৬০ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ২ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
সোজা কথা - রেগা’র বকেয়া মজুরি মেটাও, কাজ দাও
সুপ্রতীপ রায়
দীর্ঘদিন ধরে ১০০ দিনের টাকা বকেয়া। কাজ করে বাংলার গরিব মানুষ মজুরি পাননি এবং ১০০ দিনের কাজও বন্ধ। রাজ্য সরকারের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দিচ্ছে না। আর কেন্দ্রীয় সরকারের অভিযোগ, রাজ্য সরকার হিসাব দিচ্ছে না - তাই টাকা পাঠানো বন্ধ। মাঝখানে বিপদে বাংলার গ্রামীণ মানুষ।
যদিও বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে মুখ্যমন্ত্রীর জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক চলছে। পূজা, ক্লাবের পিছনে, মেলা, খেলায় দেদার অর্থ উড়ছে। অথচ ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সরকার বিকল্প পথে গ্রামীণ গরিব মানুষের অর্থ মেটাচ্ছে না। বাংলার মানুষ বলছেন বামফ্রন্ট যখন রাজ্য সরকার পরিচালনা করত তখন এই চিত্র ছিল না। বামফ্রন্ট সরকারের গ্রামোন্নয়ন সারা দেশেই প্রশংসা অর্জন করেছিল। গ্রাম সংসদের মাধ্যমে পরিকল্পনা করে তা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতো বামফ্রন্ট সরকারের সময়। রেগার কাজে অগ্রগতি ঘটেছিল। সারা দেশের মধ্যে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছিল বাংলা। ২০০৯-২০১০ সালে রেগায় তৈরি হয়েছিল ১৫৫১ কোটি ৭১ লক্ষ শ্রমদিবস। গড়ে পরিবার পিছু কাজ দাঁড়িয়েছিল ৪৫ দিন। ২০০৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত রাজ্যে মোট ৪,৫১৬ কোটি ৯ লক্ষ শ্রমদিবস তৈরি হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের সময় জাতীয় কর্মনিশ্চয়তা আইনকে ভিত্তি করে যেভাবে দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটেছিল, তা এককথায় অভাবনীয়। দরিদ্র পরিবারগুলির অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল।
এটা ঠিক বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার ‘মনরেগা’ প্রকল্পকে দুর্বল করে দিতে চাইছে। মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বে এই প্রকল্পের অর্থ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। আসলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার গরিব মানুষের শত্রু। সংসদের ভিতরে ও বাইরে বামপন্থীদের ধারাবাহিক লড়াইয়ের ফসল ‘জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন’। গ্রামীণ মানুষের হাতে চাহিদার ভিত্তিতে বছরে ১০০ দিন কাজ দেওয়া নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন ২০০৫’ প্রণয়ন করে।
২০১১ সালে সরকারে আসার পরই গ্রামাঞ্চলের তৃণমূলের নেতারা ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পটিকে নিজেদের আয়ের পথ হিসাবে দেখতে থাকেন। রাজ্য সরকারের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে রেগায় কাজ পেয়েছিলেন ৩৬ লক্ষ ৮৬ হাজার ৮১১ জন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজ পেয়েছিলেন ২০ লক্ষ ১৬ হাজার ৮২৯ জন। তৃণমূলের জমানায় ‘মনরেগা’ প্রকল্পের ব্যর্থতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গরিব মানুষ। