৬০ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ২ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
বিশ্বকাপ ফুটবল ও প্রতিবাদের কণ্ঠ
সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
যাঁরা মনে করেন খেলা আর রাজনীতি এক নয়, যাঁরা মনে করেন খেলার মাঠে রাজনীতির প্রবেশ অনুচিত তাঁরা আসলে ভুলে যান যে, যেকোনো লড়াইয়ের মধ্যেই থাকে রাজনীতি। খেলার মাঠ শুধু রাজনৈতিক নয়, রীতিমতো আন্তর্জাতিক রাজনীতির, আদর্শ ও প্রতিবাদের সব থেকে বড়ো ভিত্তিভূমি বলেই বারংবার প্রতিভাত হয়েছে।
সেটা ১৯৭৪। অগাস্টো পিনোচেত চিলি দখল করেছে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সালভাদর আলেন্দের সরকারকে হটিয়ে ও পরে রাষ্ট্রপতিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে। সেবার বিশ্বকাপ ছিল পশ্চিম জার্মানিতে। একটি প্লে অফ ম্যাচে ঘরের মাঠে চিলি মুখোমুখি হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের। যে মাঠে খেলা হবে, সেটি একসময়ে পিনোচেত মৃত্যুদণ্ডের জন্য ব্যবহার করেছিল। স্বভাবতই খেলতে রাজি হলো না সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফিফা গোটা প্রতিযোগিতা থেকে তাদের সাসপেন্ড করলো। ম্যাচের দিন চিলিকে নির্দেশ দেওয়া হলো মাঠে থাকতে। ওই দিন চিলির একজন খেলোয়াড় ফাঁকা গোলে শট মেরে গোল করলেন, চিলিকে ১-০ গোলে জিতিয়ে দেওয়া হলো।
চিলি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে চিলির ম্যাচে বার্তি ভোগসকে কড়া ট্যাকলের জন্য চিলির কার্লোস ক্যাসজেলি লাল কার্ড দেখেছিলেন। পরে তিনি স্বীকার করেন যে, ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা আগে তাঁকে জানানো হয়েছিল, বাড়িতে তাঁর মাকে পিনোচেতের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। সেটা খেলার সময়ও তাঁর মনে প্রভাব ফেলে। তিনি মাথা গরম করে ট্যাকল করে বসেন। কার্লোস ক্যাসজেলি পরবর্তীকালে প্রতিবাদের মুখ হয়েছিলেন পিনোচতের সরকারের বিরুদ্ধে।
এরপরেও প্রতিবাদ হয়েছে। রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। শাস্তিও হয়েছে। যেমন আর্জেন্টিনা ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ফিফা কর্তৃক শাস্তি পায়, জার্সিতে ‘ফকল্যান্ড আর্জেন্টিনার’ লেখা পড়ে খেলতে নামাতে।
তবে প্রতিবাদের সূত্রপাত কিন্তু সেই ১৯৩৪ সালে। প্রথম বিশ্বকাপের বিজয়ী উরুগুয়ে প্রতিযোগিতায় খেলতেই যায়নি। ১৯৩৮ এ সমস্যা আরও বড়ো আকার নিয়েছিল, মুসোলিনির ব্ল্যাক শার্ট-এর মতো সম্পূর্ণ কালো পোশাকের ইতালি দল চূড়ান্ত বিরোধিতার সামনে পড়েছিল যেখানে যেখানে খেলতে গিয়েছিল। ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিক্ষোভ সর্বত্র সহ্য করতে হয়েছিল তাদের।
