ছিল
মানব মুখার্জি
ঠিক তখনই সাইরেন বেজে উঠলো। বিকেল চারটে বাইশ। ডালহৌসি স্কোয়ারের অফিসগুলো সবে ভাঙতে শুরু করেছে। এসপ্ল্যানেড জুড়ে থিক্থিক্ করছে মানুষ। বাস আর মিনিবাসের জটলা। গোটা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ জুড়ে জ্যাম। ইস্টবেঙ্গল মাঠে ৩০ হাজার লোক। আইএফএ শিল্ডের কোয়ার্টার ফাইনাল। কলকাতায় শরতের বিকেল। ঠিক তখনই সাইরেন বাজলো।
গত তিন দিন ধরে খবরের কাগজে বাইরের কোনো খবর আসেনি। চারদিন আগের কাগজে জানা গিয়েছিল - পশ্চিম জার্মানির সীমান্ত বরাবর মার্কিন বাহিনী পূর্ব জার্মানিতে ঢুকছে। জার্মানরা বাধা দিচ্ছে আপ্রাণ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণকারী আখ্যা দিয়ে প্রস্তাব ১৫১-৪ ভোটে গৃহীত হয়েছে। সম্পাদকীয়গুলোতে বলা হয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। প্রথম পৃষ্ঠায় রোনাল্ড রেগানের বক্তৃতা - কেউ না চাইলেও আমরা পৃথিবীতে গণতন্ত্র রক্ষা করবই। দক্ষিণ আফ্রিকায় এএনসি-র বাহিনী প্রিটোরিয়া ঢুকছে, বোথা পালিয়েছে, হন্ডুরাস সীমান্তে নিকারাগুয়ান বাহিনী মার্কিন আক্রমণ রুখছে। তারপর থেকে গোটা পৃথিবীর কোনো খবর আর আসেনি যোগাযোগ রক্ষাকারী উপগ্রহগুলো চুপ। আন্তর্জাতিক ট্রাঙ্ককল আর টেলিপ্রিন্টারে কোনো আওয়াজ নেই। গত দু’দিনে একটাও যাত্রী বিমান ভারতের কোথাও নামেনি। শেষ যে বিমানটি লন্ডন থেকে দিল্লিতে এসে নেমেছে দু’দিন আগে, তার যাত্রীরা বলেছে লন্ডনে ব্ল্যাক আউট চলছে, দলে দলে লোক পালাচ্ছে গ্রামের দিকে। প্লেনটা এসেছে আফ্রিকার ওপর দিয়ে, রোমে নামার কথা ছিল, নামেনি। আর যাত্রীরা নাকি প্লেনে উঠবার আগে গুজব শুনেছে পোল্যান্ডের ওয়ারশতে অ্যাটম বোমা পড়েছে। ঠিক তখনই সাইরেন বাজলো। গতকাল রেডিয়ো আর টিভিতে বলা হয়েছে, সবাই যেন যুদ্ধকালীন সতর্কতা মেনে চলে। সাইরেন বাজলে কী কী করতে হবে সেটাও বিষদভাবে বলা হয়েছে, খবরে সরকারের বক্তব্যে বলা হয়েছে - আমাদের দেশ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও, আমাদের ওপর যে কোনো ধরনের আক্রমণ চলতে পারে। অফিসগুলোতে কাজকর্ম প্রায় বন্ধ। সারাদিন উত্তেজিত আলোচনা। বাংলাদেশ টিভি-তে নাকি বলেছে গোটা ইয়োরোপে তুমুল যুদ্ধ চলছে। অ্যাটম বোমা পড়েছে চীনেও। ঠিক তখনই সাইরেন বাজলো।
ঊর্ধ্বশ্বাসে এসপ্ল্যানেডের মানুষ ছুটছে মেট্রোরেল স্টেশনের দিকে। বাসগুলো পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে একটা ডাবল ডেকার বাস অন্তত কুড়ি জন ছুটন্ত লোকের ওপর দিয়ে ছুটে গেলো। পেছন থেকে আসা একটা মিনিবাস ফুটপাথের ওপর লাফিয়ে উঠে ধাক্কা মারল দোকানে। মানুষ ছুটছে প্রাণভয়ে। ছুটন্ত ভিড়ের চাপে ইস্টবেঙ্গল মাঠের উত্তর দিকের কাঠের গ্যালারি মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। চাপা পড়ল কয়েক’শ মানুষ। ডালহৌসি স্কোয়ারের রাস্তা থেকে মানুষ ছুটছে অফিসবাড়িগুলোর দিকে। তখন বিকেল ৪টে ২২মিঃ। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে বাচ্চাদের একটা স্কুলের বাস ছেড়ে ড্রাইভার পালিয়েছে মেট্রোরেল স্টেশনের দিকে। বাচ্চাগুলো তারস্বরে কাঁদছে, বাস থেকে নামতে ভয় পাচ্ছে। সাইরেন, অসংখ্য গাড়ির হর্ণ, মানুষের চিৎকার।
