৬০ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ২ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (এগারো)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
দ্বান্দ্বিকতার তৃতীয় সূত্র হলো - নেতির নেতিকরণ (Nagation of the Nagation)
● বিকাশের অভিমুখ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই সূত্রের মাধ্যমে। দ্বান্দ্বিকতার প্রথম সূত্রে আলোচনা করা হয়েছে গতি কীভাবে বস্তু, ঘটনা ও প্রক্রিয়ার মধ্যে সৃষ্টি হয়, দ্বিতীয় সূত্রে, গতির ফলে পরিবর্তন, সেই পরিবর্তনের ধারা কীভাবে পরিচালিত হয় তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দ্বান্দ্বিকতার তৃতীয় সূত্রে, বিকাশের অভিমুখ কী, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
● নেতির নেতিকরণের মাধ্যমে বিকাশের ধারাকে উপলব্ধি করতে হবে। বিকাশের প্রক্রিয়ায় গুণগত রূপান্তর যখন ঘটে, পূর্বের পর্যায়ের নেতির মাধ্যমেই তা ঘটে। নেতির মাধ্যমে যে নতুনের আবির্ভাব ঘটল, বিকাশের ধারায় তারও নেতি ঘটে। একেই বলে নেতির নেতিকরণ। আসলে নেতির অর্থ হলো বাতিল হওয়া বা বাতিল করা। নেতির নেতিকরণের অর্থ বাতিলের আবার বাতিলীকরণ। পুরাতনের নেতির মধ্য দিয়ে নতুনের আবির্ভাব ঘটে, আবার আজ যা নতুন, কাল তা পুরাতন হয়, আর নেতি ঘটে। প্রকৃতি জগতে ও মানবসমাজে আমরা প্রতিনিয়ত নেতির নেতিকরণ প্রত্যক্ষ করি।
নেতির নেতিকরণ - প্রকৃতি জগতে
● শস্য বীজের নেতি ঘটে চারা গাছের জন্মের মধ্য দিয়ে। আবার চারা গাছের নেতি ঘটে শিষের জন্মের মধ্য দিয়ে। শিষের মধ্যে অনেকগুলি শস্য কণা থাকে। একটি শস্যকণার পরিবর্তে অনেকগুলি শস্যকণা। নতুনতর বহিঃপ্রকাশ। এটাই তো নেতির নেতিকরণের মধ্য দিয়ে বিকাশের উদাহরণ।
● আবার, এটাও তো আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, সকালের নেতি ঘটে দুপুরের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। দুপুরের নেতি ঘটে রাতের আবির্ভাবের ফলে। রাতের নেতি ঘটে সকালের আবির্ভাবের ফলে। এটা কিন্তু পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া নয়। গতকালের সকাল ও আজকের সকালের মধ্যে বিস্তর ফারাক। গতকাল পৃথিবী, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ, চাঁদ যে অবস্থানে ছিল, আজ সেই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমার, আপনার বয়সও একদিন করে বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু পুরাতনের অবসান ঘটেছে। নতুনের আবির্ভাব ঘটেছে।
নেতির নেতিকরণ - মানব সমাজে
● মানব সমাজের প্রথম যে রূপের সন্ধান আমরা পাই, তা হলো আদিম সাম্যবাদী সমাজ - যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। শোষণ ছিল না, ছিল না শ্রেণি বিভাগ। এই আদিম সাম্যবাদী সমাজের নেতির (Negation) মাধ্যমে দেখা দেয় দাস সমাজ। প্রথম শোষণভিত্তিক সমাজ। এইসময় থেকেই মানব সমাজে দেখা দিল শ্রেণি বিভাগ ও শ্রেণি সংগ্রাম। বিকাশের ধারায় দাস সমাজ ব্যবস্থার নেতি ঘটল। দেখা দিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। ওখানেই থেমে যাওয়া নয়। মানবসমাজের বিকাশের ধারায় সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নেতি ঘটল। পুঁজিবাদী সমাজের আবির্ভাব ঘটল। বিকাশ অপ্রতিহত। পুঁজিবাদী সমাজের নেতির মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজ - যারও নেতির মাধ্যমে সাম্যবাদী/সাম্যবাদী সমাজের স্তরে উপনীত হয়ে মানব সমাজ আরও বিকাশের ধারায় অগ্রসর হবে। প্রসঙ্গত, কোনো সমাজব্যবস্থা ধ্বংস হতে পারে না যতক্ষণ না তার মধ্যেকার উৎপাদিকা শক্তি, যার পক্ষে ওই নির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থা উপযুক্ত, তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। উৎপাদিকা শক্তির সর্বোচ্চ বিকাশের সাথে যখন বিরাজমান উৎপাদন সম্পর্কের সাথে তীব্রতর দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় তখনই পুরাতন সমাজব্যবস্থার অবসানের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
● নেতির নেতিকরণের মধ্য দিয়ে বিকাশের ধারা অগ্রসর হচ্ছে। পৃথিবীর বুকে মানব সমাজের আবির্ভাবের পর মানব সমাজের যে বিকাশের ধারা তা নেতির নেতিকরণের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজ নেতির নেতিকরণের মধ্য দিয়ে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় উপনীত হবে। সাময়িক কোনো বিকৃতি বিকাশের এই ধারাকে রোধ করতে পারবে না। বিকাশের ধারাই সাময়িক বিকৃতির অবসান ঘটাবে। আদিম সাম্যবাদী স্তর থেকে সাম্যবাদী সমাজ কোনোভাবেই পুরাতনে অর্থাৎ পুরাতন স্তরে ফিরে যাওয়া নয়। আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থায় মানুষ ছিল অসভ্য, বর্বর এবং প্রকৃতির নিয়মাবলি সম্পর্কে অজ্ঞ। আগামী সাম্যবাদী ব্যবস্থায় মানব সভ্যতা বহুগুণ উন্নততর অবস্থায় আরোহণ করবে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি ঘটবে। সামগ্রিকভাবে মানব জ্ঞানের ব্যাপক বিকাশ ঘটবে। প্রকৃতি জগতের নিয়মাবলি সম্পর্কে অনেক বেশি পরিমাণে অবহিত হবে সাম্যবাদী যুগের মানব সমাজ এবং সেই নিয়মগুলিকে মানব সমাজের বিকাশের প্রশ্নে অনেক বেশি পরিমাণে প্রয়োগ করতে সমর্থ হবে তৎকালীন সমাজ।
● মানব সমাজে ধারাবাহিকভাবে যে প্রজন্মের পরিবর্তন ঘটছে, তাও নেতির নেতিকরণের প্রতিফলন ব্যতিরেকে অন্য কিছু নয়।
● মানব জ্ঞানের ক্ষেত্রেও যদি দৃষ্টিনিক্ষেপ করা যায়, তাহলে দেখা যায় সেক্ষেত্রেও নেতির নেতিকরণের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে চলেছে। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে আদিম সমাজের মানব ধারণার নেতি ঘটেছে পরবর্তীকালে। টলেমি’র বিশ্ব ধারণা কোপারনিকাসের যুগে তার নেতি ঘটল। পরবর্তীকালে নেতির মাধ্যমেই বিশ্ব ধারণার ক্রমান্বয়ে উন্নতি ঘটছে। বিকাশ প্রক্রিয়া (Process of evelopment) তো সর্বসময়ে নেতির নেতিকরণের মধ্য দিয়েই ঘটছে।
● বিকাশের ধারা সামনের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে, নেতির নেতিকরণের মধ্য দিয়ে। বিকাশের ধারা কিন্তু সরলরেখা নয়। বিকাশের ধারা পরিচালিত হয় সর্পিল আকারে। ঘোরানো সিঁড়ির মতো। বিকাশের ধারা চক্রাকার নয়। বিকাশের ধারায় পুরানো অবস্থায় ফিরে আসার কোনো প্রশ্ন নেই। আপাত পূর্বাবস্থা মনে হলেও তা কিন্তু উন্নততর স্তরে। পূর্বেই আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা থেকে আগামী সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় উত্তরণের বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে।
● নেতির নেতিকরণের অর্থ হলো -
(১) বিকাশ ধারাবাহিক। প্রকৃতি জগৎ ও মানব সমাজ নিরন্তর বিকাশ ধারায় বিরাজ করছে।