১৯৬৬ সালটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। সেবার ফিফা নিয়ম করেছিল যে, আফ্রিকার তিনজন দ্বিতীয় রাউন্ডের জয়ী দলকে এশিয়া জোনের দলের সঙ্গে প্লে অফ খেলে আসতে হবে। কারণ ফিফার ধারণা ছিল আফ্রিকা বা এশিয়ার সরাসরি খেলার যোগ্যতা নেই। এর প্রতিবাদে ঘানার ওহেনে জানের নেতৃত্বে ৩১টি আফ্রিকার দেশ সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতা বয়কট করে। ফিফা আর এই ধৃষ্টতা দেখায়নি।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে পর্তুগালের খেলোয়াড়রা ধর্মঘটের ডাক দেয়। বিজ্ঞাপন বাবদ অর্থ ঠিকমতো না পাওয়ায়। এই নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও সমস্যা হয়। প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেয় পর্তুগাল। এক দশক তাদের ফুটবলের মান দূর্বল হয়ে যায়।
২০০২ সালে একদল জাপানি কোরিয়া দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ দেখায় কেন জাপানের আগে কোরিয়ার নাম বসছে প্রচারে। এটা কোনও বড়ো ইস্যু যদিও হয়নি, তবুও এটাও ছিল প্রতিবাদ। কিন্তু ২০০৬ সালের প্রতিবাদ ছিল বিরাট আকারের। ইরানের রাষ্ট্রপতি মহাম্মদ আহমদিনেজাদের ইজরায়েলকে ইয়োরোপে পাঠানোর কথায় ক্ষুব্ধ একদল মানুষ ন্যুরেমবার্গে প্রতিবাদ করেন মেক্সিকো বনাম ইরানের গ্রুপ লিগের ম্যাচের আগে।
২০১০ এ ফ্রান্সের খেলোয়াড় কোচের অধীনে খেলতে অস্বীকার করে, কোচ নিকোলাস আনলেকা তাদের দলের অধিনায়ক প্যাট্রিক এভ্রা-কে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বললে এই অবস্থা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ চিহ্নিত হয়ে থাকবে প্রতিবাদের বিশ্বকাপগুলির মধ্যে। ২৩৪ জন প্রতিবাদী গ্রেফতার হয়। কারণ তাঁরা ব্রাজিলের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে দেশে বিশ্বকাপ চাইছিলেন না।
২০১৮ সালের রাশিয়ায় পুতিনের শাসনের বিরুদ্ধে পাঙ্ক ফেমিনিস্ট গ্রুপ ‘পুসি রায়ট’ মাঠে ঢুকে প্রতিবাদ করে।
২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপ বিক্ষোভ দেখানোর অন্যতম বিশ্বকাপ। ইরান নিজের দেশের মহিলাদের আন্দোলনকে সমর্থন করে জাতীয় সঙ্গীত গায়নি। চোয়াল শক্ত করে চেপে কাটিয়ে দেয়। ফিফার হুমকিতে অবশ্য পরের ম্যাচে বাধ্য হয়। গ্যালারিতে অবশ্য প্রতিবাদ থেমে থাকেনি।
এদিকে সাতটি ইয়োরোপীয় দেশের অধিনায়ক ঠিক করেন যে LGBT QA+ আন্দোলনকে সমর্থন করে সাতরঙা ব্যান্ড হাতে পরে নামবেন মাঠে। ফিফা হুমকি দেয় এইসব কাজ বন্ধ করতে। প্রতিবাদে জার্মান দল প্রথম ম্যাচে হাতে মুখ ঢেকে ফোটো সেশন করে।
হারবার্ট উপন্যাসে নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, “কখন, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।” ফিফা রাষ্ট্র নয়। একটি রাষ্ট্র সংঘ। যারা কোনোদিন জনগণের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষার কথা ভাবেনি। ফলে যে প্রতিবাদ জনগণের অধিকার, তা চিরকাল আটকানোর চেষ্টা করা হলেও বিদ্রোহ চিরকাল মাথা তুলেছে ও তুলবে। যেখানেই হেটারোজেনাস মাস গ্যাদারিং হবে, সেখানেই প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর তার অস্তিত্ব জাহির করবে। আগামীদিনে আরও আরও প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর এই ভাবেই ধ্বনিত হবে বিশ্বকাপের মঞ্চে।