বিকেল ৪টা তেইশ
কোন্ জাদুকরের যাদুমন্ত্রে হঠাৎ থেমে গেল সাইরেন, কোনো হর্ণের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। ডালহৌসিতে অফিসের একতলার ঘরে আপনারা সহকর্মীরা লুকিয়ে ছিলেন, ট্রানজিস্টার চালানো ছিল, সেটাও হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ছুটন্ত মানুষেরাও কেউ কেউ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন - তাহলে কি বিপদ কেটে গেছে? শুধু আপনার কোনো এক সহকর্মী, যিনি যুদ্ধের ব্যাপারে অনেক পড়াশুনা করেছেন, পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘বোমা পড়ছে’, ‘অ্যাটম বোমা পড়ছে’। ‘ইলেকট্রা-ম্যাগনেটিক পালস্' শুরু হয়ে গেছে।
বিকেল চারটে তেইশ মিনিট ছ’সেকেন্ড
কলকাতায় সূর্য উঠছে। জোব চার্নকের কলকাতায় সূর্য উঠছে। ‘মিছিল-নগরী’, ‘মৃত নগরী’ কলকাতায় সূর্য উঠছে। জীবনানন্দ দাশের কলকাতায় সূর্য উঠছে। একসাথে পাঁচ হাজার সূর্য।
নৈহাটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মঃ বিকেল চারটে তেইশ মিনিট ছ’সেকেন্ড।
দক্ষিণ দিকে হঠাৎই আলো বেড়ে উঠল। পশ্চিমে তখনও সূর্য আছে। বিস্মিত মানুষ তাকিয়ে আছে দক্ষিণ দিকে। প্রচণ্ড এক আলোর ঝলক, তারপরই সব অন্ধকার। কেউ চোখে দেখতে পাচ্ছে না। আতঙ্কিত মানুষ। মেয়েরা প্রাণভয়ে চেঁচাচ্ছে। মাটিতে ভয়ে বসে পড়ে চোখ লুকিয়েছে কেউ কেউ। মাটিতে হাত রেখে বোঝা যাচ্ছে, মাটি কাঁপছে। আর এক বুক কাঁপানো গুম-গুম আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই আওয়াজ বাড়তে বাড়তে হঠাৎ থেমে গেল। কানে অসহ্য যন্ত্রণা। কানে হাত দিয়ে মানুষ বুঝল কান ফেটে গেছে।
ডালহৌসি স্কোয়ারঃ চারটে বাইশ মিনিট বারো সেকেন্ড
আপনি, আপনার অফিস, আপনার সহকর্মীরা, ডালহৌসি স্কোয়ার, ধর্মতলার মোড়, এসপ্ল্যানেড নেই। দিন চারেক পরে প্রথম যে উদ্ধারকারী দলটি এখানে ঢুকবে, তারা দেখবে গোটা অঞ্চল জুড়ে একটা গহ্বর। যার শেষ কোথায় তা খালি চোখে দেখা দুষ্কর। মেপে দেখবে অন্তত দু’শো মিটার গভীর। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বলবে এখানে একটি ১০ মেগাটন হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণে উত্তাপ উঠেছিল অন্তত ১ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সূর্যের কেন্দ্রের উত্তাপের চেয়েও চারগুণ বেশি। আপনি মিলিয়ে গেছেন। কয়েক হাজার ডিগ্রি সেন্ডিগ্রেডে পৃথিবীর কঠিনতম ধাতুটিও গলে যায়। আপনি স্রেফ বাষ্পীভূত হয়ে গেছেন, গোটা ডালহৌসি স্কোয়ার বাষ্পীভূত হয়ে গেছে। কিছুই নেই যা অতীতের স্মৃতি বহন করতে পারে। সেই ছুটন্ত মানুষগুলো নেই, নিউ মার্কেট নেই, মেট্রো সিনেমা নেই, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম নেই। নেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। নেই পার্ক স্ট্রিটের মোড়ের স্কুলের বাসটি।