(২) বিকাশের অর্থ প্রগতি। বিকাশ প্রগতির দিকে। এক্ষেত্রে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় - এটা কী প্রগতি? এর উত্তর হলো, বিকাশের ধারায় কখনো কখনো বিকৃতি ঘটতে পারে। বিকাশের ধারা শেষপর্যন্ত এই বিকৃতির অবসান ঘটায়।
(৩) বিকাশের ধারা চক্রাকারে নয়। সর্পিল আকারে। তারফলে আপাত পুনরাবৃত্তি প্রকৃতপক্ষে উন্নততর স্তরে। নেতির নেতিকরণের প্রক্রিয়ায় যে বিষয়গুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো -
(ক) বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়ার মধ্যেই নেতির কারণগুলি বিরাজ করে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিকাশের ফলেই নেতি।
(খ) দ্বন্দ্বগুলির পরিপক্কতার ওপর নির্ভর করেই নেতি ঘটে। দ্বন্দ্বগুলির পরিপক্কতার বিষয়টি বাদ দিয়ে নেতি ঘটতে পারে না। পরিমাণগত পরিবর্তন যখন একটা নির্দিষ্ট বিশেষ অবস্থায় উপনীত হয়, তখনই গুণগত রূপান্তর অর্থাৎ পূর্বের অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। পূর্বের অবস্থার গুণগত রূপান্তরই তো হলো নেতি।
(গ) বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট ধরন বা প্রকৃতির ওপর নেতির ধরন নির্ভর করে। প্রতিটি প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট ধরন রয়েছে।
(ঘ) নেতির অর্থ সর্বাংশে বাতিল নয়। যা বাতিলযোগ্য তারই নেতি ঘটে। যা টিকে থাকতে সক্ষম, তা সংরক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দাস সমাজে মানব জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি ঘটেছিল তা পরবর্তীকালে সংরক্ষিত হয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক যুগে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যে অগ্রগতি ঘটেছে, তা তো ধ্বংস করা হয়নি। তাকে ভিত্তি করেই পুঁজিবাদী সমাজে বিজ্ঞান, প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে চলেছে। শেকস্পিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, ম্যাক্সিম গোর্কি, তানসেন, বৈজু বাওড়া, ওমর খৈয়াম, ভিক্টর হুগো, নিউটন, আইনস্টাইন, জগদীশচন্দ্র বসু, সি ভি রমন প্রমুখের সৃষ্টি ও আবিষ্কার যে সমাজব্যবস্থার মধ্যেই সৃষ্টি হোক না কেন, মানবসমাজে তার প্রাসঙ্গিকতা চিরকালীন। যা সংরক্ষণযোগ্য, তাকে রেখেই নেতির নেতিকরণের প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। যা বাতিলযোগ্য, তার বাতিলীকরণ ঘটে। নেতির অর্থ সমস্ত কিছুসহ কোনো বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ নেতি ঘটে না। একটা রূপ বা স্তর থেকে অন্য রূপে বা স্তরে রূপান্তর তো পূর্বেকার সাথে সম্পর্কহীন নয়।
দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি
● দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, এই দর্শনকে আত্মস্থ করা ও মানব সমাজের প্রয়োজনমত তাকে প্রয়োগ করা। এই লক্ষ্যে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির চর্চা করা হয়। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে আত্মস্থ করে, মানব সমাজের বিকাশ ধারাকে অনুধাবন করে সমস্ত ক্ষেত্রে (রাজনৈতিক কার্যধারাসহ) দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি যাতে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির আলোচনায় এবার আমরা প্রবেশ করব।
(ক্রমশ)