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে রাজ্যের গ্রামীণ পরিবারগুলি কাজ পেয়েছিলেন গড়ে ১৯ দিন। মমতা ব্যানার্জি সরকারে আসার প্রথম বছরে তা নেমে এসেছিল ১২.৩৬ দিন। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মহিলা শ্রমজীবীরা কম কাজ পেয়েছিলেন তিন ভাগের এক ভাগ। মহিলাদের কাজ পাওয়ার নিরিখে ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গ ছিল ৬ নম্বরে। তখন ‘মনরেগা’য় রাজ্যে মহিলারা শ্রমদিবস তৈরি করেছিলেন ২ কোটি ১০ লক্ষ ৯১ হাজার। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে রাজ্যে মহিলারা শ্রমদিবস তৈরির সুযোগ পেয়েছিলেন ৮১ লক্ষ ৯৩ হাজার। ফলে ‘পরিবর্তন’র পর ‘মনরেগা’য় মহিলাদের কাজ পাওয়ার নিরিখে রাজ্যের অবস্থান নেমে হয় ১২ নম্বরে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে ‘মনরেগা’য় খরচ হয়েছিল ১,০২৩ কোটি ৮৬ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মমতা ব্যনার্জি সরকার খরচ করে মাত্র ৭৫৩ কোটি ৪০ লক্ষ ৫ হাজার টাকা। তার মধ্যে প্রায় ১৬৩ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা মে পর্যন্ত খরচ হয়েছিল (বামফ্রন্ট তখন সরকারে)। তৃণমল সরকারের আসার ২০০ দিনের মাথায় দেখা গেল ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে লক্ষ্যমাত্রার ২৫ শতাংশেরও কম কাজ পেয়েছেন মানুষ। আসলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গ্রামীণ মানুষ। ‘মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প’-এ বরাদ্দ অর্থের ব্যাপক নয়ছয় তৃণমূলী জমানায় স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই প্রকল্প খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র জনসাধারণের হাতে পৌঁছাচ্ছে না।
২০১১ সালের নভেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের যুগ্ম সচিব ডি. কে. জৈন। তিনি রাজ্য সরকারকে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন - পশ্চিমবঙ্গ ১০০ দিনের কাজে অনেক পিছিয়ে। যদিও তখন টাকার অভাব ছিল না। ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে রাজ্যের হাতে পড়েছিল ৬০০ কোটি টাকা - পাঁচ মাস ধরে। সেই সময় কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন শিশির অধিকারী। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘মমতা ব্যনার্জি সরকার নভেম্বর মাসের (২০১১ সাল) মধ্যেই ওই ৬০০ কোটি টাকা খরচের নির্দেশ দিচ্ছেন। না হলে কেন্দ্রের টাকা আবার পেতে অসুবিধা হবে।” অর্থাৎ যারা পাঁচ মাসে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে পেরেছে, তারা মাত্র ১৪ দিনে ৬০০ কোটি টাকা খরচ করবে কী করে? বোঝাই যাচ্ছে সবে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল ‘মনরেগা’র টাকা বেপরোয়াভাবে নয়ছয় করেছিল। ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারকে একটি চিঠি পাঠায় তাতে উল্লেখ ছিল, ‘‘...পনেরো দিনের কম কাজ পাওয়ার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। পশ্চিমবঙ্গের ২৩ লক্ষ ১৭ হাজার ৮৫১টি পরিবার এখন পর্যন্ত রেগায় কাজ পেয়েছে। তার মধ্যে ১৮ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯৫৩টি পরিবার কাজ পেয়েছে ১৫ দিনের কম। এই ১৫ দিনেরও কম কাজ পাওয়া পরিবারগুলি মোট কাজ পাওয়া পরিবারের ৮০.৭ শতাংশ।...”