শ্যামবাজারঃ চারটে বাইশ মিনিট বারো সেকেন্ড
আপনার বোন ছিল সিনেমা হলে। হঠাৎ সমস্ত আলো নিভে গেছে কয়েক সেকেন্ড আগে। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। কে যেন তারস্বরে চেঁচাচ্ছে কেউ বাইরে বেরোবেন না। কেটে গেছে কয়েকটা সেকেন্ড। তারপর হঠাৎ যেন অন্ধকার হলটা আলোকিত হয়ে উঠল এক প্রচণ্ড ঝলকে। বাইরে একটা গুম গুম করে আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে। আর থাকা যায় না ভেতরে। কতগুলো মানুষ জোর করে বেরিয়ে এল বাইরে, তারমধ্যে আপনার বোনও আছে। গোটা আকাশটা একটা আগুনের পিণ্ড হয়ে গেছে। বাজ পড়ার মতো আওয়াজে পেছনে সিনেমা হলটা ভেঙে পড়ল। হাওয়ার উত্তাপে ঝলসে যাচ্ছে গায়ের চামড়া। জামা কাপড়ে আগুন ধরে যাচ্ছে। ঝড় বইছে, মানুষ কখনো সেই ঝড় দেখেনি। বোমাটি ফেটেছিল রাজভবনের ৭ হাজার মিটার ওপরে। শ্যামবাজারে তখন ঝড় বইছে ঘণ্টায় চারশ’ কিলোমিটার বেগে। ঝড় আগুনের ঝড়। ঝড়ে যাতে উড়িয়ে নিয়ে না যায় আপনার বোন তাই একটি লাইট পোস্ট জড়িয়ে ধরল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আগুনের ঝড় এসে তার জিভ দিয়ে সব কিছু চেটে নিয়ে যাবে। যদি কেউ তার আগের দৃশ্যটি দেখতে পায়, তবে সে দেখবে - প্রচণ্ড ঝড় আপনার বোনের দেহটিকে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে নিয়ে গেল। তার আগেই অবশ্য উত্তাপে তার দেহের গভীরতম অংশগুলো পুড়ে খাক হয়ে গেছে।
ঢাকুরিয়াঃ চারটে পঁচিশ মিনিট
আপনার বাড়ি। আপনার ছোটো ছেলে ও মেয়েটি তখনই স্কুল থেকে ফিরেছে। সাইরেনের আওয়াজ শোনা মাত্র আপনার স্ত্রী ঊর্ধ্বশ্বাসে দুটো বাচ্চাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে পাশের বাড়ির ব্যাঙ্কের লকারে। লোহার দরজা বন্ধ করে দিলে এটা সবচেয়ে ভাল সেন্টার। একটা ঘুপচি ঘরে অন্তত ২৫ জন মানুষ। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। বাচ্চাগুলো ভয়ে নীল হয়ে গেছে, চেঁচাতেও পারছে না, শুধু ফোঁপাচ্ছে। মাটির নিচে গুম গুম আওয়াজ। মাটি কাঁপছে প্রচণ্ড জোরে। মনে হচ্ছে ঘরটাকে দু’হাতে ধরে কেউ যেন ঝাঁকাচ্ছে। ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে। নিভে গেছে বালব্টা, নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। হঠাৎই বাইরে দরজায় কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। দরজা কেউ খুলতে যাচ্ছে না। বাইরে পরিত্রাহীভাবে কেউ চেঁচাচ্ছে। ‘বাঁচাও, বাঁচাও, জ্বলে গেলাম’। গলা শুনে মনে হচ্ছে কোনো কিশোরী। আস্তে আস্তে চিৎকার স্তিমিত হয়ে আসে। কে যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে ঘরের মধ্যে। বোঝা যায় বাইরের কণ্ঠস্বর আর কোনদিনও কথা বলবে না। আর