৬০ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ২ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
প্রজাতন্ত্র অথবা নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র
নীলোৎপল বসু
ইউজিসি’র চেয়ারম্যান ইতিমধ্যেই তোপ দেগে দিয়েছেন। গোলওয়ালকর - সাভারকরের পরীক্ষাগার থেকে উৎক্ষিপ্ত ‘ইতিহাসবিদ’রা ফরমায়েশি ইতিহাস লিখেছেন। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিকাল রিসার্চ-এর এই সংকলনটির নাম ‘ভারতঃ গণতন্ত্রের জননী’। তিরিশটি প্রবন্ধের এই সংকলনকে হাতিয়ার করে ইউজিসি চেয়ারম্যানের বজ্রনির্ঘোষ। প্রাচীন ভারতের অর্থাৎ বৈদিক যুগের ৫০০০ সালের আগে থেকেই ভারতে নাকি গণতন্ত্র রয়েছে! আর ভারতের সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও প্রজাতন্ত্র পরিত্যাজ্য! জনতন্ত্র শব্দটি নাকি ভারতের ক্ষেত্রে ইতিহাসসম্মত হবে।
দীর্ঘ স্বকপোলকল্পিত ব্যাখ্যার মধ্যে ওই সংকলনটি গেছে এবং যেটি পরিবেশনা করেই ইউজিসি-র চেয়ারম্যান বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপালদের ভারতঃ গণতন্ত্রের জননী এই শীর্ষক সংকলনটি পাঠিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংক্রান্ত সেমিনার আয়োজন করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এই লেখার প্রতিপাদ্য ইউজিসি-র চেয়ারম্যানের সংবিধানবিরোধী ইতিহাস বিকৃতির পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা নয়। কিন্তু ওই উদ্যোগের প্রাসঙ্গিকতা ভারতের গণতন্ত্রের হালহকিকত বুঝতে।
পৃথিবী জুড়েই ভারতের গণতন্ত্রের দুরবস্থা নিয়ে একাধিক তীব্র সমালোচনা প্রকাশিত হচ্ছে। মূল স্রোতের সংবাদমাধ্যমেও। ২৭ নভেম্বর গার্ডিয়ান পত্রিকায় এইরকম একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রধান প্রতিপাদ্য ভারতে যেভাবে শাসক সরকারের উদ্যোগে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে, তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। স্পষ্টতই এসবের জবাব সরকার বা বিজেপি-আরএসএস’র কাছে নেই। তাই প্রতিক্রিয়া জানাতে নরেন্দ্র মোদিকেই কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিতে হয়েছে। ১৫আগস্ট লাল কেল্লার প্রাচীরে দাঁড়িয়ে তাঁর ওই ‘অমৃত বচন’! ‘ভারতঃ গণতন্ত্রের জননী’! আইসিএইচআর-এর সংকলনে সাভারকর-গোলওয়ালকরের ভাবশিষ্যরা লিখছেন প্রাচীন ভারতে নাকি সবাই সমান ছিল। অভিজাততন্ত্র, জন্ম বা রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে কেউই বিশেষ সুবিধা ভোগ করত না। গল্পের গোরু যে গাছেও ওঠে এই বিচিত্র কাণ্ডকারখানা না দেখলে জানা যেত না। বৈদিক আমল থেকেই এই দেশের গণতন্ত্রের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ বর্ণাশ্রম। ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতপাতের বিভাজন। কিন্তু সেটা মেনে নিলে সাভারকর-গোলওয়ালকর কোথায় যাবেন! ব্রাহ্মণ্যবাদ না এলে মনুসংহিতা বা এই ধরনের প্রতিগামী সূত্রগুলোকে কী করে বৈধতা দেওয়া যায়! তাই গণতন্ত্রের প্রবাহকে সজীব দেখাতে গিয়ে সেই সময়ের থেকে আজকের খাপ পঞ্চায়েতের ধারাবাহিকতা জানাতে হয়েছে ইউজিসি-র চেয়ারম্যানকে। আসলে মোদ্দা কথাটা হচ্ছে গণতন্ত্রের উপর স্বাধীনতা-পরবর্তীতে যে তীব্রতম আক্রমণের আমরা সাক্ষী, যে আক্রমণ পরিচালিত করতে গেলে স্বাধীনতার ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত সংবিধানকে অস্বীকার করতে হয়, তারই ‘বৌদ্ধিক’ রসদ জোগানোর কাজটা কাঁধে তুলে নিয়েছে ইউজিসি বা আইসিএইচআর। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অজুহাতে এর গণপ্রচার করবারও জোরদার চেষ্টা শুরু হয়েছে।
।। এক ।।
আসলে বর্তমানে গণতন্ত্রের উপর আক্রমণের প্রধান মতাদর্শগত ভিত্তি হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা বহুত্ববাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, জাতীয় পরিচিতি এবং বৈচিত্র্যের ঊর্ধ্বে উঠে সমান নাগরিকত্বের ধারণাসমৃদ্ধ সংবিধানকেই অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ এই বহুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে হিন্দুত্বকেই আমাদের জাতীয় পরিচিতির ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এই প্রয়াসের সত্যিই কোনো বিকল্প নেই।