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের পর বিধানসভায় বামফ্রন্ট শক্তিশালী বিরোধী ফ্রন্ট হিসাবে ভূমিকা পালন করেছিল। বিধানসভার ভিতরে বাম বিধায়করা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন ‘মনরেগা’র বেহাল দশা। এখন বিধানসভায় বিরোধীদল বিজেপি। কিন্তু তথ্য দিয়ে সরকারকে নাজেহাল করার কোনো উদ্যোগ বিজেপি’র নেই। ১৩ ডিসেম্বর ’১১ বিধানসভায় তৎকালীন রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, ‘‘১০০ দিনের কাজে রাজ্যের হাতে আছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। খরচ হয়েছে এখনও পর্যন্ত ১ হাজার কোটি টাকা।” কিন্তু বাকি টাকা খরচ হবে কীভাবে? মন্ত্রী কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তৎকালীন পঞ্চায়েত মন্ত্রীর হিসাব দেখে রাজ্য বিধানসভার তৎকালীন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ওইদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন,”এই হচ্ছে অবস্থা। মুখ্যমন্ত্রী টাকার জন্য দিল্লিতে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ তাঁরই এক মন্ত্রী জানাচ্ছেন, ১০০ দিনের কাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে টাকাই খরচ হয়নি। এখন বিপুল পরিমাণে পড়ে আছে খরচ না হয়ে।”
১৩ ডিসেম্বর ’১১ বিধানসভায় বামফ্রন্ট বিধায়ক আনিসুর রহমান (যিনি সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন) প্রশ্ন তুলেছিলেন - (১) রাজ্যে চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ৬ মাসে (যে সময়ে তৃণমূল জোট সরকার ক্ষমতায়) মহাত্মা গান্ধী জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে কত শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছে ও কত অর্থ ব্যয় হয়েছে? (২) গত আর্থিক বছরের প্রথম ৬ মাসে (যে সময় রাজ্যে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল) এই শ্রমদিবস ও খরচের হিসাব কী ছিল? মন্ত্রী বিধানসভায় তথ্য দিতে পারেননি। যদিও প্রশ্নকর্তা আনিসুর রহমান ওয়েবসাইটে দেওয়া সরকারি তথ্য বিধানসভায় উল্লেখ করে মন্ত্রীকে জানিয়েছিলেনঃ “গত আর্থিক বছরে বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম ছ’মাসে ১০০ দিনের প্রকল্পে ৬ কোটি ৬৭ লক্ষ ৭৫ হাজার শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছিল। এই আর্থিক বছরে তৃণমূল জোট সরকারের আমলে প্রথম ছ’মাসে শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছে ২ কোটি ৪৯ লক্ষ ২০ হাজার। ১০০ দিনের প্রকল্পে কত পরিবার কাজ পেয়েছে সেই হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গত বছর প্রথম ৬ মাসে কাজ পেয়েছিলেন ৩৬ লক্ষ ৮৬ হাজার ৮১১টি পরিবার। এবার প্রথম ৬ মাসে কাজ পেয়েছে ২০ লক্ষ ১৬ হাজার ৮২৯টি পরিবার। গত বছর প্রথম ৬ মাসে গড়ে কাজ মিলেছে ১৮ দিন। এ বছর গড়ে কাজ মিলেছে ১২ দিন। এবছর ৬ মাসে খরচ হয়েছে ২,৫৩২ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা।”
২০১১-তে যখন সরকার পরিবর্তন হয় তখন বেশ কয়েকটি জেলা পরিষদ তৃণমূল পরিচালনা করছিল। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কয়েকটি জেলা পরিষদ দখল করেছিল। ২০১১ সালে সরকারে আসার কয়েকমাস পরের চিত্রে দেখা গেল রেগায় তৃণমূল পরিচালিত জেলা পরিষদগুলি বাম পরিচালিত জেলা পরিষদের থেকে অনেক পিছিয়ে। এটা রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্য থেকেই বেরিয়ে আসে। ২৫ নভেম্বর ’১১ মমতা ব্যানার্জি সরকারের কেন্দ্রের কাছে পাঠানো রিপোর্টে উল্লেখ ছিল, ১০০ দিনের প্রকল্পে পিছিয়ে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। ওই দুটি জেলা পরিষদ পরিচালনা করত তৃণমূল। বামফ্রন্ট পরিচালিত বর্ধমান, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বীরভূম, হুগলি অনেক এগিয়েছিল। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, যেখানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় মাত্র ৮৯ হাজারের কিছু বেশি মানুষ কাজ পেয়েছিলেন, সেখানে বামফ্রন্ট পরিচালিত উত্তর চব্বিশ পরগনায় কাজ পেয়েছিলেন ২ লক্ষ ২৬ হাজারের কিছু বেশি মানুষ।