মনুষ্যত্ব কাউকে এখন দরজা খুলতে পাঠাবে না। লকারের দরজার তলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের আগুনের রেখা। ভিতরের বাতাস গরম হয়ে যেন ফুটছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কেউ চেঁচাচ্ছে - ‘দরজা খুলে দাও, নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’ দু’একজন ছুটে গিয়ে দরজাটা ধরে টানছে। দরজা খুলছে না। বাইরের থেকে লোহা গলে আটকে যাচ্ছে। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে এখানে ২ জন মানুষ দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। তার মধ্যে আপনার স্ত্রী, আপনার শিশুপুত্র আর কন্যা। আগুনের ঝড় তার খিদে মেটাতে সম্ভাব্য সমস্ত অক্সিজেনকে টেনে নেবে। সেন্টারে থাকা সব মানুষ দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
ডায়মন্ডহারবারঃ বিকেল চারটে ছাব্বিশ
আপনার বড় ছেলে কলেজের ফিজিক্সের ছাত্র। তারা দল বেঁধে গিয়েছিল পিকনিক করতে। সামনে প্রশস্ত গঙ্গার বুক থেকে প্রায় সাইরেনের আওয়াজ উঠে এলো। ফিজিক্সের ছাত্র তারা। তারা জানে এরপর কী করতে হয়। কান চেপে তারা শুয়ে পড়ল মাটিতে উপুর হয়ে। সাইরেন হঠাৎ বন্ধ। এক মিনিটের মধ্যে এক প্রচণ্ড ধাক্কায় মাটি যেন ছিটকে উঠল। কোনো এক দুর্ভাগার চোখ পড়ল উত্তরে। উত্তরের আকাশ জুড়ে তখন বাসুকি মাথা তুলছে। অন্তত ১৫ কিলোমিটার উঁচু। অ্যাটোমিক মাশরুম আকাশের দিকে থাবা বাড়াচ্ছে। সেই বিপুল মেঘের প্রান্তগুলোতে বিপুল আয়তনের বুকে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। মাটি কাঁপছে থরথর করে, গুমগুম আওয়াজ। বাষ্পীভূত কলকাতা এখন ভয়ঙ্কর অজগরের ফনার মতো গোটা আকাশকে গ্রাস করছে। এক মুসলমান মাঝি উত্তরের দিকে তাকিয়ে হাটু গেড়ে আল্লার দোয়া মাঙছে। কে যেন চেঁচালো। বাঁচতে চাইলে জলে লাফ দাও। ‘ফায়ার স্টর্ম’ আসছে। উত্তাল সাগরের মতো ঢেউ তুলে গঙ্গা তখন ছুটে চলেছে উত্তরের দিকে। আর উত্তরের দিকের আকাশ ছেয়ে আগুন ধেয়ে আসছে। ডায়মন্ডহারবার - বিকেল চারটে ছাব্বিশ। কলকাতা তখন শেষ।
বেলঘরিয়াঃ বিকেল চারটে বত্রিশ
কাগজের মতো স্টেশনের ছাউনিটা উড়ে চলে গেলো। একটা জ্বলন্ত লোকাল ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে পুড়ছে, ড্রাইভারের লাশটা অর্ধেক ঝুলছে কেবিনের বাইরে, বেচারা এক ছুটে ট্রেনটাকে নিয়ে এলেও বাঁচাতে পারেনি। স্টেশনের বাঁদিকের তিন তলা বাড়িগুলো ভেঙে পড়ছে খাপড়ার চালের মতো। ঝড় না আগুন? না, একসাথে আগুনের ঝড় বয়ে যাচ্ছে বেলঘরিয়ার ওপর দিয়ে। চারিদিকে কেবল ধ্বংসের শব্দ। ভেঙে পড়ছে বাড়ি, উড়ে যাচ্ছে চালা, আর চারিদিকে আগুন। ভাঙাচোরা স্তুপ থেকে দু’একটা মানুষ বেরিয়ে আসছে। ওরা এককালে মানুষ ছিল। গায়ের থেকে চামড়া পুড়ে আলাদা হয়ে ঝুলছে। চুলগুলো পুড়ে গোটা মাথাটাকে বিকৃত করে দিয়েছে। যারা বেরিয়ে আসছে, কেন বেরিয়ে আসছে কেউ জানে না। দু’এক পা হেঁটে আবার পড়ে যাচ্ছে এবং সেই পড়াটাই শেষ পড়া। জীবনের শেষ চিহ্ন হিসাবে কারুর মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠে আসছে।
