E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ২ জুলাই, ২০২১ / ১৭ আষাঢ়, ১৪২৮

টিকা কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে রাজ্যের সর্বত্র প্রতিবাদ বিক্ষোভ


টিকা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে কলকাতায় বামপন্থী ছাত্র-যুব-মহিলাদের বিক্ষোভ।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কসবার টিকা কেলেঙ্কারি এবং জালিয়াতির বিরুদ্ধে উপযুক্ত তদন্ত এবং জড়িতদের গ্রেপ্তারি এবং শাস্তির দাবিতে ২৮ জুন কলকাতায় কর্পোরেশনের সামনে বামপন্থী ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনগুলির শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমে এল পুলিশের লাঠি। এদিন পুলিশ প্রথম থেকেই আন্দোলন ভাঙার জন্য আক্রমণাত্মক ছিল। কোনও প্ররোচনা ছাড়াই প্রতিবাদীদের নির্মম ভাবে মারা হয়েছে, প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়েছে টেনে হিঁচড়ে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ গায়ের জোরে আন্দোলনকারীদের হটানোর চেষ্টা করলে প্রতিরোধ গড়ে তুলে প্রতিবাদীরা এগিয়েছেন পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে। পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে সর্বস্তরেই। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র দু’টি পৃথক বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দা করে ভুয়ো টিকাকরণ কাণ্ডে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করেছেন।

এদিনের ঘটনায় ২২ জন মহিলা সহ গ্রেপ্তার হন ৪৩ জন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা কনীনিকা ঘোষ, ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সভানেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি, রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র, এসএফআই’র সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস, রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য প্রমুখ। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ বিক্ষোভকারীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পুলিশ প্রশাসন।

২৮ তারিখ দুপুর ১টা থেকে হওয়ার কথা ছিল বিক্ষোভ। আন্দোলনকারীরা তার আগে থেকেই জড়ো হন। অনেকেরই হাতে ছিল টিকার সিরিঞ্জের কাটআউট। ছিল প্ল্যাকার্ড, পতাকা। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে প্ররোচনার লক্ষ্যে নিজাম রেস্টুরেন্টের সামনে ব্যারিকেড বসায় কলকাতা পুলিশ। যদিও সেই ব্যারিকেড বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সেটিকে সরিয়েই কর্পোরেশনের গেটের দিকে এগোতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। ফের একবার তাদের পথ আটকে ছাত্র যুব মহিলা নেতৃত্বের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ে পুলিশ আধিকারিকরা। ছাত্র যুব মহিলা নেতৃত্বের সঙ্গে যখন পুলিশ আধিকারিকরা কথা বলছেন, তখনই অন্যদিকে মারমুখী হয়ে ওঠে পুলিশ এবং ইউনিফর্ম ছাড়া একদল যুবক। এরা পুলিশ, নাকি তৃণমূলী গুন্ডা — তা নিয়ে বিক্ষোভ স্থলেই প্রশ্ন ওঠে। এদিন পুলিশের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগও উঠেছে।

আন্দোলনকারীদের সংহতি জানাতে কর্পোরেশন চত্বরে এদিন ছিলেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শমীক লাহিড়ি, পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক কল্লোল মজুমদার। ছিলেন সংযুক্ত মোর্চার বিধায়ক, আইএসএফ নেতা নৌশাদ সিদ্দিকিও।

২৮ তারিখের এই ঘটনার প্রতিবাদে, টিকা-কেলেঙ্কারিতে যুক্তদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ২৯ ও ৩০ জুলাই বিকাল পাঁচটায় রাজ্যের প্রতিটি থানার সামনে বিক্ষোভের কর্মসূচি পালন করা হয় এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে। থানাগুলিতে টিকা-কেলেঙ্কারির যথাযথ তদন্ত, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের দাবিতে অভিযোগও দায়ের করেন ছাত্র-যুব-মহিলা-ইউনিয়ন কর্মীরা।