২০২২ সালেই ‘মনরেগা’ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হলো এমনটা নয়। ২০১১-তে সরকারে আসার পর তৃণমূলের লুটের নীতির জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে কাজ করেও বকেয়া ১০০ দিনের কাজের মজুরিতে। চলতি আর্থিক বছরে রাজ্যে এই প্রকল্পে কোনো অর্থ বরাদ্দ করেনি কেন্দ্র। গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের বরাদ্দ নিয়ে দুই সরকার একে অপরকে আক্রমণ করে চলেছে। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে টাকা না পাওয়ার অন্যতম কারণ যে দুর্নীতি তা শাসক তৃণমূলও চেপে রাখতে পারছে না। আদৌ রাজ্যে ১০০ দিনের কাজ চালু হবে কিনা তা ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে। ‘মনরেগা’ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের পরিদর্শক দল ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সফর করে গিয়েছেন। ‘মনরেগা’ প্রকল্পে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগের তথ্য প্রমাণ দিয়ে পঞ্চায়েত দপ্তরকে লুটের টাকা উদ্ধার করার নির্দেশও দিয়ে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় পরিদর্শক দল। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়েছে বাংলার মানুষের।
১০০ দিনের প্রকল্পে টাকা লুটের অভিযোগ নিয়ে গত এক দশক ধরে সরব বামফ্রন্ট। কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের প্রমাণ থাকলেও দিনের পর দিন মোদি সরকার চুপ ছিল। যা আসলে মমতা সরকারকে রক্ষা করার নামান্তর। অবশেষে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে দুর্নীতির টাকা পুনরুদ্ধারে রাজ্যকে কড়া চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্র, অভিযুক্তদের শাস্তির সুপারিশ সহ। সাত দফা সুপারিশে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, বেআইনিভাবে রেগার কাজে যে অর্থের নয়ছয় হয়েছে তা উদ্ধার করার জন্য রাজ্য সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন এর আগে কেন্দ্রের শর্ত মেনে রাজ্য টাকা উদ্ধারে নেমেছিল। কিন্ত উদ্ধার হয়েছিল মাত্র ২ কোটি টাকা।
কেন্দ্রের পরিদর্শক দল চিহ্নিত করেছে, জনগণের টাকা লুটের বড়ো ক্ষেত্র মাটি ভরাট। মাটি ভরাট না করেও ভুয়া মাস্টার রোল তৈরি হয়েছে। আমফান ঝড়ের দিনেও নাকি চূর্ণী নদীতে বাঁধ নির্মাণের কাজ হয়েছে! অনুমোদনহীন কাজেও রেগার টাকা বেপরোয়া খরচ হয়েছে। ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ না করলেও টাকা ঢুকেছে গ্রামের তৃণমূলী লুম্পেনদের আ্যাকাউন্টে। ১০০ দিনের কাজ হয় তৃণমূলের ইচ্ছা মতো। গ্রামে যারা কোনও দিন কাজ করেননি এবং জমির মালিক, তারা কাজ না করেও ১০০ দিনের অর্থ পান। বঞ্চিত হন গরিব মানুষ। জবকার্ড ভাড়ায় খাটে। ১০০ দিনের কাজে আমাদের রাজ্যে দুর্নীতির দুটি প্রধান ক্ষেত্র - একটি জবকার্ড অন্যটি মাস্টার রোল। তৃণমূলী রাজত্বে গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের কাছে কাজ পৌঁছানোর পথ বন্ধ করতে দুটি পথ নেওয়া হয়েছে - দুর্নীতি আর হিংসা।
গোটা রাজ্যেই একশো দিনের কাজ এখন থমকে। কাজের দাবিতে গ্রাম বাংলা সোচ্চার। কেন্দ্রীয় সরকারের ১০০ দিনের কাজ সংক্রান্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এ রাজ্যে নথিভুক্ত শ্রমিক ৩.৪২ কোটি আর জবকার্ড আছে এমন পরিবার ১.৫৭ কোটি। ২০২১-২২-এ কর্মদিবস তৈরি হয়েছিল ৩৬.৪২ কোটি। কিন্তু মজুরি দিতে না পারার কারণে কর্মদিবস হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৩.৪৩ কোটিতে। গত ২০ জুলাই রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রী জানান, ১০০ দিনের প্রকল্পে গোটা দেশে বকেয়া মজুরির পরিমাণ ৩,৯৮৯.৫৮ কোটি টাকা,যার মধ্যে শুধু পশ্চিমবাংলার বকেয়া ২,৬০৫.৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গোটা দেশের বকেয়ার ৬৫ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু এত বকেয়া টাকা দেওয়া বন্ধ করল কেন কেন্দ্র? এর উত্তরে রাজ্যসভায় মন্ত্রী বলেন, ‘‘কেন্দ্রের নির্দেশ ঠিকমতো অনুসৃত না হলে এই প্রকল্পের জন্য ধার্য তহবিল থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হবে”।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ থাকে, যে দুর্নীতির কারণ দেখিয়ে এই কেন্দ্রীয় তহবিল বন্ধ রেখেছে, সেই দুর্নীতি রোধে এরাজ্যে সোশ্যাল অডিট বন্ধ রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। রাজ্যের সোশ্যাল অডিট নির্দেশক জানিয়েছেন, ২০২১-২০২২ ও ২০২২-২৩-এ ১০০ দিনের কাজের সোশ্যাল আডিটের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ করা হয়নি। এ প্রশ্নও উঠেছে, দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও সিএজি কেন ২০১১-১২’র পর কোনো অডিট করল না? যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ১০০ দিনের কাজে লুট হয়েছে তা কি আদৌ উদ্ধার হবে?