ভবিষ্যতে বিশেষজ্ঞেরা লিখবে এই জনপদটি শেষ হয়ে গেলো তার কারণ ব্রাস্ট ওয়েভ বা বিস্ফোরণের ধাক্কা, ফায়ার স্টর্ম বা আগুনের ঝড়, আর তেজস্ক্রিয়তার তাৎক্ষণিক কারণে।
বর্ধমানঃ সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট
ছেলেগুলোকে ধরাধরি করে মাঠ থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে। ওরা দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে ছিল বিকেল ৪টা ২৩ মিনিটে। ওরা চোখে দেখতে পারছে না। গোটা বর্ধমান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দেখেছে দক্ষিণ দিকে ওঠা বাসুকির ফণাকে। সেই বিপুল কালো মেঘ এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা আকাশে। ঝোড়ো হাওয়া বইছে বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে। দক্ষিণের আকাশ আগুনের মতো লাল আর ক্রমাগত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বর্ধমানের ঘরে ঘরে কান্নার রোল, যারা অফিস করতে কলকাতায় গিয়েছিল তারা আর কেউ ফিরবে না, এটা সবাই বুঝেছে। আকাশ থেকে ঝড়ের সাথে নামছে মিহি কালো ছাই। অসহ্য মাথায় যন্ত্রণা, গা গোলাচ্ছে, কেউ কেউ বমি করছে। রক্ত আমাশা শুরু হয়ে গেছে অনেকের। হাসপাতালের ডাক্তাররা পাগলের মতো মেডিক্যাল জার্নাল হাতড়াচ্ছে। শুরু হয়ে গেছে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব, এ সারাবার ওষুধ বর্ধমান শহরে নেই। ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ল্যাবোরেটরিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মাস্টারমশাইরা। ইতিমধ্যেই যন্ত্রের কাটা ৫০০০ রাড ছুয়েছে। আতঙ্কিত অধ্যাপকদের চোখের সামনে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ৫০০০ রাড ছাড়িয়েছে দু’ঘণ্টার মধ্যে। দ্রুতগতিতে কাঁটা উঠছে ৬০০০ রাডের দিকে। ৬০০০ রাড মানে নিশ্চিত মৃত্যু। পুলিশের গাড়িগুলো নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে পাগলের মতো ছুটছে। মাইকে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, কেউ বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। অন্ধকার, জনমানব শূন্য বর্ধমানের পথে এখন অদৃশ্য মৃত্যুরশ্মি ‘গামা’ এক খেলা করছে। বাড়বে, সময়ের সাথে সাথে এই তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা আরও বাড়বে। আর নিশ্চিত থাবায় মৃত্যু মানুষগুলোকে টেনে নেবে। এবার বমির সাথে সাথে রক্ত উঠছে কারো কারো। অসহ্য হাত পা খিঁচুনি, থার্মোমিটারের পারার থেকেও দ্রুতগতিতে জ্বর উঠছে। ভেতরের পাকস্থলিটা ইতিমধ্যেই কারো কারো তালগোল পাকিয়ে দগদগে ঘায়ে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালে আগে থেকেই ভর্তি ছিল যেসব রোগী তাদের মধ্যে থেকে মৃত্যুর প্রথম শিকার ধরছে। ডাক্তাররা মৃত্যুর কারণে লিখছে - সেরিব্রাল ডিসঅর্ডার, সাডেন ফল অব ব্লাড প্রেসার। অভিজ্ঞ ডাক্তাররা বুঝছেন ইতিমধ্যেই ফুসফুসে ফ্লুইড জমতে শুরু করেছে। কারো কারো নাক মুখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। বাড়িগুলো থেকে কান্নার রোল ঘনঘন উঠছে, মারা যাচ্ছে সদ্যোজাত শিশু আর বৃদ্ধরা। এই শুরু। এমন সময় বৃষ্টি নামলো।