টিকা নিয়ে জালিয়াতির প্রতিবাদে ২৮ জুনের প্রতিবাদ আন্দোলনকে যেভাবে পুলিশ দিয়ে দমন করার চেষ্টা করেছে রাজ্য সরকার, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র দু’টি পৃথক বিবৃতিতে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। জালিয়াতি রোধ ও প্রতারকদের শাস্তি দেবার বদলে এরাজ্যের সরকার যেভাবে মানুষের প্রতিবাদের কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে মমতা ব্যানার্জির সরকার তা চরম নিন্দনীয় বলে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে তাঁরা বলেছেন ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।

বিবৃতিতে বিমান বসু বলেছেন, এটা বিস্ময়কর যে বিগত কয়েকমাস ধরে কলকাতা কর্পোরেশনের লোগো ও সাইনবোর্ড ব্যবহার করে এক ব্যক্তি নিজেকে আইএএস পরিচয় দিয়ে ভূয়ো সংস্থা চালিয়েছে, কিন্তু পুলিশ বা কর্পোরেশন তার কোনো খবরই পেল না। অথচ বছরখানেক আগেই ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ ছিল। আমরা গভীর ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে পুলিশ যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়নি। এই ভূয়ো ব্যক্তির অবাধ যাতায়াত ছিল শাসক দলের মন্ত্রী-সাংসদ-কলকাতা কর্পোরেশনের প্রশাসকমন্ডলীর সদস্য-আমলাদের অনেকেরই সঙ্গে। ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারির প্রকৃত দোষী এবং এর সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যেহেতু সরকারী দলের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা যুক্ত আছেন বলে অভিযোগ এবং প্রাথমিক তথ্য প্রমাণও জনসমক্ষে এসেছে, ইতিমধ্যেই আদালতে বেশ কয়েকটি মামলাও দায়ের হয়েছে, তাই এই তদন্ত আদালতের তত্ত্বাবধানেই করতে হবে।

টিকা জালিয়াতিকে আড়াল ও মদত দেওয়াই এই সরকারের মনোভাব এই অভিযোগ করে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকাকে বিঁধে সূর্য মিশ্র ঐ বিবৃতিতে বলেছেন, নারদ ঘুষকান্ডে অভিযুক্ত দলের নেতাদের রক্ষা করতে ক’দিন আগেই মহামারীর বিধিনিষেধকে বিন্দুমাত্রও আমল না দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যখন কলকাতায় নিজাম প্যালেসে দলবল সহ জমায়েত করে হাজির হয়েছিলেন তখন কিন্তু পুলিশ প্রশাসনকে নিশ্চুপ থাকতে দেখা গেছিল। এই সরকার এর আগেও চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে অজস্র কেলেঙ্কারি আড়াল করতে এবং অপরাধীদের সঙ্গে শাসকদলের যোগসাজস আড়াল করতে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করেছে। এখন প্রতিবাদ আন্দোলনকে মহামারী আইনের অছিলায় আটকাতে চাইছে, অথচ মহামারীর সময়ে জালিয়াতির কারবার বাড়ছে, সেদিকে সরকারের কোনও দৃষ্টি নেই। তিনি বিবৃতিতে ভুয়ো টিকাকরণ কেন্দ্র নিয়ে জালিয়াতির পূর্ণাঙ্গ নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করে বলেছেন, অভিযুক্তদের যে যোগাযোগই থাকুক না কেন তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। টিকা নিয়ে কালোবাজারি বন্ধ করতে এবং সকলের জন্য বিনামূল্যে টিকাকরণের জন্য সরকারকে ব্যবস্থা করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ২৮ জুন নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, কলকাতা পুলিশ, কলকাতা কর্পোরেশন ভ্যাকসিনকাণ্ডে দায় এড়াতে পারে না। আর তাঁর বক্তব্যকে আমল না দিয়ে কর্পোরেশনকে নিজেই ক্লিনচিট দিয়েছেন ফিরহাদ হাকিম।