।। দুই ।।
কিন্তু এই রকম একটি অনৈতিহাসিক ভিত্তিহীন ইতিহাসপাঠ কোনো গণতান্ত্রিক সমাজেই গ্রহণযোগ্য হবে না। যদি খোলাখুলি বিতর্ক হয়, হিন্দুত্ববাদীরা যে বলে বলে গোল খাবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এই বিতর্ক এবং গণতন্ত্র বিষবৎ পরিত্যাজ্য। বিরোধীদের কথা বলতে দেওয়া যাবে না। রাজনীতিতে, ইতিহাসচর্চায়, বুদ্ধির জগতে। ঘনিষ্ঠ করপোরেটদের নিয়ে স্বাধীন মিডিয়া কিনে নেওয়া, কোটি কোটি টাকা খরচ করে সোশ্যাল মিডিয়ার সাইবার যোদ্ধাদের দিয়ে উত্তর-সত্যের ধারণাকে বাস্তব চেহারা দেওয়া এটা এখন পরিচিত ছবি হয়ে উঠেছে। যে পরিমাণ কর ছাড় বা ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে পরিশোধ না দেওয়াকে সরকার চোখ বন্ধ করে সমর্থন করছে, তারই প্রতিদান মিলেছে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে শাসকদলের আর্থিক সামর্থ্য এতটাই শক্তিশালী যে শুধু ভোটে লড়া নয়, ভোটে হেরে গেলেও বিরোধী দলগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধি কিনে নিয়ে সরকার গঠন করতে পারা। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও, দেশের সংবিধান বা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে দেশের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলিকে শাসকদলের স্বার্থে ব্যবহার করাটাও অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
।। তিন ।।
এই প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে যেমন সংসদের আইনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সিবিআই বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আছে, তেমনি সরাসরি সংবিধানে প্রদত্ত ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি হওয়া নির্বাচন কমিশনও ভীষণভাবে রয়েছে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে একটি স্বাধীন নির্বাচনের গুরুত্ব যত বেশি উল্লেখ করা যায়, সেটাও কম হবে।
বেশ কিছুদিন ধরেই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন উঠছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরেও সরকারিতন্ত্রকে ব্যবহার করেছেন, পুলওয়ামা-বালাকোটের ঘটনাক্রমকে টেনে এনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে নিজের দলের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন, তা নিয়েও নির্বাচন কমিশন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয় নি। ইলেক্টোরাল বন্ড চালু হওয়ার পরে নির্বাচন কমিশনের কাছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষ থেকে বন্ধ খামে করপোরেট চাঁদার হিসেবনিকেশ জমা পরার পরেও কড়ে আঙুল নাড়ায়নি নির্বাচন কমিশন।
সমসাময়িক নির্বাচনগুলির মোটা দাগের পর্যালোচনা করলেও দেখা যাচ্ছে শাসক দলের সঙ্গে অন্য সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলের ব্যবধান বিপুলভাবে বেড়ে যাচ্ছে। আর্থিক সক্ষমতা নির্বাচনী গণতন্ত্রের সমান জমিকেই বিকৃত করে দিচ্ছে। আমাদের সংবিধান ৩২৪নং ধারায় নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনকে অবাধ এবং নিরপেক্ষভাবে সংগঠিত করার জন্য সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু এইসব প্রকট বৈষম্যের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণভাবেই নিশ্চুপ।
এটা স্পষ্ট যে, গত আট বছরে, যে করপোরেট বান্ধব নীতি নিয়ে সরকার কাজ করছে, বিশেষ করে কিছু সরকার ঘনিষ্ঠ করপোরেট গোষ্ঠী যে প্রবল পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, তা অর্থ এবং মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নেও তীক্ষ্ণ বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের যে প্রবল স্বাধীনতা এবং অধিকার সংবিধান ন্যস্ত করেছে তা প্রয়োগ করার বদলে, কমিশন বিরোধীদের বিরুদ্ধেই আঙুল তোলার চেষ্টা করেছে।