পুরুলিয়াঃ ঝালদায় সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিট
বৃষ্টি নেমেছে। খরার জেলা পুরুলিয়ায় বৃষ্টি নেমেছে। অন্ধকারে বৃষ্টি দেখা যায় না। হ্যারিকেনের আলোয় সাদা কাপড়ে বৃষ্টির ছাট দেখা যাচ্ছে কুচকুচে কালো। ব্ল্যাক রেইন। কালো বৃষ্টি। ভস্মীভূত রাজধানী এখন বৃষ্টি হয়ে গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। সে ছড়িয়ে পড়ছে প্রেতের মতো, সঙ্গে তেজস্ক্রিয়তাকে নিয়ে। বাইরে কুকুরগুলো অদ্ভুত গলায় কাঁদছে। অসম্ভব মাথা ধরছে, গা গোলাচ্ছে, বমি করছে কেউ কেউ। বাইরে পথে চলছে তাণ্ডব। লুট হচ্ছে দোকান-পাট। মুখ্যত লুট হচ্ছে খাবারদাবারের দোকান। সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত মানুষটিও চাল লুট করে ঘরে লুকাচ্ছে। সবাই বুঝেছে আসছে, সর্বনাশ আসছে, আর কিছু পাওয়া যাবে না। ধ্বংসের মুখে মানুষ তার মনুষ্যত্ব ভুলে যাচ্ছে। হাসপাতালে ডাক্তার নেই, তারা প্রাণভয়ে গাড়ি নিয়ে বিহারের দিকে পালিয়েছে।
বহরমপুরঃ ১ সপ্তাহ পরে
এখানে দিনরাত পাড়ার ছেলেরা হাতে লাঠি নিয়ে পাহারা দেয়, যাতে লুটপাট শুরু না হয়। সাত দিনে এখানে এক ট্রাক গম ছাড়া কোনো রিলিফ আসেনি। যা আসছে শিলিগুড়ি ঘুরে। মানুষ ক্রমশ শাকপাতা যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে। হিন্দু পাড়ায় মহোৎসবের মতো করে গ্রাম থেকে লুট করে আনা একটা শীর্ণ গোরুকে কাটা হয়েছে, মাংস কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ, এখন অবশ্য তাদের মানুষ বলে চেনার উপায় নেই, ঢুকছে শহরে। এরা নাকি কেউ কেউ প্রায় কলকাতা থেকে হাঁটছে। স্রোতের মধ্যে থেকে মানুষগুলো কেউ কেউ মরছে। লাশ পড়ে থাকছে পথে, কেউ একবিন্দু দাঁড়িয়ে শোক প্রকাশও করছে না। নরকের থেকে আসা মিছিলের মতো মানুষগুলো আসছে। মাঝে মাঝেই দাঙ্গা বাধছে শহরের লোকের সাথে - এরা আশ্রয় চায়, খাবার চায়, আর শহরের মানুষ নিজেদের যেটুকু আছে রক্ষা করতে চায়। মানুষ মরছে, মরছে মানুষ হিসাবে না, সংখ্যা হিসাবে। আপাদমস্তক কাপড়ে মুড়ে মিউনিসিপ্যালিটির যেসব লোক লাশগুলো ঠেলা গাড়িতে চাপিয়ে তুলে নিয়ে যায়, তারা এ ডিউটি শেষ করে গিয়ে রিপোর্ট লেখায়, রাস্তা থেকে ক’টা লাশ তুলেছে। মানুষের মৃত্যুর পরিচয় এখন কেবল সংখ্যায়।