নবান্ন’র দেওয়া রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে গত ১০ মাসে মাত্র ১৮ দিন কাজ দেওয়া হয়েছে। যে অবাক করা তথ্য সামনে এসেছে তা হলো - রাজ্যে জবকার্ড বেড়েছে, কাজ কমেছে। ২০২২ সালে জব কার্ড আছে এমন পরিবারের সংখ্যা ১,৫২,৭৬,৫৬৯টি, কাজ পেয়েছেন ১৬,১৩,৫২৫টি পরিবার। ২০২১ সালে জব কার্ড ছিল ১,৫১,৮১,৯৪৪টি পরিবারের, কাজ পেয়েছিলেন ৭৫,৯৭,৪৯০টি পরিবার। মমতা ব্যানার্জির দাবি রাজ্যে মহিলাদের আর্থিকভাবে উন্নত করার জন্য ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ সহ নানা প্রকল্প এনেছেন। কিন্তু ১০০ দিনের কাজে মহিলাদের প্রতি বৈষম্যের ছবি তিনি মুছবেন কী করে? ২০২১-২০২২ সালে ‘মনরেগা’তে গড় কাজ ছিল - ৪৭.৯৪ দিন, মহিলাদের গড় ছিল - ৩৩.২৮ দিন।
আমাদের রাজ্যে গ্রামীণ মজুরির হার উদ্বেগজনকভাবে কম। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্ট (২০২১) অনুযায়ী, এই রাজ্যে গ্রামীণ জনসংখ্যার দৈনিক মজুরির হার মাত্র ২৮৮.৬০ টাকা, যেখানে জাতীয় গড় ৩০৮.৯০ টাকা। এটাও দেখা যাচ্ছে মমতা ব্যনার্জি সরকার শ্রমের অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে চলেছেন।
কিন্তু এটা আর বেশিদিন চলবে না। বকেয়া মজুরি, ন্যায্য মজুরি আর কাজের দাবিতে গ্রাম বাংলার মানুষ সোচ্চার হয়েছেন। তৃণমূলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নভেম্বর মাস জুড়ে কিষান-শ্রমিক-খেতমজুর সংগঠনের আহ্বানে গ্রামে গ্রামে মানুষ মাইলের পর মাইল পথ হেঁটেছেন। ডিসেম্বরে আরও বড়ো আন্দোলনের পথে বাংলার মানুষ। আর ‘মনরেগা’কে অকার্যকর করার বিজেপি’র চক্রান্তের বিরুদ্ধে ২৬ নভেম্বর ভারতের বড়ো বড়ো শহরগুলিতে সমাবেশ করবে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। আওয়াজ উঠেছে ১০০ দিনের কাজের আইনকে সংশোধন করে ২০০ দিন করতে হবে, মজুরি বাড়াতে হবে। গ্রামীণ গরিব মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে পরাস্ত হবে বিভাজনের রাজনীতি, পিছু হটবে বিজেপি-তৃণমূলের বোঝাপড়ার অনৈতিক রাজনীতি।