গণতন্ত্রে একটি মূল ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচিত শাসকদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি বা আরএসএস-বিজেপি ক্রমাগত প্রচারের মধ্যে দিয়ে আমাদের অধিকারকেন্দ্রিক সংবিধানকে নাগরিকের দায়িত্বসমূহ পালন করবার লক্ষ্যে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছে। গত কয়েক বছর করছাড় বাবদ এবং ব্যাঙ্কের ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা ছাড় দেওয়া বাবদ ১১ লক্ষ কোটি টাকা করপোরেটদের দাতব্য করেছে মোদি সরকার। নির্বাচনী গণতন্ত্রে এর তাৎপর্য অপরিসীম। কিন্তু মোদি যুদ্ধ ঘোষণা করছেন মানুষের জন্য জনকল্যাণমূলক সরকারি অনুদানের প্রয়োজনীয়তার বিরুদ্ধে। তাঁর ভাষায় এটা ‘রেওরি’ - অপচয়! মোদি রাজনীতির লোক, রাজনীতি করবে। এটা স্বাভাবিক।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা। তারাও যে ‘বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’ এই ভঙ্গিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইস্তাহারের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সেটা শুধু দৃষ্টিকটু নয় সরাসরি পক্ষপাতদুষ্ট, গণতন্ত্রবিরোধী। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে যেভাবে বিজেপি-কে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে গুজরাটের ভোট পিছিয়ে দিল কমিশন তা তো অভূতপূর্ব। আর বিরোধী দলগুলো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কী দেবে সেটা ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব কি নির্বাচন কমিশনের? এই প্রশ্ন তারা তুলছে সরকারের প্রতিধ্বনি করে।
নির্বাচনী কমিশনের এই ভূমিকা যে যথেষ্ট ব্যাপকভাবেই সবার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তাও স্পষ্ট। সাম্প্রতিককালে সুপ্রিম কোর্ট একটি পিটিশন বিবেচনা করতে গিয়ে যথেষ্ট তীক্ষ্ণভাবেই নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতহীনতার অভাব সম্পর্কে তীর্যক মন্তব্য করেছেন। উচ্চতম কোর্টের প্রশ্ন, নির্বাচন কমিশনার কীভাবে নিযুক্ত হয় সেটার পর্যালোচনা করা দরকার। কারণ নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে যারা সবচেয়ে পুরনো তারাই পরবর্তীতে মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার নিযুক্ত হন। সুতরাং নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্তি যদি শুধুমাত্র সরকারের আওতাভুক্ত হয়, তবে সেই কমিশনের সরকারি দলের প্রতি পক্ষপাত অনিবার্য। কাজেই নির্বাচনী সংস্কার এখন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের একটি জরুরি অ্যাজেন্ডা। আর্থিক শক্তি, পেশি শক্তি, মিডিয়া শক্তি এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনী কমিশন এই চাহিদা হবে এই সংস্কারের আবশ্যিক শর্ত।
।। চার ।।
অনেকেই শুরুতে বুঝতে পারেননি। বিজেপি যে সব অর্থেই দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের থেকে আলাদা তা নিয়ে আর কোনো সংশয় থাকছে না। ২০০০ সালে বিশেষ সম্মেলন থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) যখন তার কর্মসূচিকে সময়ানুগ করে তোলে, তখনই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পৃথিবীর রাজনৈতিক ভারসাম্য যেভাবে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে ঝুঁকে পড়েছে, আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি যে চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং সর্বোপরি যেভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে তাতে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার এই প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। এই প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবেই পার্টির কর্মসূচিতে বিজেপি’র এই বিশেষ চরিত্রের বাস্তবতা উল্লেখ করা হয়। আর এর কারণ বিজেপি যেভাবে আরএসএস দ্বারা পরিচালিত তা আমাদের সংবিধানের চৌহদ্দির মধ্যে পরিচালিত আর পাঁচটি রাজনৈতিক দলের তুলনায় শুধু ভিন্নই নয়, চূড়ান্ত বিপজ্জনক।
আজকের গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ তাই প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে দেশে-দেশান্তরে। প্রশ্ন উঠছে ভারতের গণতন্ত্র কি নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র হয়ে উঠেছে? অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য সাংবিধানিক দায়িত্বে থাকা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের যে অবক্ষয় তা স্বভাবতই জনমাধ্যমে এই মন্তব্যের জন্ম দিচ্ছে যে, এটা গণতন্ত্র না ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’।