গত সাত দিন ধরে সূর্য ওঠেনি। আকাশটা থমথমে। মাঝে মাঝে শুধু আচমকা ঝড় ওঠে। মানুষ বুঝে গেছে, বৃষ্টি নামলেই ঘরে গিয়ে লুকোয় জন্তুর মতো, এক ফোঁটা বৃষ্টি যেন গায়ে না পড়ে। হাসপাতালে রোগীর ভিড়। ডাক্তার আছে, বেড নেই, ওষুধ নেই, মানুষগুলো অসহায় পশুর মতো তাকিয়ে থাকে ডাক্তারদের দিকে। এই নরকের সাম্রাজ্যে ডাক্তাররাই একমাত্র দেবদূত। অসহায় ডাক্তারদের হাতে একটা কিছু নেই যা দিয়ে চিকিৎসা করা যায়। একজন অসহায় ডাক্তার ইতিমধ্যে আত্মহত্যা করেছে। সারা দিনে একবার করে গোটা হাসপাতাল চত্বর থেকে লাশ পরিষ্কার করা হয়। পোড়া ঘায়ের গ্যাংগ্রিনের গন্ধে গোটা বাতাসটা অসহ্য ভারী হয়ে থাকে। রোগীরা পড়ে থাকে নিজের নোংরার মধ্যে, অপেক্ষা করে কখন মৃত্যু এসে যন্ত্রণা শেষ বলে ঘোষণা করবে। মানুষ তাও বাঁচতে চায়, আপ্রাণ বেঁচে থাকতে চায়।
গ্রাম থেকে দলে দলে শহরে চলে আসছে। খেতের ধান সব ঝরে গেছে। গাছপালা থেকেও পাতা ঝরে গেছে। কালান্তক যমের মতো দুর্ভিক্ষ আসছে।
চুল উঠে যাচ্ছে মানুষের। যারা হাসপাতালে যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। মারাত্মক গামা রশ্মি আর নিউট্রন রক্তে লাল কণিকার সংখ্যা বাড়তে দিচ্ছে না। লিউকোমিয়া - রক্তের ক্যানসারের প্রথম ধাপ। হাতের নখ নীল হয়ে যাচ্ছে, খয়ে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে নখের জায়গায় ফুটে বেড়োচ্ছে দগদগে সবুজ রঙের ঘা। চামড়া জন্ডিস হওয়ার মতো হলুদ হয়ে যাচ্ছে, লোম সব পড়ে যাচ্ছে। রাস্তার কুকুরগুলো যেন নরকের জীব। মাড়ি থেকে রক্ত পড়ছে সবারই প্রায়। অনেকেই দিনের আলোয় চোখে কিছু দেখতে পায় না, এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আলট্রাভায়োলেট রশ্মিই নাকি এর কারণ। মানুষ অসহিষ্ণু, কথায় কথায় ছুরি আর রড বেরোচ্ছে। কেউ কেউ পাগল হয়ে গেছে, রেডিয়ো চলে না, আলো জ্বলে না।
উদ্বাস্তুরা খবর দিয়েছে গোটা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের দু’পাশে নাকি অসংখ্য লাশ পচছে। সৎকার করার লোক নেই, এমনকী শেয়াল বা শকুনও নেই। একমাত্র বেঁচে আছে আরশোলা। সেগুলোও অন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু তখনও বংশবিস্তার করছে।
বিস্ফোরণের এক মাস পরে
হয়তো যুদ্ধ থেমে গেছে। হিসাবপত্র করে জানা গেছে অন্তত ২৫ লাখ লোক কলকাতায় মরেছে। এদের মধ্যে ১০ লাখ ১১ সেকেন্ডের মধ্যে বাস্পীভূত হয়ে গেছে। যাদের দেহ সৎকার করার দরকারই হয়নি। বাকি ১৫ লাখ পড়ে। এখনও গোটা হিসাব আসেনি। যারা পালিয়ে গিয়েছিল তাদের একটা বড়ো অংশ পরে মরবে। বাংলাদেশ রাইফেলসের গুলিকে অগ্রাহ্য করে একটা অংশ বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। গুলি খেয়ে মরেছে অনেকে। গ্রামের দিকে যারা মরেছে তাদের সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। আরও কয়েক লাখ বাড়বে প্রাথমিক মৃত্যুর সংখ্যা। আর বর্ধমান বা মালদা বা শিলিগুড়িতে এখন মৃত্যুর ঢেউ আসবে। রক্তের ক্যানসার - লিউকোমিয়া, হাড়ের ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার, শুকনো ঘাসে দাবানল যেভাবে ছড়ায় সেভাবে ছড়াবে গোটা পূর্ব ভারত আর বাংলাদেশে। ক্যানসার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১৫ জনকে মৃত্যুর খাজনা হিসাবে তুলে নেবে।