২৯ ও ৩০ তারিখ কলকাতায় আর্মহাস্ট স্ট্রিটের সামনে দীর্ঘক্ষণ পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান ছাত্র-যুব-মহিলারা। এছাড়াও নেতাজীনগর, নিউ মার্কেট, হরিদেবপুর, বেহালা, চারু মার্কেট, তিলজলা, টালা, লেক থানা ও শ্যামনগর থানার সামনে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়।

হাওড়া জেলার গোলাবাড়ি, সাঁকরাইল, হাওড়া, এজেসি বোস রোড, দাশনগর, ডোমজুড়, বালি, লিলুয়া, নিশ্চিন্দা, শিবপুর এবং হাওড়া (গ্রামীণ) জেলা পুলিশের অন্তর্গত উলুবেড়িয়া, রাজাপুর, শ্যামপুর, জগৎবল্লভপুর থানার সামনে বিক্ষোভ দেখায় এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি ও সিআইটিইউ কর্মীরা।

২৯ জুন উত্তর ২৪পরগনা জেলায় স্বরূপনগর থানার সামনে শুরু হয় বিক্ষোভ সভা। ভ্যাকসিনকাণ্ডে জড়িত প্রভাবশালী সহ সকলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও আদালতের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জা্নানো দফা দাবি সংবলিত স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয় থানার ওসির কাছে।

পূর্ব বর্ধমান জেলায়ও বিক্ষোভ দেখিয়েছে এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি। বর্ধমান শহরে কার্জনগেট থেকে মিছিল করে প্রতিবাদীরা বর্ধমান সদর থানায় যায়। থানায় ভ্যাকসিন কাণ্ডে অভিযোগও দায়ের করা হয়।শক্তিগড় থানা সহ কাটোয়া পৌরসভার সামনে বিশাল জমায়েত করে থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হয়। বিক্ষোভ হয় ভাতাড় থানাতেও। এছাড়াও কালনা, কেতুগ্রাম, পূর্বস্থলী, জামালপুর, রায়না, খণ্ডঘোষ, গলসি, গুসকরা, মঙ্গলকোট, দেওয়ানদিঘি, মন্তেশ্বর সর্বত্র ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। এদিন বামপন্থী গণসংগঠনগুলির উদ্যোগে সিউড়ি থানা চত্বরে বিক্ষোভ দেখান ছাত্র-যুব ও সাধারণ মানুষ। পরে দাবি সনদ সহ ডেপুটেশন দেওয়া হয়। এছাড়াও এদিন বিক্ষোভ ডেপুটেশন হয়েছে বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার, রাজনগর, সাঁইথিয়া, দুবরাজপুর, লাভপুর, বোলপুর, নলহাটি, মাড়গ্রাম, পাইকর, মল্লারপুর থানাতে।

কলকাতার প্রতিবাদরত নিরস্ত্র বামপন্থী ছাত্র-যুব-মহিলাদের ওপর পুলিশের হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পুরুলিয়ার আদ্রা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখানো এবং ডেপুটেশন দেওয়া হয়।

জাল ভ্যাকসিন কাণ্ডের নামে সংগঠিত গণহত্যার চেষ্টা চলেছে এমন মত উঠে বিভিন্ন মাধ্যমে যখন দ্রুত জোরদার হচ্ছে তখন ২৮ জুন দু’টি রাজ্য সরকার এবং কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের সাংবাদিক বৈঠকের ছবিতেই স্পষ্ট, দায় এড়াতে না পেরে ভ্যাকসিনকাণ্ডে প্রবল অস্বস্তিতে সরকার এবং কলকাতা কর্পোরেশনের প্রশাসকমণ্ডলী। উলটে প্রতিদিন আরও বেআব্রু হচ্ছে ভ্যাকসিনকাণ্ডে শাসক তৃণমূল মায় সরকারের যোগ।