হয়তো আবার মানুষ ঘর বাঁধবে। কিন্তু কাদের জন্য? আগামী এক শতাব্দী ধরে এখানে বিকৃত শিশুর জন্ম হবে। ধ্বংস হয়ে গেছে অধিকাংশ খেত, ফসল ঝরে গেছে। শুধু তাই নয়, বহুদিন পর্যন্ত এই খেতে চাষ হবে না। আসবে দুর্ভিক্ষ, মহামারী। এখানে মৃত্যু বেশ কিছু দশক ধরে স্থায়ী বাসা বাঁধবে। আর যতই অপ্রিয় একথা, হিরোসিমা প্রমাণ করেছে এক শতাব্দী পরেও এই অঞ্চলের শিশুরা অনেক কম বুদ্ধি এবং কম শারীরিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে।
আর কলকাতা? সভ্যতা যদি টিকে থাকে, তবে এখানে শহিদ স্তম্ভ বসবে। লেখা থাকবে - ‘‘এইখানে একসময় কলকাতা বলে একটি শহর ছিল। এইখানে মানুষরা এক সময় দেশের জন্য প্রাণ দিত। নিকারাগুয়ার শিশুদের জন্য প্রাণ কাঁদত এই শহরটার, ভিয়েতনামের জন্য এই শহরটা রক্ত দিয়েছিল। অনেক অপমান, অনেক বঞ্চনা সত্ত্বেও এই শহরটা বেঁচে ছিল। অনেক ক্ষুদ্রতার মধ্যেও এই শহরটা মহান ছিল। এই শহরটা বাঁচতে চেয়েছিল।’’
আমাদের শহিদ স্তম্ভের পাশে কোনো ঘাস উঠবে না। এক শতাব্দী ধরে কোনো পাখি গান গাইবে না। একটাও প্রজাপতি উড়বে না। সযত্নে উড়ন্ত এরোপ্লেনগুলো এই আকাশ এড়িয়ে যাবে। গঙ্গার জল হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত জল। এইখানে একটা শহর ছিল, এখন নেই; কিন্তু থেকে গেছে মৃত্যুর রশ্মিগুলো।
● ● ●
এইখানে একটা শহর ছিল। এইখানে একটা শহর থাকবে। চিরকাল তার মানুষ তাদের সুখ-দুঃখ, ভাব-ভালবাসা, সংস্কৃতি নিয়েই থাকবে। কলকাতা শেষ হতে পারে না। পৃথিবী শেষ হতে পারে না। কিন্তু যদি মস্কো, লন্ডন, বার্লিন বা প্যারিস না থাকে তবে কলকাতাও থাকবে না। আলাদা করে বাঁচার কোনো পথ নেই। যারা গোটা পৃথিবীর মতো কলকাতাকেও ধ্বংস করতে পারে সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে হবে গোটা দুনিয়া জুড়ে। ওদের হাতে অস্ত্র থাকতে পারে। কিন্তু মানুষ ওদের বিপক্ষে আর সচেতন মানুষই সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। ১লা সেপ্টেম্বর গোটা পৃথিবী পথে, নামবে যুদ্ধ ঠেকাতে, আমাদেরও নামতেই হবে। এই মিছিলই ভবিষ্যতের অন্যতম গ্যারান্টি। মিছিলে নামতে হবেই, কারণ আমাদের নিজেদের, আমাদের কলকাতাকে বাঁচাতেই হবে।
[গোটা লেখাটাই কাল্পনিক। এখনও এরকম কোনো সমীক্ষা হয়নি - কলকাতায় একটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ হলে কী হবে। তবে বিদেশের অন্য শহর নিয়ে এই সমীক্ষা হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করেই এই লেখাটি।]
___________________________________
প্রয়াত কমরেড মানব মুখার্জির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই নিবন্ধটি পুনঃমুদ্রিত হলো। নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘গণশক্তি’ পত্রিকায়।
- দেশহিতৈষী